সারাদেশে অধিক তাপমাত্রার কারণ কী?
২৬ এপ্রিল ২০২২ ১৮:১৫
সারাদেশে দেখা দিয়েছে অতিরিক্ত তাপমাত্রা। যা বর্তমানে দিন-দিন বেড়েই চলেছে। যার ফলে মানুষের জীবন যাপন দূর্বিষহ হয়ে পড়েছে ।পরিবেশ প্রকৃতিতে দেখা দিয়েছে বিরুপ প্রভাব। বৈশাখ মাসের শুরুর দিক থেকেই ধীরে ধীরে বেড়েছে তাপমাত্রা। শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বের সব জায়গাতেই বৃদ্ধি পাচ্ছে গড় তাপমাত্রা। তাপমাত্রা বাড়ার বিরূপ প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবনে, প্রকৃতিতে, জীব ও উদ্ভিদ জগতে। কিন্তু কেন বাড়ছে তাপমাত্রা? এমন প্রশ্নই এখন বিশ্ব-সমস্যা বা ‘গ্লোবাল ইস্যু’র মূল এজেন্ডা হিসাবে চিহ্নিত হচ্ছে।
সাধারণ মানুষের মতো বিজ্ঞানীরাও তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ে চিন্তিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’য় গডার্ড ইনস্টিটিউট নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা তাপ বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধান করেন।তাদের গবেষণায় জানা গেছে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রতিবছর তার পূর্ববর্তী বছরের রেকর্ড ভেঙে বেড়েই চলেছে। ১৮৮০ সালে তাপমাত্রা সংরক্ষণের আধুনিক পদ্ধতি আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে দেখা গেছে যে, প্রতি বছরই কিছু না কিছু মাত্রায় তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশেষ করে, ২০০০ সালের পর থেকে প্রতিবছরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার চরমভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি ‘গভীর আশঙ্কাজনক’ বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। ১৯৯২ সাল থেকে ২০১৪ সাল সময়কালে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৩ ইঞ্চি পর্যন্ত বেড়েছে।টিম ফলগার নামে এক বিজ্ঞানী ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক’ জার্নালে প্রকাশিত এক লেখায় নিজের গবেষণার ভিত্তিতে মন্তব্য করেছেন যে, ‘আমাদের ধারণার চেয়েও অধিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। ’ শুধু তাই নয়, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে অ্যান্টার্কটিকা ও গ্রিনল্যান্ডের মতো শীতল অঞ্চলের বরফ দ্রুতলয়ে গলছে। যা আমাদের জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে হুমকি স্বরুপ।
একদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং অন্য দিকে বরফ গলে যাওয়ার দ্বৈত চাপ পুরো পৃথিবীর ওপর পড়ছে এই তাপ বৃদ্ধির কারণে, যা মোকাবেলা করা মানুষ ও প্রকৃতির জন্য সত্যিই কঠিন।
শিল্পবিপ্লবের পর থেকে নানা রকমের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কারণে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ধরা হয়েছিল শীর্ষবিন্দু। সেই মাপকাঠি বেশ আগেই অতিক্রান্ত হয়েছে। এখন আশঙ্কা করা হচ্ছে, অতি- যান্ত্রিকীকরণের কুপ্রভাবে এবং পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য বিনষ্টের কারণে চলতি একুশ শতকেই বৈশ্বিক তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করবে।
পরিবেশবাদী, বিজ্ঞানী ও গবেষকরা তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়টি স্বাভাবিক ভাবে দেখছেন না। এভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি থাকলে নানা রকমের সমস্যার সৃষ্টি হবে। যেমন-
১. তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার এ ভাবে চলতে থাকলে তার প্রভাব মোকাবেলা করা মানুষের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। প্রকৃতি ও পরিবেশের তাপ বৃদ্ধির ভয়ানক প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে। সৃষ্টি হবে চরম তাবদাহ।
২.বৈশ্বিক উৎপাদন ও খাদ্য মজুত কমে যাবে। প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখে পড়বে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গলতে থাকবে মেরু অঞ্চলের জমাট বরফ। এতে অনেক দ্বীপ ও উপকূলীয় অঞ্চল তলিয়ে যাবে।
৩.অনেক অঞ্চলে অনাবৃষ্টি ও তাপদাহের কারণে মরুভূমিতে পরিণত হবে। মানুষের জীবনযাপন হয়ে পড়বে চরম দুর্বিষহ।
৪.তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত চরম পরিস্থিতির ফলে অস্থির ও উষ্ণ পৃথিবীতে মানুষ, উদ্ভিদ ও জীবের বসবাস করাটাই কঠিন ও কষ্টকর হয়ে যাবে।
কারণ, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করলে জলবায়ুর অভিযোজন সম্ভব হবে না। মানুষ ও প্রাণসমূহ চরম প্রাকৃতিক বৈরিতার মুখে স্বাভাবিক অভিযোজনের ধারা থেকে বিরূপ পরিস্থিতিতে ছিটকে পড়বে। যা থেকে উদ্ধার পেয়ে প্রাণধারণ করা প্রচণ্ড কষ্টকর ও চ্যালেঞ্জিং হবে মানুষের জন্য।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে সম্পাদিত প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে বলা হয়েছিল, বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। কোনোভাবেই যেন পৃথিবীর তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম না করে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এরও আগে ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত ‘কিয়োটো প্রটোকল’-এ বৈশ্বিক তাপমাত্রা সীমিত রাখার অঙ্গীকার করা হয়।
তবে কার্যক্ষেত্রে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর পক্ষ থেকে যথাযথ সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি। যার ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব আরও বেড়েছে। যেমন-
১.উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনকে মানুষ ও প্রকৃতির চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে অবাধে জ্বালানি পোড়াচ্ছে। যা তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারন।
২.নতুন নতুন কল-কারখানা তৈরি হচ্ছে পরিবেশগত প্রতিক্রিয়ার কথা না ভেবেই। এ কল-কারখানায় দূষিত ধোয়া বায়ুমন্ডলের সাথে মিশে প্রকৃতিতে বিরুপ আবহাওয়ার সৃষ্টি করছে। ওজন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যার ফলে খুব সহজেই সূর্যের অতি ক্ষতিকারক রশ্মির প্রভাব পৃথিবীতে এসে পড়ছে।
৩. বর্তমান বিশ্বে যান্ত্রিকীকরণের মাত্রা ও হার এতোটাই প্রবল হয়েছে যে, বায়ু ও পরিবেশ দূষণ দেখেও পাল্লা দিয়ে চলছে পুরো পৃথিবীকে অগ্নিগর্ভ ও উত্তপ্ত করার চেষ্ঠা। যার ফলপ্রসূত বর্তমান সময়ের অতি তাপদাহ।
৪.সাড়া বিশ্বের অনেক দেশে অতিমাত্রায় গাছ-পালা কর্তনের প্রভাব দেখা দিয়েছে। যা পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরুপ। তাছাড়া নদী-নালা ভরাটের মতো কাজও অবাধে চলছে প্রবৃদ্ধি অর্জনের তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে। যা আমাদের বেঁচে থাকার পথ কে আরও কঠিন করে তুলছে।
উন্নতি, অগ্রগতি ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাতাল লড়াই থামানো না গেলে এবং পরিবেশ-বান্ধব নীতি ও কর্মসূচি গৃহীত না হলে অচিরেই এ পৃথিবী অসহনীয় অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হবে বলে আশঙ্কা করা যায়। পরিবেশমুখী মনোভাব ও জীবনমুখী বোধদ্বয় ছাড়া পৃথিবীর তাপমাত্রা সহনীয় স্তরে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।
সুতরাং আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং অপরকে সচেতন করতে হবে। পরিবেশ ও বায়ুমন্ডল ক্ষতিগ্রস্থ হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রনের লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। সুপরিকল্পিত বনায়নের মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষকে তাপমাত্রা থেকে রক্ষা করার নিরাপদ বেষ্টনি তৈরি করতে হবে। তবেই রক্ষা পাবে আমাদেশ ভূমন্ডল।
লেখক: শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি