প্রবাস জীবনের ঈদ
১৬ জুন ২০১৮ ১২:০২
।। তারেক মেহদী , ভার্জিনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ।।
ঈদের চাঁদ উঠেছে। দেশের মতো বিদেশেও সবাই ঈদ নিয়ে করেছেন অনেক অনেক পরিকল্পনা। এর সঙ্গে দেখা করতে হবে। ওকে উপহার পাঠাতে হবে। আমরা যারা অন্যের দেশে বাস করছি, তারা নিজেদের মধ্যে সংযোগ করে নেই। কে কোন দেশের এটা বিষয় নয়। বিষয় হচ্ছে আমরা সবাই পরবাসী।
চাঁদ উঠার পরেই একে অন্যের খবর নেওয়া শুরু করলো, কে কোথায় ঈদ করছে, কেমন করে ঈদ করছে। প্রিয় এক বন্ধু ফোন দিয়ে জানতে চাইলো, ঈদ কোথায় করছি। জবাব দিলাম ঈদ করবো ইউনিভার্সিটিতে, প্রফেসরের সঙ্গে।
এবারে ঈদ পালন করা হচ্ছে ১৫ জুন, শুক্রবারে। আমেরিকায় এটা একটা কর্ম-দিবস। ফলে কারোই তেমন ছুটি নাই শুধু স্কুলের শিক্ষার্থীদের ছাড়া। সেটাও ঐচ্ছিক; নিয়ে নিতে হবে। তাই সবাই সারা দিনের জন্য ছুটি না নিতে পারলেও অনেকে শুধু নামাজের সময়টাতে ছুটি নেন ঈদের জামাতে শামিল হতে। আবার অনেকে বাচ্চাদের ছুটি নিতে দেন না কেননা দিনের সময়টুকুতে বাবা-মা দুজনই ব্যস্ত থাকেন কাজে, ফলে সন্তানদের দেখার কেউ থাকে না বাসায়।
ঈদের সাথে ছেলেবেলার একটা কেমন যেন যোগ অনুভব করি। মনে পড়ে যায় সেইসব দিনগুলোর কথা। ঈদকে ঘিরে নতুন জামা কাপড় কেনা, ভাই-বোন-বন্ধুকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য ঈদের আগ পর্যন্ত কাউকে তা না দেখানো, নতুন জুতা ইত্যাদি ইত্যাদি। ঈদের অনেক আগে থেকে শুরু হয় প্রস্তুতি আরও কত কি! কিন্তু এখানে প্রবাসীদের ঈদটা একটু অন্যরকম। ভোর বেলা গোসল করে হালকা মিষ্টি মুখ করে ও ঈদের জামা পড়ে ঈদগাহে সবাই একসাথে ঈদের নামাজ পড়া, সারাদিন বন্ধুদের বাসায় ঘুরে বেড়ানো- এসব এখন শুধুই স্মৃতি। এখানে ঈদ মানে অন্য আট দশটা দিনের মতোই। পরিবার পরিজন ছাড়া ঈদ যেন কোনো অর্থই বহন করে না প্রবাসীদের জীবনে।
আমেরিকায় এটা আমার দ্বিতীয় ঈদ। আমরা ভার্জিনিয়ার যে শহরটায় থাকি তার নাম ফেয়ারফ্যাক্স। আমি বলি এ শহর দেখে পুরো আমেরিকাকে চিন্তা করা যাবে না। কেননা সেদিন জানতে পারলাম, আমেরিকার ১০টি ধনী কাউন্টির মধ্যে ফেয়ারফ্যাক্স একটি। এবং প্রায় ৩/৪ টি ধনী কাউন্টির অবস্থান এই ভার্জিনিয়া, মেরিল্যান্ড ও ডিসি এলাকায়। ফলে এখানে সবকিছুর মূল্য বেশ উঁচু অন্যান্য শহর থেকে। আর থাকেনও অপেক্ষাকৃত ধনী ব্যক্তিরা। আর আকারের দিক থেকেও ভার্জিনিয়া প্রায় বাংলাদেশের সমান একটি স্টেট। মাত্র প্রায় ১০ হাজার বর্গমাইল ছোট বাংলাদেশ থেকে। এখানে বিভিন্ন দেশ থেকে মুসলমান ধর্মাবলম্বী ও অন্যান্য ধর্মের মানুষ বসবাস করে। আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি বেশ কাছে হওয়ার এই এলাকাকে হ্যাপেনিং প্লেস বলেন অনেকে। কিন্তু ঈদের ক্ষেত্রে দেখা যায় একটু ভিন্ন চিত্র।
