ড. হাছান মাহমুদ: দলে-সরকারে অবিরাম পথচলা
১৩ আগস্ট ২০২২ ১৩:২২
বিএনপিসহ বিরোধীদলের কোনো বক্তব্যই বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দিচ্ছেন না তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। শব্দ-বাক্য মিলিয়ে চড়া-কড়া জবাব দিচ্ছেন তাদের প্রতিটি বক্তব্যেরই। তাও কালবিলম্ব না করে। দ্রততম সময়ে জবাবসহ কথার পিঠে কথা বলতে একটুও ছাড়ছেন না। নিজস্ব একটি স্টাইলে ‘টিট ফর টেট’ বক্তব্যের কারণে বিরোধীদলের কাছে হাছান মাহমুদ অনেকটাই জাতশত্রুর মতো।
মন্ত্রীত্বের বাইরে ড. হাছান মাহমুদ আওয়ামী লীগের একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। দলে প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এবং আস্থাভাজন। আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সামনে রেখে আবারও ভিন্ন মাত্রায় আলোচিত হাছান মাহমুদ। শেষ পর্যন্ত বাস্তবে কী হবে, তা পরের বিষয়। তবে, সম্ভাব্য সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তার নাম আবারো আলোচিত। এর আগে-পিছে অনেক কারণও রয়েছে।
হাছান মাহমুদের রাজনীতিতে উত্থান এবং বিকাশ অত্যন্ত চমকপ্রদ। তৃণমূল থেকে উঠে আসা যাকে বলে। স্কুল ও কলেজ জীবন থেকেই ঘনিষ্টভাবে যুক্ত হন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। ১৯৬৩ সালের ৫ মে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া হাছানের ছাত্রলীগের রাজনীতি শুরু জামালখান ওয়ার্ড শাখা দিয়ে। এরপর হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগসহ নানা পথপরিক্রমায় আওয়ামী লীগে অভিযাত্রা তার।
১৯৯২ সালের শুরুর দিকে তিনি চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী সংসদের সবচেয়ে নবীনতম সদস্য মনোনীত হন। ১৯৯২ সালে তিনি উচ্চতর শিক্ষার জন্য চলে যান বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে। সেখানে ১৯৯৩ সালে হাছান মাহমুদ ব্রাসেলসে বাংলাদেশ ছাত্র সংসদের সভাপতি নির্বাচিত হন। ইউরোপের একটি শীর্ষ র্যাংকিংয়ের ইউনিভার্সিটিতে ব্রাসেলসের ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ১৯৯৪ সালে তিনি নির্বাচিত হন ‘ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন অব দ্য ইউনিভার্সিটি’র সভাপতি, যা ৬০ টি দেশের ১৫০০ শিক্ষার্থীর প্রতিনিধিত্ব করে।
শিক্ষা ও কর্মজীবনে নানা বাঁক পার হওয়া হাছান মাহমুদ ছাত্রজীবনে ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগ তথা দেশসেরা বিতার্কিক। আন্তঃবিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় দলের নেতা হিসেবে ছিলেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে সমাদৃত।
১৯৮৭ সালে জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় পালন করেছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক দলের দলনেতার দায়িত্ব। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যামেস্ট্রিতে অনার্স-মাস্টার্স শেষে উচ্চশিক্ষা নিতে চলে যান বিদেশে। বেলজিয়ামের লিম্বুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবেশ বিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্ৰী লাভ করেন। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা ইন হিউম্যান ইকোলজি করেছেন ব্রিজ ইউনিভার্সিটি অব ব্রাসেলস থেকে ।
বেলজিয়ামে অবস্থানকালে সেখানকার আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সালের মার্চ পর্যন্ত বেলজিয়াম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ড. হাছান মাহমুদ চমক দেখান চট্টগ্রাম-৬ আসনে বিএনপির হেভিওয়েট নেতা সালাহউদ্দীন কাদের চৌধুরীকে বিপুল ভোটে হারিয়ে। এরপর সরকার গঠন করে তাকে প্রথমে ২০০৯ সালের ৮ জানুয়ারি থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী করেন শেখ হাসিনা। একই বছরের ১ আগস্ট থেকে ২০১১ সালের ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী এবং পরবর্তীতে একই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
ড. হাছান মাহমুদকে যখন যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেখানেই তিনি সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন। ২০১৪ সালে তাকে মন্ত্রী করা হয়নি। তাতে তিনি দমেননি, অনিয়মিত হননি। দলের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন একনিষ্ঠতার সঙ্গে। কঠোর ভাষায় নিয়মিত বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের সকল কথা ও অভিযোগের উচিৎ জবাব দিয়েছেন নিয়মিত। যা তাকে দিয়েছে আরেক উচ্চতা ও পরিচিতি। বানিয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগের বিশেষ মুখপাত্র। দলের দুর্দিনে তার কণ্ঠ ছিল তেজোদীপ্ত। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জেতার পর আরেক বাঁকে পৌঁছায় তার রাজনীতি। দেওয়া হয় তথ্য মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুদায়িত্ব। দলেও দেওয়া হয় আরো গুরুত্বপূর্ণ পদ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। দলের নেতা এবং গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী দুই দায়িত্ব মিলিয়ে ক্রমশ সাফল্যের কারণে তার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার আলোচনা ও গুঞ্জনের ডালপালা বিস্তার ঘটছে নানা মাত্রায়।
বিদেশে বর্নাঢ্য জীবনের ইতি টেনে ড. হাছান মাহমুদের দেশে ফেরা আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর নির্দেশে। দেশে ফেরার পর তাকে দেয়া হয় আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব। সেইসঙ্গে কাজ করেন শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী কর্মকর্তা হিসেবে। ওয়ান-ইলেভেনের সময় হাছান মাহমুদ কাজ করেছেন অনেকের অজান্তে-নিভৃতে। এগিয়ে গেছেন নীরবে ও গোপনীয়তায়।
সেই সময়ে সংস্কারপন্থীদের শেখ হাসিনাকে মাইনাস চেষ্টার বিপরীতে তার হাই-ভোল্টেজ এসাইনমেন্ট এর কাজ করার খবর দলের অনেকের ধারনায়ও ছিল না। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীসহ দেশ-বিদেশের যোগাযোগগুলো তিনি করেছেন দক্ষতার পাশাপাশি ভীষণ গোপনীয়তায়। ওয়ান ইলেভেনের হোতা ও কুশীলবরা তা চিন্তাও করতে পারেননি। শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার এবং তার বিরুদ্ধে দেয়া মিথ্যা মামলার ওই কঠিন সময়ে সতর্কতার সঙ্গে এ কাজ চালিয়ে যাওয়া ছিল কঠিনের চেয়েও কঠিন। জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণও। দলের অনেকে তা জেনেছেন অনেক পরে।
ওয়ান-ইলেভেনের মধ্যেই কারামুক্ত হয়ে শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্র সফরে হাছান মাহমুদকে সফরসঙ্গী করার প্রেক্ষাপটে তা একটু একটু আঁচ করেন অনেকে। দেশে ফিরে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার কাজেও ধারনার চেয়ে বেশি ভূমিকা হাছান মাহমুদের। সেটাও ছিল নিঃশব্দে এক্সক্লুসিভ পর্যায়ে। তিনি ওইসব কাজের গোপনীয়তা রক্ষা করেছেন। তার সেই গোপনীয়তা, বিশ্বস্ততা ও দক্ষতার ধারাবাহিকতা আজও অটুট-বিদ্যমান।
ড. হাছান মাহমুদের নেতৃত্বেই তথ্য মন্ত্রণালয়ের ভাণ্ডারে যোগ হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অনেক অর্জন। তারপর গত বছর তথ্য মন্ত্রণালয়ের নাম পাল্টে হয়েছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। স্বাধীনতার পর তথ্য মন্ত্রণালয়ের এ নামই ছিল। আগের নামে ফিরিয়ে আনাসহ তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাজের ভলিউম অনেক বেড়েছে। সেইসঙ্গে বেড়েছে চ্যালেঞ্জও। সংবাদপত্র, টেলিভিশন, বেতার, চলচ্চিত্র তথা তথ্য মন্ত্রণালয় এবং আওতাধীন দপ্তর-সংস্থার দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাসহ কর্মযজ্ঞও বেড়েছে এ মন্ত্রণালয়টির। পরিশ্রম ও দক্ষতায় এ চ্যালেঞ্জে প্রতিনিয়ত এগিয়ে নিচ্ছেন তথ্যমন্ত্রী ও সম্প্রচার মন্ত্রী। সংবাদ, সাংবাদিক তথা সাংবাদিকদের সুরক্ষা ও মান বাড়ানোর চেষ্টা চলছে নিরন্তর। গত কয়েক বছর ধরে সংবাদকর্মীদের ওয়ার্কশপ-প্রশিক্ষণের মাত্রা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে বিদেশি শিল্পীর অংশগ্রহণ ও বাংলাদেশের শিল্পীদের বিদেশে শ্যুটিংয়ে যাওয়ার অনুমোদন ছাড়াও মাইলফলকের কাজ হয়েছে তার হাত দিয়ে।
রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং মেধার অপূর্ব সমন্বয়ে হাছান মাহমুদ আন্তর্জাতিক জলবায়ু বিশেষজ্ঞ হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে ভূমিকার জন্য ৫ অক্টোবর ২০১৫ সালে ‘গ্রিন ক্রস ইন্টারন্যাশনাল’ সাধারণ অধিবেশনে হাসান মাহমুদকে ‘সার্টিফিকেট অব অনারেবল মেনশনে’ ভূষিত করে। ঢাকা-জাহাঙ্গীরনগরসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে পরিবেশ বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে সমাদৃত ড. হাছান মাহমুদ। কেবল বিরোধীদলের কাছে নয়, নিজ দলের কাছেও তার এ এগিয়ে চলা ঈর্ষনীয়। আবার কারো কারো কাছে অনুকরনীয়ও।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও সদস্য, বাংলাদেশ জ্ঞান সৃজনশীল প্রকাশক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
ড. হাছান মাহমুদ: দলে-সরকারে অবিরাম পথচলা মুক্তমত মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার