প্রথমবারের মতো নিউইয়র্কে আবৃত্তি উৎসব
১৮ মে ২০১৮ ১৬:৩১
নিউইয়র্ক: হঠাৎ লাইট বন্ধ করে হলভর্তি দর্শকদের অন্ধকার নিয়ে যাওয়া হলো। এরপর হঠাৎ চারদিক থেকে ‘বিবেকের বন্ধ দরজায়/শব্দের হাতুড়িকে আজ হানো/ বোধের বিশ্বাসে, ভাবনাকে মজবুত করে/ ভাবো, আরো বেশি করে ভাবো’ ধ্বনি উচ্চারিত হতে থাকে। ধীরে ধীরে আলো জ্বলতে উঠতে লাগলো। দলবদ্ধ আবৃত্তিকাররা দর্শকদের চোখে পড়লো। এরকম চমৎকার একটি আয়োজনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় নিউইয়র্ক আবৃত্তি উৎসব।
প্রারম্ভিকা স্লোগান সম্মেলকটির পরিকল্পনা ও পরিচালনায় ছিলেন মিথুন আহমেদ। হলভর্তি দর্শকদের সামনে গত রোববার (১৩ মে) নিউইয়র্ক সিটির উডসাইডস্থ কুইন্স প্যালেসে প্রথমবারের মত অনুষ্ঠিত হয়ে গেল প্রবাসের আবৃত্তিকারদের এই মিলনমেলা উৎসব।
এরপর আবৃত্তি উৎসবের সদস্য সচিব গোপন সাহা মঞ্চে আসতে উৎসব পর্ষদের আহ্বায়ক আবীর আলমগীর, উপদেষ্টা মিথুন আহমেদ, উপদেষ্টা মাহতাব সোহেল এবং বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব, আবৃত্তিকার ড.সালেক খানকে অনুরোধ করেন।
উৎসব আহবায়ক আবীর আলমগীর স্বাগত বক্তব্যে নিউইর্য়কে আবৃত্তি উৎসবের জন্য একটি স্থায়ী পর্ষদ ‘নিউ ইয়র্ক রিসাইটেশন ফেস্টিভাল কমিটি’র চেয়ারম্যান হিসেবে সৃজন ও উদ্দীপনার মুখ্য প্রাণ শিল্পজন আবৃত্তিকার মিথুন আহমেদের নাম ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, এই প্রবাসে দুই যুগের ও বেশি সময় ধরে আবৃত্তিচর্চার ক্ষেত্রে অভিভাবক হিসেবে মিথুন আহমেদকে সবসময় পেয়েছি। আমরা যারা এই আবৃত্তি চর্চার সঙ্গে যুক্ত আছি, আবৃত্তি জন্য কোন অনুষ্ঠান, কোন প্লাটফর্ম আমরাই মনে হয় নিজেদের জন্য তৈরি করতে পারিনি এতো বছরে। সে কারণেই আমরা শুধুমাত্র আবৃত্তিশিল্পীরা আবৃত্তি করব, আবৃত্তি শুনব, আবৃত্তি শোনাব, এই বাসনাটি মনের মধ্যে রেখে আমরা দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছিলাম একটি উৎসবের মধ্যদিয়ে সবাই একত্রিত হয়ে মনের ইচ্ছেটাকে আমরা যেন স্থাপন করতে পারি। বিভিন্ন পর্যায়ের আবৃত্তিশিল্পীরা উৎসবের পরিকল্পনার খুটিনাটি বিষয়গুলো আমরা আমাদের অভিভাবক মিথুন আহমেদের সঙ্গে বিষদ আলোচনা করি, যার ফসল আজকের এই উৎসব।
তিনি আরো জানান, উৎসব শেষের সঙ্গে সঙ্গে আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব পদ এবং উৎসব পর্ষদ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এই উৎসবের আহবায়ক আবীর আলমগীর উপদেষ্টা পরিষদে অন্তর্ভুক্ত হবেন প্রতি দুই বছর পরপর উৎসব হবে, আগামী আবৃত্তি উৎসব হবে ২০২০ সালে, এই ঘোষণাও তিনি দেন।
উৎসব পর্ষদের উপদেষ্টা মিথুন আহমেদ বলেন, ‘আবৃত্তি এক সময়ে খুব ভালোবেসে করতাম, এখনো আবৃত্তি করতে চাই, আর সেটা খুব ভালোভাবেই করতে চাই। আমি মনেকরি এই উৎসবের মাধ্যেমে দুটি কাজ হলো। আবৃত্তিকাররা তাদের চর্চাকে আরো ভালো করার ব্যাপারে সচেষ্ট হবেন, আর নিজেদের মর্যাদাবোধ নিয়ে অন্যান্য অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করতে যাবেন।’
আবৃ্ত্তি নিয়ে নতুন নতুন কাজ হবে, সঠিক কাজ হবে এমন আশা রেখে তিনি আরও বলেন, যারা আবৃ্ত্তি করবেন শুধু কণ্ঠের কারণে নয়, বোধ চিন্তা এবং আদর্শিক জায়গায় থেকে আবৃত্তি করবেন, অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের মত আবৃত্তি নয়, আবৃত্তি আসলে চেতনার জায়গা থেকে উৎপত্তি হয়েছে। এই বিষয়টি বিবেচনায় রাখার জন্য আবৃত্তিকারদের অনুরোধ জানান।
এরপর আরেক উপদেষ্টা মাহতাব সোহেল বলেন, এই শহরে আমার অবস্থান বেশি দিনের না। এখানে যেসব আবৃত্তিকাররা আছেন, তাদের আগ্রহ প্রবল যার কারণে অনেকগুলো কাজ হয়ে এসেছে, হচ্ছে, হবে। আজকের এই অয়োজনের মধ্যদিয়ে আবৃত্তির এক নতুন দিগন্তে উম্মোচন হলো।
আয়োজনের উদ্বোধন করে ড.সালেক খান বলেন, আপনারা যারা আবৃত্তির সঙ্গে জড়িত তাদের প্রতি রইলো শুভেচ্ছা, আবৃত্তি যেনো আবৃতি হয়ে না যায়, উচ্চারণের ক্ষেত্রে শুদ্ধ উচ্চারণটাই যেনো করি, ভয়টা যেনো থাকে। যেদিন ভয়টা শেষ হয়ে যাবে সেদিন আপনার পাঠও শেষ হয়ে পাবে। যে কোনো পরিবেশনের ক্ষেত্রে দুটো দল থাকে, একদল খেলে, পরিবেশন করে, তারা পরিবেশক। আর একদল থাকে দর্শকশ্রোতা, আপনাদের মতো, তারা শোনে, দেখে, শ্রবণ করে, খেলাটা জমে উঠে।
আজকে যারা খেলবেন, তারা আবৃত্তিকার,আবৃত্তিশিল্পী,কন্ঠশিল্পী, তাদের প্রতিপাদ্য বিষয় কবিতা, যার আরেক নাম সাহিত্য,যার আরেক নাম রসশাম্ত্র।এই দুইদলই যা আস্বাদন করবেন তা রস, এই প্রেক্ষাগৃহে যা গুন্জরিত হবে তাও রস। এই রসের সন্ধানে যারা অবিরাম বিচরণ করেন মননে এবং পার্থিবে তারা বিদগ্ধ। এই বিদগ্ধজনের সভা শুভহোক,শুভহোক কন্ঠশিল্পের এই আয়োজন,শুভ উদ্বোধন।”
এই উৎসব উৎসর্গ করা হয়েছে কবি ও ভাষা সংগ্রামী বেলাল চৌধুরী এবং আবৃত্তিকার ও মুক্তিযোদ্ধা কাজী আরিফ-কে। কবি ও ভাষা সংগ্রামী বেলাল চৌধুরী জীবনচরিত পাঠ করেন মিজানুর রহমান বিপ্লব,এবং আবৃত্তিকার ও মুক্তিযোদ্ধা কাজী আরিফের জীবনচিত্র পাঠ করেন ড. বিলকিস রহমান দোলা।
আয়োজনের উপদেষ্টা মিথুন আহমেদ ও মাহতাব সোহেল এবং উদ্বোধক সালেক খানকে উৎসব স্মারক উত্তরীয় পরিয়ে দেন সাংবাদিক ও একসময়কার খ্যাতিশীর্ষ বেতার ভাষ্যকার কৌশিক আহমেদ। অনুষ্ঠানের অন্যতম পৃষ্ঠোপোষক রাহাত আল মুক্তাদির উদ্বোধক বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব, আবৃত্তিকার সালেক খানকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান, তাকে সহযোগিতা করে অধরা, মাইশা ও দ্যুতি।
উদ্বোধনী বৃন্দ আবৃত্তি পরিবেশনার মাধ্যমেই শুরু হয় আবৃত্তি পর্বের। উদ্বোধনী বৃন্দ আবৃত্তি পরিচালনা করেন শান্তা শ্রাবনী। এরপর শুরু হয় একক আবৃত্তি পর্বের। পালাক্রমে আবৃত্তি করেন শরফুজ্জামান মুকুল, সংঘমিত্রা ভট্টাচার্য্য, জয়া চ্যাটাজী, লুবনা কাইজার, ফারুক আজম, ফারুক ফয়সল, এজাজ আলম, মোল্লা বাহাউদ্দিন পিয়াল, মেহের কবীর, হীরা চৌধুরী, রীপা নুর, আনোয়ারুল হক লাভলু, রাহাত আল মুক্তাদির, নাসিমা আক্তার, তন্ময় মজুমদার, হোসেন শাহরিয়ার তৈমুর, দুররে মাকনুন নবনী, শ্যামোলিপী শ্যামা, শুক্লা রায়, তাহরিনা পারভীর প্রীতি, নজরুল কবীর, ড. বিলকিস রহমান দোলা, মুমু আনসারী, শিরিন বকুল, শান্তা শ্রাবনী, আশরাফুল হাবিব চৌধুরী মিহির, পারভীন সুলতানা, সেমন্তী ওয়াহেদ, মিজানুর রহমান বিপ্লব, গোপন সাহা, আবীর আলমগীর, আহকাম উল্লাহ ও মিথুন আহমেদ।
নতুন প্রজন্মের মধ্যে আবৃত্তি করেছে- লিওনা মুহিত, নাহরীণ ইসলাম, নুহা কাওসার,মুন জেবিন হাই, গুঞ্জরি সাহা, জারিন মাইশা ও আবিবা ইমাম দ্যুতি।
সমাপনী বৃন্দ আবৃত্তি পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় আবৃত্তি পর্বের। সমাপনী বৃন্দ আবৃত্তিও পরিচালনা করেন শান্তা শ্রাবণী। এরপর আহবায়ক ও সদস্য সচিব উপস্থিত দর্শদেরকে ‘নিউইয়র্ক আবৃত্তি উৎসব ২০১৮’ এর কমিটির সদস্যদেরকে পরিচয় করিয়ে দেন এবং ধন্যবাদ জানান।
প্রায় পাঁচ ঘন্টাব্যাপী এই অনুষ্ঠানটির সমন্বয়কারী ছিলেন সেমন্তী ওয়াহেদ। আর তাকে সহযোগিতা করেন এজাজ আলম ,মেহের কবীর, হোসেন শাহরিয়ার তৈমুর ও মোল্লা বাহাউদ্দিন পিয়াল। অনুষ্ঠান ঘোষণায় ছিলেন আশরাফুল হাবিব চৌধুরী মিহির, দুররে মাকনুন নবনী ও হোসেন শাহরিয়ার তৈমুর।
নিউইয়র্ক আবৃত্তি উৎসব ২০১৮ এর প্রচারে দায়িত্বে ছিলেন আশরাফুল হাবিব চৌধুরী মিহির। স্বরণিকা সম্পাদনা ও অলংকরণ এর দায়িত্বে ছিলেন নজরুল কবীর আর সহযোগীতায় ছিলেন ড. বিলকিস রহমান দোলা ও মেহের কবীর। স্বরণিকার প্রচ্ছদ পেইন্টিং করেছেন তাজুল ইমাম, গ্রাফিক্সে ছিলেন জাহেদ শরিফ, উৎসব নকশা করেন টিপু আলম ।
আয়োজনে তবলায় জনম সাহা এবং ছায়ানৃত্যে ছিলেন সুষণা চৌধূরী। আর যাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হলো, তারা হলেন- রায়হান জামান, শিবলী নোমানী, নাসিমা বানু চাঁপা, কান্তা আলমগীর, সুতপা মন্ডল, বিশ্বজিত সেনগুপ্ত, নূসরাত এলিন, শিরিন ইসলাম, শহীদ উদ্দিন এবং লালন নূর। উৎসবে আরো যারা নিবন্ধন করেন- জি. এইচ. আরজু, ইভান চৌধুরী, তিতাস মাহমুদ এবং সেলিম ইব্রাহীম।
অনুষ্ঠান চলে সন্ধ্যে ছয়টা থেকে রাত এগারটা পর্যন্ত। আবৃত্তি উৎসবের আয়োজন নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে শুরু হলেও শেষ সময় পর্যন্ত অনুষ্ঠান হল ছিলো কানায় কানায় পরিপূর্ণ। ভবিষ্যতে আয়োজকরা আবৃত্তির মতো অনুষ্ঠান করতে গেলে সময়ের ব্যাপারটা খেয়াল রাখবেন আশা করি।
নিউইয়র্কে এই প্রথম একটি সফল আবৃত্তি উৎসব হলো, যা আবৃত্তিশ্রোতা তৈরি করার জন্য এটি একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। এইরকম আয়োজন যেনো আরো বেশি বেশি করে হয়, যাতে করে আবৃত্তিশ্রোতা তৈরি হবে এবং আবৃত্তিশিল্প চর্চাটা অব্যাহত থাকবে এই বিদেশের মাটিতে।
সারাবাংলা/এমআইএস