ফোয়ারফ্যাক্সের আশেপাশে অনেকগুলো মসজিদ থাকলেও সেগুলোর মালিকানা বিভিন্ন দেশের কমিউনিটির। বিভিন্ন মসজিদে বিভিন্ন সংস্কৃতির ছোঁয়া পাওয়া যায়। এই বিষয়টা খুব মজার। আমি আর আমার সহধর্মী দুজনই এখানে পিএইচডি করছি। পরিবার পরিজন ছেড়ে এখানে বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থীই উচ্চশিক্ষায় পাড়ি জমিয়েছে। রোজার মাসে আমাদের মধ্যে বেশ মজার অভিজ্ঞতা হলো এখানে বিভিন্ন মসজিদে ইফতার এর আয়োজন করে কমিউনিটি থেকে। সুতরাং আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের একটা মজার আড্ডা হয় এই আয়োজনগুলোতে। আমরা সময় পেলেই একেক দিন একেক মসজিদে গিয়ে ইফতার করি আর জানতে পারি তাদের সংস্কৃতি ও ভিন্ন ধারার রান্না।
গত বছর ঈদের দিনটা কিভাবে কেটে গিয়েছিল টেরই পাই নি। কিন্তু এবারের ঈদটা আমাদের কাছে স্পেশাল। আমাদের ঘর আলো করে এবারে আমাদের সাথে আছে আমাদের ১০ মাসের সন্তান আহীর। কিন্তু ঈদ নিয়ে সকল উত্তেজনা মুহূর্তেই ম্লান হয়ে গেল যখন শুনলাম আহীরের মা আজবিনাকে যেতে হবে আলাবামাতে একটা সামার স্কুলে। সেখানে থাকতে হবে দেড় মাস। আর দিনটা শুক্রবার হওয়ায় ছুটি নেই আমারা। কিন্তু বেশ বড় একটা সাপোর্ট হলো আমার বাবা মা বেড়াতে আসতে পেরেছেন এ সময়টাতে। উনারা সহযোগিতা করছেন এ দীর্ঘ সময়ে আমাদের সন্তানকে দেখভাল করার জন্য। ফলে বাবা-মাকে এই বিদেশের মাটিতে আনতে পেরেও একটা অন্যরকম আনন্দ কাজ করছে।
সাহস করে প্রফেসরকে বলেই ফেললাম ঈদের দিনটা ছুটি নিতে পারি কিনা। প্রফেসর এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। আহীরকে ঘিরে এবারের ঈদে আমাদের আছে নানা পরিকল্পনা। দেশ থেকে এবং প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সে অনেক গিফট পেয়েছে। যদিও ওর মা এবার ঈদে কাছে থাকবে না, ঈদের দিন তাই ছোট্ট আহীরকে নিয়ে তাই কী করলাম সেটা নাহয় আরেকদিন বলবো।
তবু কেন যেন একটা শূন্যতা কাজ করে, ঈদের দিন এখানে আলাদা করে বোঝা যায় না। তাছাড়া ভাই ভাবি ও অন্যান্য সকল আত্মীয় স্বজনই দেশে থাকেন। সুতরাং ঈদের দিনে তাদের সাথে ফোনে কথা বলা ছাড়া উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া, মেরিল্যান্ড ও ডিসি এলাকায় অনেক বাংলাদেশির বসবাস। ফলে এখানে অনেক দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা হয়। অনেক কমিউনিটি অর্গানাইজেশন এগিয়ে আসে এ ধরনের অনুষ্ঠানগুলোতে কমিউটিনির সবাইকে একত্রিত করে রাখতে।
এবারও তার ব্যতিক্রম নেই। সকালে বিশেষ জামাতের ব্যবস্থা থেকে শুরু করে তারা আয়োজন করেছেন নানা ধরনের ঈদ অনুষ্ঠান। এছাড়া তারা যাকাতে অর্থ সংগ্রহ করে বাংলাদেশের অসহায়দের মাঝে তা বিতরণের ব্যবস্থা করে থাকেন। বাংলাদেশীদের পক্ষ থেকে চাঁদ রাতের তেমন উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা না থাকলেও সেন্ট্রালি একটা বড় চাঁদরাত অনুষ্ঠিত হয় স্যান্টিলি নামক জায়গায়। সেখানে আসেন বিভিন্ন দেশের মানুষ। ঈদের আগের শপিংটা তারা মূলত সেখান থেকেই সেরে ফেলেন। অনেকের মূল উদ্দেশ্য থাকে ঘোরাঘুরি করা। তবে বাংলাদেশীদের মধ্যে মূলত ঈদের জামা দেশ থেকে নিয়ে আসার প্রবণতাই বেশি খেয়াল করেছি।
এরপর ঈদের দিন। এই দিনটায় অনেক বাসায় আয়োজন করেন, অনেকে বন্ধু বান্ধব নিয়ে ঘুরতে যান পার্কে বা অনেকে একটু দূরের পথের যাত্রার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু সেটা আসলে অল্প কিছু মানুষই উপভোগ করতে পারে কেননা কর্ম-দিবস হওয়ায় এবং কোন আলাদাভাবে ছুটি না থাকায় অধিকাংশ মানুষকেই কাজে যেতে হবে।
যারা ছুটি নিতে পেরেছেন তাদের অনেকে নিজস্ব বাসায় খাওয়া দাওয়া ও গানবাজনার আয়োজন করেন। এসব অনুষ্ঠানে গেলে মনে হয় আরে এতো পুরো বাংলাদেশ। এখানে মসজিদগুলোতে বাংলাদেশ থেকে একটু ভিন্ন রীতি খেয়াল করেছিলাম গতবার। নারী-পুরুষ উভয়ই একসাথে নামাজ পড়েন। বাংলাদেশিরাও এখানে এই একই রীতি অনুসরণ করেন। এছাড়া অনেক রীতি দেখলাম যেগুলো বাংলাদেশ থেকে একটু ভিন্নই বলা চলে।
প্রবাসীরা ঈদের এই দিনটায় আসলে বাংলাদেশকেই বেশি অনুভব করেন। ঈদ আসলে শৈশবের স্মৃতিকে বেশ উসকে দেয়। প্রবাসী শিক্ষার্থী যারা আছেন তারা এ দিনটায় চেষ্টা করেন দেশে রেখে আসা মা-বাবা-ভাই-বোনের সাথে ভিডিও কল করে যোগাযোগ করতে। যারা এখানে মা-বাবা ও পরিবার নিয়ে থাকেন তাদের সান্ত্বনা আছে।
যারা একা থাকেন অনেকের সময় কেটে যায় সোশ্যাল মিডিয়াতে চোখ বুলিয়ে ও বন্ধুদের ঈদ আনন্দ দেখে। আবার অনেকে বললেন ঈদের দিনের মূল কাজ হল মুভি দেখা। তবে তারা প্রত্যেকেই খুব মিস করে ঈদের আগের দিন আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদ খোঁজা, কে প্রথম চাঁদ দেখলো সেই প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠা। এসবের মধ্য দিয়েই অতিবাহিত হতে থাকে ঈদের দিন; আর প্রবাসীদের মনে জমতে থাকে দেশে উদযাপন করে আসা ঈদ স্মৃতি। ব্যস্ত প্রবাস জীবনে ঈদ নাহয় আসুক এভাবেই।
সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।