ঘূর্ণিঝড় ও বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রাম
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৯:৩০
শেষ বিকেলের সমুদ্র সৈকত পর্যটকদের ভিড়ে মুখরিত। পশ্চিম আকাশে হেলে পড়া সূর্য একটু একটু করে সাগরের বুকে ডুবে যাচ্ছে। এ দৃশ্য উপভোগে সবাই ব্যস্ত। এর পাশাপাশি হকারদের উচ্চস্বর, ঝাউবন আর জেলেদের ইঞ্জিন নৌকা ঘিরে নানা বয়সী মানুষের জটলা সমুদ্র সৈকতের বৈকালিক সৌন্দযর্কে মোহনীয় করে তুলেছে। প্রতিদিন এই সময়টাতেই রবিন সমুদ্র সৈকতে আসে। তবে সূর্যাস্ত উপভোগ করতে নয়, সে আসে পরিচিত মানুষের খোঁজে। চুপচাপ বসে থাকে আর চারপাশের মানুষদের ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করে। যদি কোনো পরিচিত মানুষের দেখা পাওয়া যায়। ‘কদ্দিন এলাকার মানুষের সঙ্গে দেখা হয় না’- আপন মনে বলে রবিন।
অস্তমিত সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রবিনের শৈশবের কথা মনে পড়ে। তাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদী আর ওপারে সুন্দরবন। এমন অনেক বিকাল নদীপাড়ের বেড়িবাঁধে দুই ভাই আর বন্ধুদের সঙ্গে কাটিয়েছে। দুই ভাই আর মা’র কথা খুব মনে পড়ে রবিনের। পরিচিত কাউকে পাওয়া গেলে এলাকার খোঁজ খবর নেওয়া যেত। কিন্ত চাইলেই তো সহজে কারও দেখা মেলে না। সুন্দরবন এলাকার ছোট একটি গ্রাম থেকে আজ সে দেশের অন্য প্রান্তে- পর্যটন নগরী কক্সবাজারে।
কক্সবাজারে রবিন এসেছে তাও প্রায় আট বছর হবে। বলা যায় জীবিকার প্রয়োজনে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল পনেরো বছরের রবিন। রবিনের বয়স যখন ছয় বছর তখন থেকেই তার বাবা নিখোঁজ। তার ছোট দুই ভাইয়ের একজনের বয়স তখন চার বছর আরেকজনের দুই। মহাজনের নৌকায় সুন্দরবনে কাঠ, গোলপাতা, মধু সংগ্রহে যেত তার বাবা। এক যাত্রায় পনের থেকে বিশ দিন থাকতো। তারপর একদিন মহাজনের নৌকার অন্যান্য শ্রমজীবীরা ফিরে আসলেও রবিন এর বাবা ফিরে আসেনি। রবিন আর তার মাকে মহাজন বলেছিল ‘গাঙে মাছ ধরতে গিয়ে কামট (হাঙ্গর), কুমিরে নিয়ে গেছে রবিনের বাপকে।’
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির এভাবে হঠাৎ হারিয়ে যাওয়ার কোনো ব্যাখ্যা কারও কাছে চাইতে পারেনি তারা। কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণও কারও কাছ থেকে পায়নি। সেই থেকে বেঁচে থাকার কঠিন সংগ্রাম এই পরিবারটির সঙ্গে মিতালী পাতিয়েছে। আর সেটা আরও দীর্ঘায়িত হয়েছে ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলার পর থেকে। ঘূর্ণিঝড়ে বসতঘর, গাছগাছালি, সম্পদ- সব হারিয়ে বেড়িবাঁধের উপর আশ্রয় নেয় রবিনের পরিবার। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ত্রাণের সহায়তায় কিছুদিন কেটে যায়। কিন্তু একপর্যায়ে তাও কমতে থাকে। ‘এরাম্ভায় (এভাবে) বাঁইচে থাকা কষ্টের’- রবিন আর তার মা ও ভাইদের এই উপলদ্ধি এক সময় রবিনকে কাজের খোঁজে এলাকার বাইরে যেতে বাধ্য করে।
রবিনের প্রতিবেশীদের মধ্যে কয়েকজন কক্সবাজারের চিংড়ির পোনা উৎপাদনের হ্যাচারিতে কাজ করতো। তাদের সাথেই রবিন একদিন কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা দেয়। কোনোভাবে টিকে থাকার মতো একটি কাজও জুটিয়ে নেয়। তারও বছর দুয়েক পর মোটামুটি একটা বেতনের চাকরিও পায়। মাস শেষে মা-ভাইদের কাছে সামান্য কিছু অর্থ পাঠাতে পারে। তবে বসত ঘর এখনও পুরোপুরি ঠিক করা যায়নি। ভিটার অনেকটা আইলার পানিতে ভেঙে গেছে। নতুন করে ভিটা উঁচু করে তার ওপর ঘর বানানোর খরচও তো অনেক। আশায় থাকে রবিনের আয়ের অর্থ দিয়ে আবার নতুন ঘর উঠবে।
কর্মস্থলে রবিনের কাজের সুনাম আছে। তবে এই অবস্থা একদিনে তৈরি হয়নি। নতুন জায়গায় পরিচিত মানুষ না থাকায় কক্সবাজারের প্রথম দিনগুলোতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তাকে। পেশাজীবনের শুরুর সেই দিনগুলোতে একজনই তার পাশে থেকে সাহস জুগিয়েছে- বন্ধু হাসান। তার থেকে বয়সে কিছুটা বড় হাসানও তার মতো ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সন্তান।
হাসানদের বসবাস ছিল চট্টগ্রামের কুতুবদিয়া দ্বীপে। ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ে ভিটেমাটি সব হারিয়ে দ্বীপের আরও অনেকের মতো হাসানের পরিবারও মূল ভূখণ্ডে চলে আসে। সৈকত সংলগ্ন পাহাড়ি গ্রামে বসবাস শুরু করে। হাসানের অবশ্য এসব স্মৃতি মনে নেই। ঘূর্ণিঝড়ের সময় তার বয়স ছিলো মাত্র দুবছর। ‘আব্বা-আম্মার কাছে শুনেছি কুতুবদিয়ায় আমাদের বাড়িতে ঘর, পুকুর, গাছ-গাছালি, কৃষি জমি সব ছিল। আমরা স্বচ্ছল ছিলাম। ঘূর্ণিঝড় আমাদের সব কেড়ে নিয়েছে। সমুদ্রের পানিতে ভিটামাটিও গেছে। সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর আত্মীয়-স্বজনের সাথে আব্বা-আম্মা আমাদের নিয়ে এখানে চলে আসে’- একমনে বলে যায় হাসান।
রবিনের দুই ভাই তাদের মাকে ছেড়ে শহর বা অন্য কোথাও কাজের জন্য যেতে পারে না। তাদের মা আলেয়া বানু ইউনিয়ন পরিষদ থেকে খাদ্য সহযোগিতা পায়। রবিনের পাঠানো টাকা আর দুই ভাইয়ের দিনমজুরির উপার্জনে কোনো রকমে সংসারটা চলছে। রবিন তার প্রতিষ্ঠানে অন্যান্য কর্মচারীদের সঙ্গে থাকার একটা ব্যবস্থা করে নিয়েছে। এর জন্য তাকে আলাদা কোনো অর্থ খরচ করতে হয় না। কিন্তু মা আর ভাইদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় তার রাতগুলো নির্ঘুম কাটে। নদীতে জোয়ারের পানি বাড়লে তার দুশ্চিন্তাও বাড়তে থাকে। বুঝতে চেষ্টা করে জোয়ারের পানি বেড়িবাঁধ ছুঁয়েছে কিনা। মোবাইল ফোনে মা-ভাইদের খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করে। ‘আম্মু বাড়ির অবস্তা কিরাম? কোনো সমস্যা হুচ্ছে না তো?’- রবিনের এমন প্রশ্নে আলেয়া বানু ছেলের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চেহারাটা বোঝার চেষ্টা করে। কষ্ট চেপে ছেলেকে বলে, ‘আমাগো চিন্তা কুরো না বাপ। আমরা ভালো আছি। নিজির দিকি খেয়াল রাখো।’মায়ের কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হয় রবিন।
রবিনের এই একঘেঁয়ে নিসঙ্গ জীবনে ছুটির দিনগুলো কিছুটা প্রশান্তি বয়ে আনে। বন্ধু হাসানের সঙ্গে তাদের বাড়িতেই ছুটির দিনগুলো কাটায়। হাসানের আব্বা-আম্মাও রবিনকে খুব পছন্দ করে। দেশের আরেক প্রান্তে থাকা মা-ভাইদের জন্য মনে জমে থাকা কষ্ট কিছু সময়ের জন্য লাঘব হয়। এমন এক ছুটির দিনে রবিন জানতে পারে বনভূমির জায়গায় অবৈধ বসবাসের কারণে হাসানের পরিবার ও তাদের প্রতিবেশীদের এই এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে হাসানের পরিবার যে খুব দুশ্চিন্তায় আছে তেমনটা মনে হয় না। রবিনের কৌতুহলের বিষয়টি হাসানের নজর এড়ায় না। হাসান বলে, ‘আমরা এসবে অভ্যস্ত। এ জায়গা ছেড়ে আমরা কোথায় যাব? ঘূর্ণিঝড়ে আমরা সব হারিয়েছি। বসবাসের মতো নিজেদের কোনো জায়গা নেই। এখানে তাও কিছু রোজগারের ব্যবস্থা আছে। একবার এখান থেকে চলে গেলে আমাদের বেঁচে থাকার পথগুলোও হারিয়ে যাবে।’হাসানের বাবা মামুন খান এই আলোচনায় যোগ দেন। বলেন, ‘একটি সুন্দর জীবনের জন্য উপযুক্ত বাসস্থান খুঁজে পাওয়া আমাদের সারাজীবনের স্বপ্ন। এখানে বসবাসের জন্য যে কতজনকে অর্থ দিতে হয় তা তোমারা ধারণাও করতে পারবে না।’
মামুন খানের সঙ্গে একটি পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলার ইচ্ছা রবিনের অনেকদিনের। কিন্ত বলি বলি করেও বলা হয় না। রাতের খাবারের পর রবিন সাহস করে তার পরিকল্পনা প্রকাশ করে। প্রতি মাসের বেতন থেকে একটু একটু করে টাকা জমিয়েছে রবিন। এই অর্থ দিয়েই সে হাসানদের মতো একটি জায়গার বন্দোবস্ত নিতে চায়। যেখানে ঘর তুলে সে তার মা ও দুই ভাইকে নিয়ে বসবাস করবে। মামুন খান রবিনের এই পরিকল্পনায় কোনো আগ্রহ দেখান না। বরং রবিনকে তার এলাকায় গিয়ে তার পরিবারের জন্য ভালো কিছু করার পরামর্শ দেন। ‘পারিবারের বন্ধন দুঃসময় কাটানোর জন্য বড় শক্তি এবং তোমার কঠিন দিনগুলোতে একমাত্র পরিবারের মানুষেরাই তোমার পাশে থাকবে। তাছাড়া তুমি তোমার এলাকা এবং এলাকার মানুষের সঙ্গে অনেক বেশি পরিচিত। এটাও তোমার ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য খুব প্রয়োজন’ রবিনের উৎসাহী মুখের দিকে তাকিয়ে একনাগাড়ে বলে যান মামুন খান।
সে রাতে জীবন সংগ্রামের নানা কাহিনী বর্ণনার আসর দুই নবীন আর এক প্রবীণের আলোচনায় যেন শেষ হতে চায় না। চাঁদের আলোয় পাহাড়ের বনে মায়াবী পরিবেশ। আহ! কতদিন চাঁদের আলোয় বেড়িবাঁধ, নদী আর ওপারে সুন্দরবন দেখা হয়নি। রবিন তার মা-ভাইদের কাছে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেখানেই সে তৈরি করবে নতুন বাসস্থান। জীবিকার জন্য ছোট দুই ভাইকে নিয়ে ছোট একটি ব্যবসা শুরু করবে। অনেক দিন পর দুশ্চিন্তামুক্ত রাত কাটায় রবিন। নতুন জীবনের স্বপ্ন নিয়ে একটানা ঘুম হয় তার। খুব সকালে মোবাইল ফোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙে। মোবাইল ফোনে তার ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পারে জোয়ারের পানির চাপে বেড়িবাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়েছে। রবিনের ঠিক আট বছর আগের কথা মনে পড়ে। ঘূর্ণিঝড় আইলায় সব হারিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে এসেছিল সে। কিন্তু এবার সে ভীত নয়। নতুন সংগ্রামের প্রত্যয় নিয়ে এলাকার উদ্দেশে রওয়ানা হয় রবিন। এবারের লড়াইয়েও যে জিততে হবে।
লেখক: উন্নয়নকর্মী ও গবেষক