মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী: এখনো আমাদের অনুপ্রেরণা
১৭ নভেম্বর ২০২৩ ০৯:০৫
বাংলাদেশের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে বেশি গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা আন্দোলন’ বা ‘মুক্তিযুদ্ধ’।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের মূল নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অন্যদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর অবদান অপরিসীম। আফ্রো-এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার মহান নেতা তিনি।
যাকে আমি সারা জীবন অনুসরণ করছি, তিনি মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি যখন মারা যান, তখন আমি শিলমুড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র। তাকে সরাসরি দেখার সুযোগ হয়নি। অথচ তিনি যেন আমার কাছে এখনো জীবন্ত। পঁচাত্তর সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করলে আমাদের স্কুল ছুটি হয়ে যায়। ওই দিন ছিল শুক্রবার হাফ স্কুল। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার প্রতিবাদে মিছিল হলে, আমি এতে অংশগ্রহণ করি।
১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী মারা যান। এবার ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হচ্ছে। এই সংগ্রামী নেতা দেশের নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের মুক্তির জন্য সারা জীবন আন্দোলন, সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদীকণ্ঠ ছিলেন তিনি। বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের আন্দোলনে তার অবদান স্মরণীয়। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছেন।
মওলানা ভাসানী দীর্ঘ কর্মময় জীবনের অধিকাংশ সময়ই টাঙ্গাইলের সন্তোষে কাটিয়েছেন। সেখানে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। এই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৯টি কারিগরি ও সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ‘৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে টাঙ্গাইলের সন্তোষে মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এই মহান নেতা ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার ধানগড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের শুরুতে মক্তবে শিক্ষা গ্রহণ এবং মক্তবেই কিছুকাল শিক্ষকতা করেন। ১৯০৩ সালে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগ দিয়ে খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেন এবং এ সময় ১০ মাস কারা ভোগ করেন। ১৯২৯ সালে আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসানচরে প্রথম কৃষক সম্মেলন করেন। সেই থেকে তার নামের পিছনে ভাসানী শব্দ যুক্ত হয়। ১৯৩১ সালে টাঙ্গাইলের সন্তোষের কাগমারীতে, ১৯৩২ সালে সিরাজগঞ্জের কাওরাখোলায় এবং ১৯৩৩ সালে গাইবান্ধায় বিশাল কৃষক সম্মেলন করেন। ভাষা আন্দোলনে এবং ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী গণআন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ এ মামলার সকল আসামীর নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেন। ১৯৭০ সালের নভেম্বরে উপকূলীয় এলাকায় প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় হলে দুর্গত এলাকায় ত্রাণ কাজে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ভাষণ দিয়ে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান দাবি উত্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলনসহ মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন দেন। ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হন। এ সময় তিনি ভারতে ছিলেন। ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন এবং একই বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক হক কথা পত্রিকা প্রকাশ করেন। মুজিব সরকারের ব্যাংক, বীমা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ নীতি ও ১৯৭২ সালে সংবিধানের প্রতি সমর্থন প্রদান করেন।
বৃটিশ থেকে পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশ। এই তিনটি আমলেই ভাসানীকে কারাবরণ করতে হয়েছে। জীবনের ৩৩টি বছর তিনি কারাগারে কাটিয়েছেন।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার ছিল গভীর আদর্শিক ঐক্য ও রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা। শোষণ ও বঞ্চনাহীন এবং প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন।
আবদুল হামিদ খান ভাসানী যুক্তফ্রন্ট গঠনে প্রধান নেতাদের মধ্যে অন্যতম। দেশের মানুষের কাছে ‘মজলুম জননেতা’ হিসাবে পরিচিত। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। তিনি রাজনৈতিক জীবনের বেশীরভাগ সময় বামপন্থী ধারার রাজনীতির সাথে জড়িয়ে ছিলেন।
‘আফ্রো-এশিয়া-ল্যাটিন আমেরিকার মজলুম জননেতা’ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনিই প্রথম এ দেশ স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। অন্যায় আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে তার ছিল আপসহীন সংগ্রাম। এই সংগ্রাম ছিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে। ছিল পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে। যাবতীয় কালাকানুন, গণতন্ত্রবিরোধী কার্যকলাপ ও জুলুমের বিরুদ্ধে তার কণ্ঠ হয়ে উঠেছিল সোচ্চার। এই বিপ্লবী পুরুষ কোনো স্বৈরশাসককে ক্ষমা করেননি। হাত মেলাননি গদি অথবা অর্থের মোহে পড়ে।
দেশে ভয়াবহ বন্যা হলো পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে। সেই বন্যায় নিহত হয় লাখ লাখ মানুষ। তখন ভাসানী সভা ডেকেছেন টাঙ্গাইল পার্ক ময়দানে।
মওলানার অমোঘ ভাষণ। বৃদ্ধ নেতার কী বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর! প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘ইয়াহিয়া সাহেব! আপনি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে বাঁচান। হাজার হাজার গৃহহারা মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছে; হেলিকপ্টার পাঠিয়ে তাদের উদ্ধার করুন। খাদ্যসামগ্রী পাঠান।’ বক্তৃতার মাঝে মাঝে উচ্চকণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছিল তার ‘খামোশ’ ধ্বনি, যা ছিল সিংহের গর্জনের মতো।
১৯৭০ সালে তিনি বললেন, ‘ভোট নয়, দেশের স্বাধীনতা চাই।’ ‘৭৩ ও ‘৭৪ সালে মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইলের সন্তোষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে জাতীয় পর্যায়ে তিনটি শিক্ষাসংক্রান্ত সম্মেলনের আয়োজন করেন। খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকেরা এতে যোগ দিয়েছিলেন। তার স্বপ্নের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ ও রূপরেখা প্রণয়ন করে ১৯৭৪ সাল থেকে তা বাস্তবায়নের কাজে হাত দেন।
১৮৮০-১৯২৯
মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হাজী শরাফত আলী খান। মক্তব হতে শিক্ষাগ্রহণ করে কিছুদিন মক্তবেই শিক্ষকতা করেন। ১৮৯৭ সালে পীর সৈয়দ নাসীরুদ্দীনের সাথে আসাম যান। ১৯০৩ সালে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ইসালামিক শিক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯০৭-এ দেওবন্দ যান। দুই বছর সেখানে অধ্যয়ন করে আসামে ফিরে আসেন। ১৯১৭ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ময়মনসিংহ সফরে গেলে তার ভাষণ শুনে ভাসানী অনুপ্রাণিত হন। ১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগদান করে খেলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে দশ মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন স্বরাজ্য পার্টি গঠন করলে ভাসানী সেই দল সংগঠিত করার ব্যাপারে ভূমিকা পালন করেন। ১৯২৬-এ আসামে প্রথম কৃষক-প্রজা আন্দোলনের সুত্রপাত ঘটান। ১৯২৯-এ আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন।এখান থেকে তার নাম রাখা হয় ” ভাসানীর মাওলানা “। এরপর থেকে তার নামের শেষে ভাসানী শব্দ যুক্ত হয়।
১৯৩০-১৯৫৯
১৯৩১-এ সন্তোষের কাগমারীতে, ১৯৩২-এ সিরাজগঞ্জের কাওরাখোলায় ও ১৯৩৩-এ গাইবান্ধায় বিশাল কৃষক সম্মেলন করেন। ১৯৩৭-এ মাওলানা ভাসানী কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলীম লীগে যোগদান করেন। সেই সময়ে আসামে ‘লাইন প্রথা’ চালু হলে এই নিপীড়নমূলক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেন। এসময় তিনি ‘আসাম চাষী মজুর সমিতি’ গঠন করেন এবং ধুবরী, গোয়ালপাড়া সহ বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১৯৪০ সালে শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের সঙ্গে মুসলীম লীগের লাহোর সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৪৪ সালে মাওলানা ভাসানী আসাম প্রাদেশিক মুসলীম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪৫-৪৬ সালে আসাম জুড়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে “বাঙ্গাল খেদাও” আন্দোলন শুরু হলে ব্যাপক দাঙ্গা দেখা দেয়। এসময় বাঙালিদের রক্ষার জন্য ভাসানী বারপেটা, গৌহাটি সহ আসামের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়ান। পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ নিয়ে ১৯৪৭ সালে আসামে গ্রেফতার হন। ১৯৪৮-এ মুক্তি পান। এরপর তিনি টাঙ্গাইলের সন্তোষে ফিরে আসেন। ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ ব্যবস্থাপক সভার কার্যাবলি বাংলায় পরিচালনা করার জন্য স্পিকারের কাছে দাবি জানান এবং এই দাবি নিয়ে পীড়াপীড়ি করেন। ১৯ মার্চ বাজেট বক্তৃতায় অংশ নিয়ে বলেন, যেসব কর কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গ প্রদেশ থেকে সংগ্রহ করে তার শতকরা ৭৫% প্রদেশকে দিতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, ব্রিটিশ আমলে বঙ্গপ্রদেশ জুটেক্স ও সেলসট্যাক্স রাজস্ব হিসেবে আদায় করত এবং এই করের ভাগ কেন্দ্রীয় সরকারকে দিতে হতো না। পাকিস্তান সৃষ্টির পর কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গ সরকারের হাত থেকে এই কর ছিনিয়ে নিয়ে নিজেরাই আদায় করতে থাকে যার ফলে পূর্ববঙ্গ সরকার আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই সময় পূর্ববঙ্গ সরকারের বার্ষিক বাজেট ছিল মাত্র ৩৬ কোটি টাকা। যাই হোক, মুসলিম লীগ দলের সদস্য হয়েও সরকারের সমালোচনা করায় মুসলিম লীগের ক্ষমতাসীন সদস্যরা মওলানা ভাসানীর ওপর অখুশী হয় এবং তার নির্বাচনে ত্রুটি ছিল এই অজুহাত দেখিয়ে আদালতে মামলা দায়ের করে এবং মওলানা ভাসানীকে নানাভাবে হয়রানি করতে থাকে। পরিশেষে মওলানা ভাসানী ব্যবস্থাপক সভার সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এতদসত্ত্বেও পূর্ববঙ্গের তৎকালীন গভর্নর এক নির্বাহী আদেশ বলে মওলানা ভাসানীর নির্বাচন বাতিল করেন। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের জনবিরোধী কার্যকলাপের ফলে মওলানা ভাসানী ১৯৪৯ সালের ২৩-২৪ জুন ঢাকার টিকাটুলিতে রোজ গার্ডেনে মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন আহ্বান করেন। ২৩ জুন ওই কর্মিসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সারাদেশ থেকে প্রায় ৩০০ কর্মিসম্মেলনে যোগদান করেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন আতাউর রহমান খান। মওলানা ভাসানী ছিলেন প্রধান অতিথি। ২৩ জুন পূর্ববঙ্গের প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। মওলানা ভাসানী সর্বসম্মতিক্রমে এই দলের সভাপতি নির্বাচিত হলেন। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শামসুল হক। ২৪ জুন আরমানীটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৯ সালের মধ্যভাগে পূর্ববঙ্গে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। ১১ অক্টোবর আরমানীটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় খাদ্য সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতার জন্য পূর্ববঙ্গ মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবি করা হয় এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মওলানা ভাসানী ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দেন। ভূখা মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ১৯৪৯-এর ১৪ অক্টোবর গ্রেফতার হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কারাবরণ করেন।
১৯৫০ সালে সরকার কর্তৃক রাজশাহী কারাগারের খাপরা ওয়ার্ড এর বন্দীদের উপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অনশন ধর্মঘট পালন করেন এবং ১৯৫০ সালের ১০ ডিসেম্বর তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২-র ৩০ জানুয়ারি ঢাকা জেলার বার লাইব্রেরী হলে তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সহযোগিতার কারণে গ্রেফতার হয়ে ১৬ মাস কারানির্যাতনের শিকার হন। অবশ্য জনমতের চাপে ১৯৫৩ সালের ২১ এপ্রিল মওলানা ভাসানীকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৯৫৩ সালের ৩ ডিসেম্বর কৃষক-শ্রমিক পার্টির সভাপতি শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট নামক নির্বাচনী মোর্চা গঠন করেন। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল বিজয় অর্জন করে এবং পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদে ২৩৭টির মধ্য ২২৮টি আসন অর্জনের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ফজলুল হকের নেতৃত্বে সরকার গঠন করার পর ২৫শে মে ১৯৫৪ মাওলানা ভাসানী বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোল্ম যান এবং সেখানে বক্তব্য প্রদান করেন। ৩০ মে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে গভর্ণরের শাসন জারি করে এবং মাওলানা ভাসানীর দেশে প্রত্যাবর্তনের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেন। ১১ মাস লন্ডন, বার্লিন, দিল্লী ও কলকাতায় অবস্থান করার পর তার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হলে ১৯৫৫-র ২৫ এপ্রিল দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। পূর্ব বাংলায় খাদ্যজনিত দুর্ভিক্ষ রোধের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ৫০ কোটি টাকা আদায়ের দাবিতে ১৯৫৬-র ৭ মে ঢাকায় অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। সরকার দাবি মেনে নিলে ২৪ মে অনশন ভঙ্গ করেন। একই বছর ১২ সেপ্টেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ-রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশন সরকার গঠিত হলে মাওলানা ভাসানী সরকারের পররাষ্ট্রনীতির বিরোধিতা করে নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করার জন্য সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করেন।
১৯৫৬তে পাকিস্তান গণপরিষদে যে খসড়া শাসনতন্ত্র বিল পেশ করা হয় তাতে পাকিস্তানকে ইসলামিক রিপাবলিক বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, তখন মাওলানা ভাসানী পল্টনের জনসভায় তার বিরোধিতা করে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছিলেন৷
কাগমারী সম্মেলনে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি আরম্ভ হয়। এই সভায় মওলানা ভাসানীও বক্তৃতা করেন। বক্তৃতায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তিনি বলেন, পূর্ববাংলা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের দ্বারা শোষিত হতে থাকলে পূর্ববঙ্গবাসী তাদের সালামু ওআলায়কুম জানাতে বাধ্য হবে। এছাড়া কাগমারী সম্মেলনে ভাসানী পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী সোহ্রাওয়ার্দী সেই দাবি প্রত্যাখান করলে ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। একই বছর ২৫ জুলাই তার নেতৃত্বে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ (ন্যাপ) গঠিত হয়। ন্যাপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভাসানী প্রকাশ্যে বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং এর পর থেকে সবসময় বাম ধারার রাজনীতিএর সাথেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৫৭-র ৭ অক্টোবর দেশে সামরিক শাসন জারি হলে আইয়ুব খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সকল রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১২ অক্টোবর মাওলানা ভাসানীকে কুমুদিনী হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকায় ৪ বছর ১০ মাস কারারুদ্ধ থাকেন।
১৯৬০-১৯৬৯
বন্দী অবস্থায় ১৯৬২-র ২৬ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত বন্যাদুর্গতদের সাহায্য ও পাটের ন্যায্যমূল্যসহ বিভিন্ন দাবিতে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। ৩ নভেম্বর মুক্তিলাভ করেন এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট-এর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত হন। ১৯৬৩-র মার্চ মাসে আইয়ুব খানের সাথে সাক্ষাত করেন। একই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর চীনের বিপ্লব দিবস-এর উৎসবে যোগদানের জন্য ঢাকা ত্যাগ করেন এবং চীনে সাত সপ্তাহ অবস্থান করেন। ১৯৬৪-র ২৯ ফেব্রুয়ারি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি পুনরুজ্জীবিত করে দলের সভাপতির দ্বায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং একই বছর ২১ জুলাই ‘সম্মিলিত বিরোধী দল’ (কপ) গঠনে ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৭-র ২২ জুন কেন্দ্রীয় সরকার রেডিও ও টেলিভিশন থেকে থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচার বন্ধ করার নির্দেশ জারি করলে এর প্রতিবাদ করেন।
১৯৬৭-র নভেম্বর-এ ন্যাপ দ্বি-খন্ডিত হলে চীনপন্থি ন্যাপের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে মাওলানা ভাসানী বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীদের মুক্তি দাবি করেন। ৮ মার্চ (১৯৬৯) পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে সেখানে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে সাক্ষাত করে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্যে একমত হন। ২৬ শে ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান কর্তৃক আহুত গোলটেবিল বৈঠক প্রত্যাখান করে শ্রমজীবীদের ঘেরাও কর্মসূচী পালনে উৎসাহ প্রদান করেন। আইয়ুব খান সরকারের পতনের পর নির্বাচনের পূর্বে ভোটের আগে ভাত চাই।
১৯৭০-১৯৭৬
১৯৭০ সালের ৬-৮ আগস্ট বন্যা সমস্যা সমাধানের দাবিতে অনশন পালন করেন। অতঃপর সাধারণ নির্বচনে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১২ নভেম্বর (১৯৭০) পূর্ব পাকিস্তানে প্রলয়ঙ্কারী ঘুর্ণিঝড় হলে দুর্গত এলাকায় ত্রান ব্যবস্থায় অংশ নেয়ার জন্য ন্যাপ প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে দাড়ান। ১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’ দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৭১ এর মার্চ মাসে শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলন এর প্রতি সমর্থন প্রদান করেন এবং ১৮ জানুয়ারী ১৯৭১ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের জন্য তার প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত যান এবং মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হন। ২৫ মার্চ রাতে মওলানা ভাসানী সন্তোষে তার গৃহে অবস্থান করছিলেন। তিনি পাকিস্তান বাহিনীর দৃষ্টি এড়িযে টাঙ্গাইল ছেড়ে তার পিতৃভূমি সিরাজগঞ্জে চলে যান। পাকিস্তান বাহিনী তার সনত্দোষের বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়। মওলানা ভাসানী মোজাফ্ফর ন্যাপ নেতা সাইফুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে নৌকাযোগে ভারত সীমানা অভিমুখে রওনা হন। অবশেষে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীর সাহায্যে মওলানা ভাসানী ও সাইফুল ইসলাম ১৫/১৬ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ অতিক্রম করে আসামের ফুলবাড়ী নামক স্থানে উপস্থিত হন। পরে তাদের হলদীগঞ্জ বিএসএফ ক্যাম্পে আশ্রয় দেয়া হয়। এরপর মওলানা ভাসানী ও সাইফুল ইসলামকে প্লেনে করে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং পার্ক স্ট্রিটের কোহিনুর প্যালেসের ৫তলার একটি ফ্ল্যাট তাদের অবস্থানের জন্য দেয়া হয়। ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে মওলানা ভাসানী একটি বিবৃতি প্রদান করেন যা ভারতীয় বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া মওলানা ভাসানী চীনের নেতা মাও সে তুং, চৌ এন লাই এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে তার বার্তা পাঠিয়ে তাদের অবহিত করেন যে পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাপকহারে গণহত্যা চালাচ্ছে। সেজন্য তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে অনুরোধ করেন এই মর্মে যে, তিনি যেন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ না করেন। উপরন্তু মওলানা ভাসানী প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার আহ্বান জানান। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল মওলানা ভাসানী সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের কাছে পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণের ওপর যে বর্বরোচিত অত্যাচার চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন। ৩১ মে মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ দখলদার বাহিনীর সঙ্গে জীবনমরণ সংগ্রামে লিপ্ত। তারা মাতৃভূমি রক্ষার জন্য বদ্ধপরিকর। তারা এই সংগ্রামে জয়লাভ করবেই। ৭ জুন মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের সব অঞ্চল আজ দশ লাখ বাঙালির রক্তে স্নাত এবং এই রক্তস্নানের মধ্য দিয়েই বাংলার স্বাধীনতা আসবে।
এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দু’বার কোহিনুর প্যালেসে এসে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন এবং তার পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রার্থনা করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সর্বদলীয় চরিত্র দেয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে আট সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয় যার সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী। ওই উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন ১) তাজউদ্দীন আহমদ, ২) মণি সিং, ৩) অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, ৪) মনোঞ্জন ধর প্রমুখ। মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ওই উপদেষ্টা কমিটির সভায় এই মর্মে অভিমত ব্যক্ত করা হয় যে, পূর্ববঙ্গের পূর্ণ স্বাধীনতা ব্যতিরেক অন্য কোন প্রকার রাজনৈতিক সমাধান গ্রহণযোগ্য হবে না।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মওলানা ভাসানী কলকাতা ছাড়াও দেরাদুন, দিল্লী ও অন্যান্য স্থানে অবস্থান করেন। পরবর্তীকালে অনেকে অভিযোগ করেন যে ভারতে থাকাকালীন তিনি নজরবন্দি অবস্থায় ছিলেন। ভারতে অবস্থানকালে মওলানা ভাসানী দুইবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন তাকে দিল্লী অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সে ভর্তি করা হয়েছিল। বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭২-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক হক-কথা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীচুক্তির বিরোধিতা করলেও মুজিব সরকারের জাতীয়করণ নীতি এবং ১৯৭২-এর সংবিধানের এর প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। ১৯৭৩ সালে খাদ্যের দাবিতে ঢাকায় ১৫-২২ মে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। ১৯৭৪-এর ৮ এপ্রিল হুকুমতে রাব্বানিয়া সমিতি গঠন করেন। একই বছর জুন মাসে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করলে টাঙ্গাইলের সন্তোষে গৃহবন্দি হন। ১৯৭৬-এর ১৬ মে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ঐতিহাসিক লং মার্চে নেতৃত্ব দেন। একই বছর ২ অক্টোবর খোদাই খিদমতগার নামে নতুন আর একটি সংগঠন গড়ে তোলেন।
মৃত্যু _
১৯৭৬ খৃস্টাব্দের ১৭ই নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই দেশ বরেণ্য নেতা মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে টাঙ্গাইলের সন্তোষে দাফন করা হয়। সারা দেশ থেকে আগত হাজার হাজার মানুষ তাঁর জানাযায় অংশগ্রহণ করে।
সমাজ সংস্কার _
রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সমাজ সংস্কারমূলক কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন। আসামে ৩০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কারিগরী শিক্ষা কলেজ, শিশু কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন সন্তোষে। এছাড়াও তিনি কাগমারিতে মাওলানা মোহাম্মস আলী কলেজ এবং পঞ্চবিবিতে নজরুল ইসলাম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ _
* দেশের সমস্যা ও সমাধান (১৯৬২)
* মাও সে তুং-এর দেশে (১৯৬৩)
মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী আজীবন নিপীড়িত মানুষের মুক্তির সংগ্রাম করে গেছেন। ১৯৭৬ সালের ১৬ই মে তিনি ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চে নেতৃত্ব দেন। এ কর্মসূচিই ছিল তাঁর জীবনের শেষ কর্মসূচি। কেন তিনি এ কর্মসূচি গ্রহণ করতে গেলেন? এ প্রশ্নটি আমার মনে প্রায়ই জাগে। এ প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে পাবার জন্য আমরা কাজ করছি। আমাদের জাতীয় জীবনে ১৯৭৬ সাল এক সংকটপূর্ণ বছর। এ বছরের প্রথম দিকে ভারত উপর্যুপরি সীমান্তহামলা শুরু করে এবং মে মাসের প্রথম দিকে ফারাক্কায় গঙ্গা নদীর পানি এক তরফা প্রত্যাহার করে নেয়। এ সময় দেশবাসীর মনে একদিকে ভারতের আক্রমন ভীতি অপর দিকে ফারাক্কায় গঙ্গা নদীর পানি একতরফা প্রত্যাহার করায় নদীগুলিতে পানি না পাওয়া ভীতি। জাতির এ সংকটময় মূহুর্তে মহান নেতা মওলানা ভাসানী গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। তিনি ফারাক্কা লংমার্চের কর্মসূচি ঘোষণা করলেন। এ কর্মসূচীটি আমাদের জাতীয় জীবনের এক মহাসংকটকালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ কর্মসূচীতে আমি ব্যাক্তিগতভাবে সম্পৃক্ত ছিলাম। আজ থেকে চৌত্রিশ বছর আগে অনুষ্ঠিত এ লংমার্চের কিছু কিছু স্মৃতি আজো আমার মনে রয়েছে। এখানে আমার স্মরণে থাকা দু’ একটি ঘটনা বর্ননা করব।
এ সময়কার আরও একটি বড় ঘটনা ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবার পরিজনকে হত্যা করা। এ হত্যাকান্ডের পরপরই জেলখানায় বন্দি অবস্থায় জাতীয় পর্যায়ের চার নেতাঃ মুক্তিযুদ্ধের মহান বীর তাজুদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম. মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে হত্যা করা হয়। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশ একটি স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠার আগেই সে সময়কার সরকার প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকেসহ এসব রাজনৈতিক হত্যাকান্ড বাংলাদেশকে নেতৃত্ব শুন্য করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছিল। রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকভায় এটা ছিল একটি বড় ধরনের ঘটনা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগেও নক্সালের নামে অসংখ্য বামপন্থী নেতা কর্মিদের হত্যা করা হয়েছে। সেনাবাহিনীতে সাধারণ সৈনিক ও অফিসারের মধ্যকার অসাম্যের কথা তুলে বার বার বিদ্রোহের উস্কানি দেয়া হয়েছে। ফলে মারা গেছে সৈন্য বাহিনীর অনেক অফিসার ও সাধারণ সৈন্য। এতে সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড নষ্ট হয়েছে। একটা সময়ে এটা স্পষ্ট হলো যে, কিছু সংখ্যক দেশীয় চক্রান্তকারী বহিরাগত আগ্রাসনকে আলিঙ্গন করার জন্য এ পরিস্থিতি তৈরী করছে। ঘটনার গভীরতা সাধারণ সৈনিকরা বুঝতে পারলো। সময় ক্ষেপন না করে ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর রাত ৪টায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের কয়েক হাজার সৈন্য ট্যাঙ্ক ও ট্রাকে করে ঢাকা শহরে আগমন করল।
আজ থেকে ছত্রিশ বছর আগে গঙ্গা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার দাবীতে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ফারাক্কা লংমার্চের নেতৃত্ব দেন। রাজশাহী মাদ্রাসা ময়দান থেকে ১৯৭৬ সালের ১৬ই মে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি প্রায় লক্ষাধিক মানুষের এ মিছিলের যাত্রা ঘোষণা করেন এবং ১৭ই মে রাজশাহীর কানসার্ট সীমান্তে গিয়ে এ মিছিল শেষ হয়। রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দানের সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেন, গঙ্গা নদীর ন্যায্য হিস্যা আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে। আমরা শান্তি চাই। কিন্তু তারা যুদ্ধ চায়। বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনতার ভয়ে তারা সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করেছে। আমরা যুদ্ধকে ঘৃণা করি। তিনি আরও বলেন, এ মিছিল বৃহত্শক্তির বিরুদ্ধে মজলুমের সংগ্রামের প্রতীক। গোটা বিশ্বের বুক থেকে জালেমের শোষণ পীড়নের সমাপ্তি না ঘটা পর্যন্ত এ সংগ্রাম চলবে।
ফারাকা লং মার্চের মাধ্যমে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী জাতীয় দুর্দিনে কিভাবে আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হয়, সে পথ নির্দেশ রেখে গেছেন। বাংলাদেশের প্রাপ্য গঙ্গা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা না পেলে ভারতীয় পন্য বর্জন আন্দোলন শুরু করার নির্দেশ দিয়ে গেছেন।
ইন্দিরা গান্ধীকে মওলানা ভাসানীর লেখা একটি চিঠি _
প্রিয় মিসেস ইন্দিরা গান্ধী, প্রধানমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী ভারত সরকার আপনার ১৯৭৬ সালের ৪ মে’র পত্র ফারাক্কা সমস্যা সম্পর্কে সরকারি বিবৃতির পুনরাবৃত্তি মাত্র। আপনার প্রখ্যাত পূর্বপুরুষ— মতিলাল নেহরুর নাতি এবং জওয়াহেরলাল নেহরুর কন্যার নিকট থেকে এরূপ পত্র আশা করিনি। আপনি নিজে বঞ্চিত লোকের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সকল ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সকল সময় সংগ্রাম করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে আপনি এবং ভারতের সকল জনগণ যে সাহায্য করেছে এজন্য আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।
ফারাক্কা সম্পর্কে আপনাকে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল পরিদর্শন করে কৃষি এবং শিল্প উৎপাদনের যে ক্ষতি হবে তা পরিমাপ করার জন্য পুনরায় অনুরোধ করছি। সম্পূর্ণ সরকারি প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর না করার জন্য আপনাকে অনুরোধ করছি। কারণ তাতে বর্তমান অবস্থা প্রতিফলিত হয় না।
এককভাবে গঙ্গার পানিপ্রবাহ প্রত্যাহার করার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা আমি ব্যাপকভাবে পরিদর্শন করি।
পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের জন্য আপনার উদ্যোগকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি। কিন্তু সমাধান স্থায়ী ও বিস্তারিত হতে হবে। দু’মাসের নিম্ন প্রবাহের মধ্যে তা সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না; সারা বছরের স্রোত অন্তর্ভুক্ত থাকার ভিত্তিতে ফারাক্কা সমস্যা সমাধানের জন্য পূর্বে আপনাকে কয়েকবার টেলিগ্রাম করেছি। বাংলাদেশের সাড়ে তিন কোটি মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা অন্যদের দিয়ে সমাধান সম্ভব নয়। দুই দেশের নেতাদের একত্রে বসে সমাধানে পৌঁছা উচিত। সম্মুখ বিরোধ ও সংঘর্ষ বাদ দিয়ে আমি অনুরোধ করছি আপনি নিজে হস্তক্ষেপ করে নিজে সমাধান করবেন, যা আট কোটি বাংলাদেশীর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে। যদি আমার অনুরোধ আপনি গ্রহণ না করেন, তাহলে অত্যাচারিত মানুষের নেতা আপনার পূর্বপুরুষ এবং মহাত্মা গান্ধীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সমস্যা সমাধানের জন্য কর্মসূচি প্রণয়ন করতে বাধ্য হব। এ সঙ্কট সমাধানে আমার সর্বোচ্চ সহযোগিতা এবং দু’দেশের বন্ধুত্ব সম্পর্ক শক্তিশালী করার জন্য নিশ্চয়তা দিচ্ছি।
শুভেচ্ছান্তে—
আপনার বিশ্বস্ত
আবদুল হামিদ খান ভাসানী
ইন্দিরা গান্ধীর চিঠি _
প্রিয় মওলানা সাহেব, আমি আপনার ১৯৭৫ সালের ১৮ এপ্রিলের পত্র পেয়ে দুঃখ পেলাম এবং বিস্মিত হলাম। এটা কল্পনা করতে কষ্ট হচ্ছে যে, ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম করেছেন এবং পরবর্তীতে তার নিজের বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে দুঃখ-কষ্টে ও উত্সাহে অংশগ্রহণ করেছেন— তিনি আমাদের এমন সাংঘাতিকভাবে ভুল বুঝছেন এবং আমাদের সরকারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছেন। আমি বিশ্বাস করতে পছন্দ করি যে, আপনি ভারতের বিভক্ত ভারত প্রতিষ্ঠার আক্রমণাত্মক অভিসন্ধি এবং ফারাক্কা বাঁধ ভাঙার ভীতি প্রদান সম্পর্কে যে ভাষণ দিয়েছেন তা উত্তেজনা মুহূর্তে বলেছেন। কোনো বাংলাদেশী সত্যি বিশ্বাস করে যে, ভারত এত দ্রুত বাংলাদেশ থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করেছে— সে কী করে তার প্রতিবেশীর প্রতি বৈরী ভাব পোষণ করতে পারে! মুক্তিযুদ্ধে অবদান এবং যুদ্ধ-উত্তর সহযোগিতার বিবরণের প্রেক্ষিতে ভারত সরকার ও তার জনগণকে বিচার করার প্রত্যাশা করে। আমাদের নিজেদের প্রয়োজন অধিক এবং আমাদের জনগণের দায়িত্ব অনেক বেশি। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি যে, আমাদের দুই দেশের জনগণের মঙ্গল একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের উভয়ের স্বার্থে এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা, সহযোগিতা এবং দু’দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব প্রয়োজন।
আপনি অবগত আছেন যে, ১৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ পূর্ব ভারতের প্রধান বন্দর কলকাতাকে রক্ষার জন্য একমাত্র উপায়। এ বাঁধকে কোনো প্রকারে পরিত্যাগ করা যায় না। আপনি আরও জানেন যে, একমাত্র গ্রীষ্মকালে দু’মাসে গঙ্গায় পানির অভাব দেখা দেয়। উপায় অবশ্য পাওয়া যাবে। ভবিষ্যতে যদি কোনো ঘটতি দেখা দেয় তাহলে পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতার মাধ্যমে আমাদের উভয়ের প্রয়োজন মেটানো যাবে। হুগলীর জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম পানি না দিয়ে আমরা বাংলাদেশে পানির প্রবাহ এ পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছি। মনে হয়, আপনাকে ফারাক্কা বাঁধের সংযুক্ত খালের বাংলাদেশ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে একতরফা এবং অত্যন্ত ভাবানো বিবরণ দেয়া হয়েছে। আপনি বললে আমাদের হাইকমিশনার আপনাকে বিপরীত বিবরণ সম্পর্কে অবহিত করবেন।
প্রতিবেশীদের সঙ্গে অনেক সময় সমস্যা দেখা দেয়। সমঝোতা ও সহযোগিতার মধ্যে সমাধান খুঁজে পাওয়াই গুরুত্বপূর্ণ। সংঘর্ষ ও শত্রুতা পোষণ করে আমরা একে অন্যের ক্ষতি করতে পারি না। আপনাকে সম্পূর্ণ সরলতার সঙ্গে পুনরায় বলতে চাই যে, বাংলাদেশ তার স্বাধীনতাকে সংহত এবং শান্তিতে উন্নতি করুক। আমাদের পক্ষ থেকে প্রতিবেশী বন্ধু এবং উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে আমরা আমাদের অবদানের প্রস্তাব অব্যাহত রাখব।
আপনি হয়তো অবগত আছেন যে, আমাদের দুই সরকার গ্রীষ্মকালে গঙ্গার পানি বণ্টন এবং সংশ্লিষ্ট প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। এর জন্য উভয় পক্ষের কল্যাণকামী মানুষের উত্সাহ ও সমর্থন প্রয়োজন। আমি আপনাকে নিশ্চয়তা প্রদান করছি যে, আমরা অনুসরণ ও চুক্তিপূর্ব আলোচনায় উন্মুক্ত কিন্তু কেউ যেন আশা না করে যে, ভারত কোনো প্রকার ভয় এবং অযৌক্তিক ও অন্যায় দাবির কাছে আত্মসমর্পণ করবে।
আপনার বিশ্বস্ত,
ইন্দিরা গান্ধী
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই