Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গ্রেনেড হামলার ভয়ংকর স্মৃতি

রহমান মুস্তাফিজ
২১ আগস্ট ২০২৩ ১৪:০৫

২০০৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে দীর্ঘদিন চ্যানেল আই’তে নির্দিষ্ট কেউ চিফ রিপোর্টার ছিলেন না। পালা করে আমরা তিনজন দায়িত্ব পালন করতাম। হিসেবটা ছিল এমন… সপ্তাহে দু’দিন করে রুহুল আমিন রুশদ (বর্তমানে বাংলাভিশনের সিনিয়র নিউজ এডিটর), সন্তোষ মণ্ডল (প্রয়াত) ও আমি দায়িত্ব পালন করতাম। বাকি একদিন একেকজন পালন করতাম। রুহুল আমিন রুশদ বিএনপি বিট আর সন্তোষ মণ্ডল ক্রাইম বিট করতেন। আমি তখন জেনারেল পলিটিক্স (প্রতিদিন বিভিন্ন দলের নেতাদের সাক্ষাতকার নিয়ে ট্যুইস্ট নিউজ করতাম) এবং স্বাস্থ্য, বন ও পরিবেশ, নারী-শিশু বিট করি। ডে ইভেন্ট কম করতাম বলে অধিকাংশ সময় আমার ভাগেই পড়তো বাড়তি একদিনের দায়িত্বটা।

বিজ্ঞাপন

মনে আছে, ২০ আগস্ট পরের দিনের অ্যাসাইনমেন্ট শিট আমি তৈরি করেছিলাম। আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশের অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিলাম আশরাফুল আলম খোকনকে (পরে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের উপ-প্রেস সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন) ও ক্যামেরাম্যান আলীকে (বর্তমানে ইটিভিতে কর্মরত)। আমি তখনও মাঠে কাজ করি। সিনিয়ররা নাইট ডিউটিতে যেতেন না। তবে আমি দিনের পাশাপাশি নাইট ডিউটিও করতাম। তাতে দিনে একজন বাড়তি রিপোর্টার পাওয়া যেত। ২০ আগস্ট রাতেও ছিলাম। সকালে ৯টার দিকে বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে পড়লাম। উঠলাম বিকেল ৪টার দিকে। রেডি হয়ে সোজা অঁলিয়স ফ্রাঁসেস-এ। ক্যাফেতে খাবারের কথা বললাম। সকাল-দুপুর-বিকেলের খাবার একসাথে খাবো বলে একটু লম্বা হলো তালিকা।

বিজ্ঞাপন

খাবার টেবিলে আসার আগেই ইন্টার্ন রিপোর্টার মারুফ পারভেজ (এখন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী) ফোন করলেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানালেন গ্রেনেড হামলার কথা। জানালেন, খোকনের আহত হওয়ার কথা। খাবার মাথায় উঠলো। কাউন্টারে এসে জানালাম খাবার না দিতে। তখন কাউন্টারের সামনে একটা উঁচু টুলে বসা ছিলেন বরেণ্য প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা কাউসার চৌধুরী। তাকে জানালাম গ্রেনেড হামলার কথা।

সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিলাম, এখন অফিসে যাবো না। তাই একটা রিকশা নিয়ে সোজা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পথ ধরলাম। পথে টেলিফোনে কথা বললাম প্রধান বার্তা সম্পাদক শাহ আলমগীর (প্রয়াত) ভাইয়ের সাথে। জানালাম মেডিকেলে যাওয়ার কথা। আলমগীর ভাই জানালেন, ওখানে কয়েকটি টিম আছে। টিমগুলোকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানোর পরামর্শ দিলেন। হাসপাতালের গেটেই পেলাম দু’টি টিম। ভিতরে আরেকটি। তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে একটি টিম পাঠালাম ইমার্জেন্সির গাড়ি বারান্দার ছাদে। সেখান থেকে হাসপাতালের বাইরের রাস্তাসহ বেশ বড় একটা জোন কাভার করা যাবে। আরেকটি ক্যামেরাকে ক্লোজ শটের জন্য রাখলাম মেইন গেটে। তৃতীয় ও শেষ ক্যামেরাটাকে পাঠালাম হাসপাতালের ভেতরে। তখনও আহত-নিহতদের আনা হচ্ছে রিকশায়-ভ্যানে করে। চারদিকে হতবিহ্বল ভাব আর আহাজারি।

