লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে একদিন
৫ মে ২০২৫ ১৬:৫৮
পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের গন্তব্য লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। এপ্রিলের শেষ শনিবার ঢাকা থেকে মাইক্রো নিয়ে সকাল আটটায় রওনা দিই। সঙ্গী বলতে আমরা পাঁচ বন্ধু। এর মধ্যে দুই বন্ধুর চাকরিস্থল আবার সিলেটের আশপাশে। যে যার মতো চাকরিজীবনে ব্যস্ত থাকলেও ভ্রমণের কথা বললে সবাই কোনো না কোনোভাবে সময় বের করে ফেলি। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের অবস্থান মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায়। মূল উদ্যানের খানিক অংশ আবার শ্রীমঙ্গল উপজেলায়ও পড়েছে। নরসিংদী-ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে আমরা একটু একটু করে শ্রীমঙ্গলের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। সময় দুপুর ১টা। পাহাড় আর চা বাগানের দেখা পেতে শুরু করি। বুঝতে বাকি থাকে না যে আমরা শ্রীমঙ্গলে চলে এসেছি। চা বাগানের মাঝে বড় বড় গাছে কী যেন পেতে রাখা! পাশ থেকে এক বন্ধু বলল, বাগানের মাঝে রাবার গাছে ছোট ছোট পাত্র বেধে রাখা হয়েছে। পাহাড় আর চা বাগানের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বন্ধুদের কেউ কেউ আনন্দে চিৎকার করে উঠলো! আমাদের গন্তব্যস্থল লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান বলে আমরা গাড়িতে বসেই শ্রীমঙ্গলের চা বাগানের মন মাতানো সৌন্দর্য উপভোগ করেছি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ফেরার পথে চা বাগানের রাজ্যে শেষ বিকেলটা কাটাবো। যাহোক, চা বাগান দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। সাথে করে নিয়ে আসা দুপুরের খাবার দিয়ে লাঞ্চ করলাম।

ভিতরে প্রবেশ করেই শুরুতেই দুপাশে সারিবদ্ধ গাছ আপনাকে স্বাগত জানাবে
যেদিকে চোখ যাই চারদিকে হরেক রকমের নাম না জানা বৃক্ষের সারি। গাড়ি পার্কিং করে এবার টিকেট কাটার পালা। জনপ্রতি টিকিটের মূল্য ১১৫ টাকা। সবার টিকিট কাটা হলো। সাথে গাড়ি পার্কিং-এর জন্য আরও অতিরিক্ত ১১৫ দিতে হলো। উদ্যানে প্রবেশমুখে প্রধান ফটকে লেখা শতাব্দীর স্মারক, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার। ভেতরে ঢুকতেই দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা বড় বড় গাছ আমাদের স্বাগত জানালো। শুরুতেই সুন্দর একটা ভিউ পেলাম। উদ্যানে যতগুলো সুন্দর দৃশ্য আছে তার মধ্যে এটি একটি। দু’পাশে গাছের সারি পেরুতেই ছোট্ট একটি কালভার্ট। যদিও নিচ দিয়ে পানি চলাচল নেই। সম্ভবত শীত মৌসুম বলেই মনে হয় পানি নেই। কালভার্ট পেরুতেই হাঁটতে হাঁটতে ডানে মোড় নিয়ে এগোতেই দেখা পেলাম রেলপথ। উদ্যানের ভেতর দিয়ে ঢাকা-সিলেট ও সিলেট-চট্টগ্রাম রুটের রেলপথ চলে গেছে। উদ্যানের ভেতর দিয়ে রেললাইন দর্শনার্থী ও ভ্রমণপিপাসুদের কাছে আলাদা একটা আকর্ষণ তৈরি করেছে। শেষ বিকেলের আলো বৃক্ষরাজির ফাক গলে রেললাইনের ওপর আছড়ে পড়েছে। রোদ-বৃক্ষ-রেললাইনের মিশেলে দলে দলে ছবি তুলছেন ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা। অনেকে রেললাইনে বসে গল্প করছেন। শুটিং এর একটা ইউনিটকে দেখলাম শুটিং করতে। আমরা বন্ধুরা যে যার মতো এলোমেলোভাবে ছবি তুললাম! বনের সৌন্দর্য দেখতে এতটাই মুগ্ধ ছিলাম যে একত্র হতে ভুলে গিয়েছিলাম! তবে দুঃখজনক বিষয় হলো, বনের মধ্য দিয়ে রেললাইন থাকায় প্রতিবছর অনেক বন্যপ্রাণী রেললাইনে কাটা পড়ে আহত ও নিহত হয়। উদ্যানের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া সাড়ে সাত কিলোমিটার রেলপথ বন্যপ্রাণীদের জন্য রীতিমতো আতঙ্কের! ১৯৯৬ সালে লাউয়াছড়াকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়। চিরহরিৎ ও মিশ্র চিরহরিৎ এই বনের আয়তন ১ হাজার ২৫০ হেক্টর। বনের উল্লেখযোগ্য প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে বানর, মায়া হরিণ, মুখপোড়া হনুমান, বনরুই, বনমোরগ, অজগর, বন্য শূকর, মেছো বাঘ, উল্লুক ও বিভিন্ন প্রজাতির সাপ। সবমিলিয়ে বনে ২২ প্রজাতির উভচর, ৫৯ প্রজাতির সরীসৃপ, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২৪৬ প্রজাতির পাখি ও ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। জীববৈচিত্র্যে ভরা এই সংরক্ষিত বনাঞ্চলে রয়েছে চাপালিশ, আকাশমনি, জারুল, আগর, গামার, নাগেশ্বর, সেগুনসহ বিরল বৃক্ষ।

উদ্যানের ভিতরে দিয়ে চলা ঢাকা-সিলেট রেললাইন
বনের ভেতরে পুলিশ টহল চোখে পড়লো। রেলপথ ছেড়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই রয়েছে ফ্রেশ হওয়ার ব্যবস্থা। বনের গভীরে প্রবেশের জন্য রয়েছে ছোট ছোট পথ। বনের ভেতরটা মূলত উঁচু-নিচু। আমরা একটা পথ বেছে নিয়ে এগোতে থাকলাম। পাশেই লেখা- ‘বানর হতে সাবধান’। একটু সামনে গিয়ে পেয়ে গেলাম বন গবেষণা কেন্দ্র। অনেক অচেনা বৃক্ষ দেখলাম যেগুলো সচারচর আগে সমতলে কখনো চোখে পড়েনি। আমাদের মধ্যে এক বন্ধু খুব সাহসী ছিল। তার কথা মতো আমরা বনের আরও গভীরে প্রবেশ করি। সামনে এক পুলিশ ভাইয়ের সাথে দেখা হতেই তিনি আমাদের যেখানে লোক সমাগম নেই এমন স্থান এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিলেন। তার কথা শুনে আমাদের অনেকের হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়ায় সামনে এগোনের চিন্তায় ক্ষান্ত দিই। বনের সৌন্দর্যকে গভীরভাবে দেখার জন্য বনের মধ্যে তিনটি ট্রেইল পথ রয়েছে। আধা ঘন্টা, এক ঘন্টা ও তিন ঘন্টার এই ট্রেহল পথগুলো ট্রেকিং এর মাধ্যমে বনের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য আরও কাছ থেকে উপভোগ করা যাবে। তবে ট্রেকিং এর সহায়তার জন্য গাইড নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে। লাউয়াছড়া উদ্যানের ভিতরেই সৌন্দর্য যেন শেষ হবার নয়। উদ্যানের ভেতরে আরেক সৌন্দর্যের নাম খাসিয়াপুঞ্জি, চা বাগান, পানের বরজ ও ঝিরি। বনের ভেতর দিয়ে এতসব উপভোগ করতে চাইলে পুরোদিনই সময় নিয়ে আসতে হবে। আমাদের হাতে সময় কম থাকায় এতকিছু দেখার সুযোগ হয়নি।

পুরো উদ্যানই গুরুত্বপূর্ণ বৃক্ষের সমাহার
বিকেল সাড়ে চারটা। এবার ফেরার পালা! চেনা পথ দিয়েই ফেরার পথে একটা সাপের দেখা পেলাম। সাপ সাপ বলে পাশের বন্ধুটি চিৎকার করতেই সবাই যেন যে যার মতো প্রাণ বাঁচাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে! চিৎকার চেঁচামেচিতে মাঝারি আকৃতির সাপটি চোখের পলকেই উধাও হয়ে গেল। পেছনের গাছপালা নড়তেই তাকিয়ে দেখি কয়েকটি বানর এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ তো রীতিমতো ভয় পেয়ে গেল। কেননা আগেই জেনেছি- বানর হতে সাবধান! বনেই মধ্যে একদল শিল্পীকে দেখলাম ঢোল, তবলা, হারমোনিয়াম, বাঁশিসহ নানাবিধ বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গাজবাজনা করতে। আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি ভালো লাগেনি। সংরক্ষিত বনে এভাবে গানবাজনা করা যায় কি না বন কর্তৃপক্ষই ভালো বলতে পারে! বনের মধ্যে যতক্ষণ ছিলাম কীটপতঙ্গ ও পাখির কিচিরমিচির বেশ ভালো লেগেছে। সাইরেনের মতো বাজতে থাকা ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ যেন সারাক্ষণই কানে লেগে ছিল। বৃক্ষরাজ্য থেকে যখন প্রস্থান করি তখন ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা। ভালো থাকুক লাউয়াছড়ার উদ্ভিদ ও প্রাণীকুল।

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের সামনে লেখক
কীভাবে যাবেন _
ঢাকা থেকে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে আসার জন্য ট্রেন-ই ভালো মাধ্যম। কমলাপুর কিংবা বিমানবন্দর থেকে উপবন, পারাবত কিংবা জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসে শ্রীমঙ্গল আসতে সময় লাগবে সাত ঘন্টার মতো। আর বাসে আসতে সময় লাগবে প্রায় ৫ ঘন্টার মতো। আমরা মাইক্রোতে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে লাউয়াছড়া গেটের সামনে এসেছিলাম প্রায় ৫ ঘন্টায়। তবে আরও সকালে রওনা দিয়ে কিংবা রাতে এসে একদিনের পুরো সময় ধরে ভ্রমণ করলে ভালো হবে। একদিনের ভ্রমণে লাউয়াছড়া উদ্যানের সাথে চাইলে শ্রীমঙ্গলের চা রাজ্য ও মাধবপুর লেক একদিনে ভ্রমণ করতে পারবেন।
লেখক: জলবায়ু ও পরিবেশকর্মী, সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)
সারাবাংলা/এএসজি