হাসপাতালের ভিতরে গিয়ে স্তম্ভিত হলাম। এ কি করে সম্ভব? আহতদের দেখে মনে হলো এমন নারকীয় ঘটনা একাত্তরকেও হার মানায়। অনুভব করলাম… রক্ত দরকার, প্রচুর রক্ত। রক্ত দিতে আসছেন অনেকেই। কিন্তু বিশৃঙ্খলা সেখানেও। সবাই সবার আগে রক্ত দিতে চান। এতে রক্ত নেয়ার গতি আরও ধীর হচ্ছে। বিএনপি ঘরানার চিকিৎসক, ইন্টার্ন শিক্ষার্থী আর স্টাফরা না থাকায় পরিস্থিতি সামাল দেয়া কষ্টকর হয়ে উঠেছে। নিহত ও আহতদের হাসপাতালে আনা শুরু হতেই বিএনপি ঘরানার মানুষগুলো যেন কর্পূরের মত উবে গেছেন। মৃত্যুপথযাত্রীদের চিকিৎসার জন্য বিএনপি ঘরানার কোন চিকিৎসককেই হাসপাতালের চৌহদ্দীর মধ্যে দেখা গেল না।

ব্লাড ব্যাংকে শৃঙ্খলা তৈরিতে সচেষ্ট হলাম। তাতে রক্ত সংগ্রহে গতি কিছুটা বাড়ে। মনে হলো এভাবে হবে না। ভিন্ন পথে এগুতে হবে। তাই একটা অ্যাজ লাইভ দিলাম ব্লাড ব্যাংকের সামনে থেকে। অন্যান্য ফুটেজসহ অ্যাজ লাইভের ক্যাসেটটা পাঠিয়ে দিলাম অফিসে। রক্তের জন্য আহ্বানের পাশাপাশি শুধু ঢাকা মেডিকেলের ব্লাড ব্যাংকে যেন সবাই ভিড় না করেন এমন আহ্বান ছিল নিউজটায়। তথ্য ছিল আর কোথায় কোথায় রক্ত দেওয়া যাবে সে বিষয়ে। যা বারবার প্রচার হলো স্পেশাল বুলেটিনে।

গ্রেনেড হামরায় আহতদের সম্পর্কে জানার চেষ্টা চিকিৎসকের কাছে…

গ্রেনেড হামরায় আহতদের সম্পর্কে জানার চেষ্টা চিকিৎসকের কাছে…

৩২ নাম্বার ওয়ার্ডে (ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড) গিয়ে পেলাম অনেককে। পিছনের বারান্দার দিকে যাওয়ার দরজার পাশে একটা খাটে শুয়ে আছেন আদা চাচা করিম। (তিনি আদা শুকিয়ে সাথে রাখতেন। আমরা অ্যাসাইনমেন্টে গেলে সে আদার ভাগ আমরাও পেতাম। আদা বিলি করতে করতে তার নামই হয়ে গিয়েছিল আদা চাচা)। দাড়ি, পাঞ্জাবি রক্তে মাখামাখি। চেনাই যায় না। খাটের পাশে দাঁড়ানো আদা চাচার ছেলে নিজের পরিচয় দিলেন। জানালেন, আদা চাচা মারা গেছেন। সেখানেই পেলাম তিন চারজনের মরদেহ। যাদের পরিচয় পেলাম, তাদের পরিচয় এসএমএস করে জানিয়ে দিলাম আলমগীর ভাইকে।

৩২ নাম্বার ওয়ার্ড থেকে গেলাম অপারেশন থিয়েটারের সামনে। সেখানকার অবস্থা আরও ভয়াবহ। রক্তে ভেসে গেছে পুরো ফ্লোর। ভিতরে ঢুকলাম। এমন সময় পিছন থেকে কেউ একজন নাম ধরে ডাকলেন। দেখলাম, স্পোর্টস রিপোর্টার এহসান মোহাম্মদকে (বর্তমানে একাত্তর টিভিতে)। অনুরোধ করলেন, তার খালাতো বোন (যুব মহিলা লীগ নেত্রী) ভিতরে আছেন কি-না দেখতে। নানাজনের বিচ্ছিন্ন হাত-পা সরিয়ে জায়গা করে ঘুরে ঘুরে দেখলাম। হঠাৎ পা হড়কালো। মাটিতে পড়ে রক্তে মাখামাখি হলাম। খেয়াল করলাম কারো মগজে (ব্রেইন) পা পড়াতেই পিছলে পরেছি। সেখানকার ফুটেজ এবং আরও কয়েকজনের পরিচয় নিয়ে অফিসে এলাম। শাহ আলমগীর ভাই ঢাকা মেডিকেলের সবশেষ অবস্থা নিয়ে রিপোর্ট করতে বললেন।

সে রাতে নাইট ডিউটি ছিল চকোর মালিথার। সেটাই তার জীবনে প্রথম নাইট শিফটের ডিউটি। বেচারা নতুন। প্রথম রাতেই এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি একা সামলাতে পারবেন না। তাই আমিও অফিসে থেকে গেলাম। ক্যামেরাম্যান করিমকেও বললাম ডবল শিফট করতে হবে। রাতে নিউজের জন্য একজন ড্রাইভার থাকেন। তাকে দিলাম চকোরের সাথে। বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে আহতদের খোঁজ নিবে চকোর। রাত ১টার দিকে আমি যখন বের হবো তখনও আলমগীর ভাই অফিসে। জানতে চাইলেন, গাড়ি ছাড়া মুভ করবো কি করে। বললাম, রিকশায়।

গ্রেনেড হামলার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে অ্যাজ লাইভ দিচ্ছেন রহমান মুস্তাফিজ

গ্রেনেড হামলার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে অ্যাজ লাইভ দিচ্ছেন রহমান মুস্তাফিজ

রাতে রিকশায় করে ক্যামেরা নিয়ে ঘুরবো শুনে আলমগীর ভাই অস্বস্তি বোধ করছিলেন। বললাম, টেনশন করবেন না, আজকের রাতে কোন ছিনতাইকারী রাস্তায় থাকবে না। এই বলে আশ্বস্ত করলাম আলমগীর ভাইকে।

বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে গিয়ে পেলাম ভিন্ন চিত্র। সেই রাতেই মহানগর পাঠাগারের পাশে গ্রেনেড ফাটানো হলো, যা বিকেলে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ফাটেনি। নিঃশ্চিহ্ন করা হলো হামলার আরেকটি আলামত।

রাতে গেলাম ধানমণ্ডিতে সুধা সদনে, সেখানকার অবস্থা দেখার জন্যে। সাথে ছিলেন মামুনুর রহমান খান (বর্তমানে আরটিভি’র ডেপুটি হেড অব নিউজ), তারিকুল ইসলাম মাসুম (বর্তমানে চ্যানেল আইয়ের প্ল্যানিং এডিটর) ও মাহবুব মতিন (প্রয়াত)।

সুধা সদনের সামনে তখন ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মারুফা আক্তার পপির নেতৃত্বে কর্মীরা বসে আছেন। খবর এলো, হাওয়া ভবন থেকে শোকবাণী নিয়ে লোক আসবেন। আগেই পৌঁছে গেছেন বিটিভি’র সিনিয়র ক্যামেরাপার্সন (পিএম কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত) জাহিদ ভাই। ছাত্রলীগের কর্মীরা বিটিভি’র ক্যামেরা দেখে উত্তেজিত হলেন। তাদের শান্ত করার চেষ্টা করলাম। বললাম, তিনি সরকারি চাকুরে। পেশায় আমাদের সিনিয়র। আমাদের না মেরে জাহিদ ভাইয়ের গায়ে হাত তোলা যাবে না। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা আমাদের কথা বুঝলেন এবং শুনলেন।

একদিন পর, ২৩ আগস্ট নৃশংস-জঘন্য গ্রেনেড হামলার (আসলে কোন বিশেষণই পুরোটা অর্থ বহন করে না) প্রতিবাদে হরতাল। আমার দায়িত্বে থাকলো ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর ও আশপাশের এলাকার সংবাদ সংগ্রহ করা। সকাল ১০টা দিকে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা সংসদ ভবন থেকে মিছিল নিয়ে এলেন ৩২ নাম্বারে। সেই মিছিলে হামলা হলো। সোহেল তাজ ও আমি আহত হলাম। আহত হওয়ার খবর অফিসে জানালাম। রিপ্লেসমেন্ট এলো না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আরও ঘন্টা চারেক ডিউটি দিলাম। দুপুরের খানিক পর আরেকটি বেশ বড় মিছিল এলো মোহাম্মদ নাসিম ভাইয়ের (প্রয়াত) নেতৃত্বে। সেই মিছিলে আবারও হামলা। এবার হামলা চালালো পুলিশবাহিনী। নাসিম ভাই আর আমি আহত হলাম।

এ দফায় পুলিশের মার খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলাম। শুধু জ্ঞান হারাবার আগে শার্টের ভিতরে কিভাবে যেন বুমটা (মাইক্রোফোন) ঢুকিয়ে ছিলাম। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সহায়তায় ক্যামেরাম্যান ফুয়াদ হোসেন (এখন নাগরিক টিভিতে) আমাকে শমরিতা হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। এর অনেক্ষণ পর এলেন স্পোর্টস রিপোর্টার শামীম ভাই (পরে আরটিভি ও দেশ টিভির বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন)।

গ্রেনেড হামলার সেই সময়ে সংবাদ করাটা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। হাওয়া ভবনের কঠোর নজরদারি ছিল সংবাদের ওপর। কঠিন সত্যগুলো আমরা কৌশলী শব্দের আবরণে জানাতাম দেশবাসীকে। জজ মিয়া নাটকের অসভ্যতাও আমরা উন্মোচিত করেছিলাম চ্যানেল আই সংবাদে।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট খুনীরা হত্যা করেছিল জাতির পিতাকে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে বর্বরতম সেই হত্যাযজ্ঞে খুনীরা পরিবারের সবাইকে হত্যা করতে পারলেও দেশে না থাকায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। তাদের হাত ধরেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ, নতুন প্রাণ ফিরেছে আওয়ামী লীগে। সে কারণেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট পঁচাত্তরের খুনীরাই আবার নারকীয় হামলা চালায়। এই হামলায় তারা হত্যা করতে চেয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্তের উত্তরাধিকার শেখ হাসিনাকে। একই সাথে নেতৃত্বশূণ্য করতে চেয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে।

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় নিহত হয়েছেলিনে ২৪ জন। আহত হন কয়েক’শো মানুষ। আওয়ামীলীগকে রাজনীতি থেকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়ে লাভ হয়নি ষড়যন্ত্রকারীদের। বরং ষড়যন্ত্রকারীরাই দেশের রাজনীতি থেকে বিতাড়িতপ্রায়।

লেখক: প্রধান বার্তা সম্পাদক, সারাবাংলা ডটনেট; লেখক ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা

সারাবাংলা/রমু/এএসজি

গ্রেনেড হামলার ভয়ঙ্কর স্মৃতি টপ নিউজ রহমান মুস্তাফিজ সংবাদ সম্প্রসারণ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর