ভোলাগঞ্জের সাদা পাথরের নাম শুনেছি। ছবিও দেখেছি। কখনো যাওয়া হয়নি। সাদা পাথর আর পাহাড়ের রাজ্য দেখার আগ্রহ দিনে দিনে বেড়েছে। এবার ইচ্ছার কাছে কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি! কয়েকদিন আগে কয়েকজন বন্ধু মিলে সোজা ভোলাগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর সিলেটের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটগুলোর একটি। সকাল ছয়টায় ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে সিলেট পোঁছায় সাড়ে ১১টায়। আগে থেকে সংগ্রহে থাকা খাবার দিয়েই গাড়ির মধ্যেই সকালের নাস্তা সেরে নিই। বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই সিলেটের হজরত শাহজালাল (রহ.) ও হজরত শাহপরান (রহ.) মাজার জিয়ারতের ইচ্ছা পোষণ করাই আমরা তাৎক্ষণিকভাবে সিলেট শহরের দুটি মাজারে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। অল্প সময়ের মধ্যে মাজার জিয়ারত শেষে আমরা ভোলাগঞ্জের সাদা পাথরের দেশে যাত্রা করি। সিলেট শহর থেকে ভোলাগঞ্জের দূরত্ব ৩৩ কিলোমিটার। শহর থেকে এক ঘন্টার মতো সময় লাগলো ভোলাগঞ্জে সাদা পাথর কোয়ারিতে পৌঁছাতে। যেতে যেতে মনে হয়েছে বাংলার প্রাণ-প্রকৃতি যে কত বেশি সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর তা সিলেটে না আসলে বোঝা যেত না! কোথাও কোথাও বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, আবার কোথা উঁচু-নিচু পতিত ভূমি। চারপাশে খুব অল্প ঘরবাড়ি! বুঝতে বাকি রইলো না আমরা হয়তো আর কিছুক্ষণের মধ্যে সেই কাঙ্ক্ষিত সাদা পাথরের দেশে পৌঁছে যাব। কেননা রাস্তার পাশে পাথর ভাঙার মেশিনে পাথর ভাঙা হচ্ছে। বড় বড় শক্ত পাথরগুলো কয়েকটি প্রক্রিয়া শেষে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। অবশেষে আমরা পৌঁছে গেলাম সাদা পাথর আর নীল জলের দেশে। সামনে তাকাতেই দেখি বিশাল সবুজে ঘেরা পাহাড়। মানে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাদদেশ। সামনে একটি সাইনবোর্ডে লেখা- ‘এখানেই বাংলাদেশের সীমানা শেষ, সামনে ভারত, প্রবেশ নিষেধ’।

সাদা পাথর আর নীল শীতল পানির পরশে ভ্রমণপিপাসুরা মুগ্ধ হবেই
আমাদের মাইক্রো পার্ক করে রাখা হলো। অনেক দর্শনার্থী আবার বাসে করে দূর দূরান্ত থেকে ভোলাগঞ্জে এসেছেন। বেশ খানিক সময় ধরে দূর থেকে মেঘালয় পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখছিলাম। পাহাড়ের পাদদেশে কোথাও কোথাও ঘরবাড়িও চোখে পড়লো। ভাবলাম, এত উপরে পাহাড়ে মানুষ কীভাবে বাস করে! যাহোক গাড়ি থেকে নেমে সাদা পাথর দেখার জন্য মুখিয়ে আছি। উপর থেকে খানিকটা ঢালু পথে নিচে নেমে দেখি বিশাল নদী। এটাই ধলাই নদী। সাদা পাথর এলাকাটি ধলাই নদীর তীরে অবস্থিত। ভারতের মেঘালয়ের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে প্রতিবছর বর্ষাকালে নেমে আসে প্রচুর পাথর। এছাড়া আগে থেকেই ধলাই নদীর তলদেশে বিপুল পাথর মজুদ আছে বলে ধারণা করা হয়।

ইঞ্জিনচালিত নৌকায় সাদা পাথরের মূল স্থানে যেতে হয়
জানতে পারলাম, সাদা পাথরের মূল স্থানে যেতে হলে ছোট ছোট ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে যেতে হবে। নিয়ম হলো, একটি নৌকায় ৮ জনের বেশি ওঠা যাবে না! যাওয়া আসা মিলে মোট ভাড়া ৮০০ টাকা। একটি নৌকার বিল পরিশোধ করা মাত্রই স্লিপ নিয়ে নৌকার মাঝি আমাদের নিয়ে রওনা দিলেন সাদা পাথরের মূল স্থানে। ইঞ্জিনচালিত নৌকা বেশ দ্রুত গতিতে আমাদের নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। নদীর দু’তীরে পাথর তোলার জন্য লালচে বালু খুঁড়ে রাখা হয়েছে। নদী তীরে কিছু লোককে দেখলাম পাথর তুলতে। শুনেছি, অবৈধভাবে নদীর দু’তীরে পাথর তোলা হয়। শুধু পাথর নয়, পাথরের সাথে অন্যান্য খনিজ দ্রব্যও থাকে। এখন নিজ চোখে দেখলাম। ৭ থেকে ৮ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম পাথর কোয়ারির ঠিক কাছে। যদিও নৌকা থেকে নেমে ৫-৭মিনিট এখনো হাঁটতে হবে। মাঝি আমাদেরকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় মোবাইল নম্বর দিয়ে গেল। বলল, আমাদের সাদা পাথর এলাকা দেখাদেখি শেষ হলে তাকে ফোন দিতে। আবার এসে নৌকায় করে আমাদের নিয়ে যাবে। আমরা হেঁটে একটু একটু করে সাদা পাথরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। হাঁটতে কষ্ট হবে দেখে এক বন্ধু তো ১০০ টাকা দিয়ে রীতিমতো ঘোড়ায় চড়ে বসলো। বেশিরভাগ লোক পায়ে হেঁটে সাদা পাথরের দিকে যাচ্ছে। নৌকা থেকে নেমে সাদা পাথরের মূল অংশে আসতে সময় লাগলো প্রায় ৮ মিনিট। দিনটি শনিবার হওয়ায় ভিড়ও একটু বেশি। যেদিকে তাকাই ছোট-বড় পাথরে ভরপুর। সাদা পাথরের ঠিক সাথেই ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সবুজে ঘেরা পাহাড়। পাথরের উপর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ নীল ও শীতল পানি। পানি এত স্বচ্ছ যে, এক হাত পানির নিচে কী আছে তাও দেখা যাচ্ছে। বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ স্বচ্ছ জলে পা ভিজিয়ে বসে আছে। পানির শীতলতা পুরো শরীরকে শীতল করে দিচ্ছে। রোদের মধ্যে পানিতে পা ভিজিয়ে রাখতে বেশ ভালই লাগছিল। মনে হচ্ছিল যেন বরফের মধ্যে পা দিয়ে আছি।

ধলাই নদী থেকে দুই ক্ষুদে পাথর সংগ্রহকারী
সূর্যের আলোয় সাদা রঙের পাথরগুলো যেন জ্বলজ্বল করছে। তবে পাথরের উপর দিয়ে হাঁটার সময় সাবধান থাকতে হবে। কেননা পানির নিচের পাথরগুলো পানির মধ্যে থাকতে থাকতে পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছে। আবার পাথরগুলো ছোট-বড় হওয়ায় সমান তালে পা ফেলে চলাটা একটু কঠিন! পাথরের মধ্যেই স্বচ্ছ পানির গভীর অংশে অনেক দর্শনার্থীকে দেখলাম গোসল করতে। মনে হচ্ছিল ওরা পরিকল্পনা করেই এসেছে! বন্ধুদের কেউ কেউ গোসল করতে চাইলেও প্রস্তুতি না থাকাই আর সম্ভব হয়নি। পানির গভীরতা বেশি থাকাই অনেককে সাঁতার কাটতেও দেখলাম। পাথরের উপর বসে সামনের সবুজ পাহাড় দেখার মজাই আলাদা। কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমরা সবাই সাদা পাথরের মায়ায় পড়ে গিয়েছিলাম! ছোটবেলায় পাথরে পাথরে ঘর্ষণ লাগিয়ে আগুন জ্বালাতাম। পাথর দেখে ছোটবেলার সেই স্মৃতি মনে পড়ে গেল। কয়েকটি ছোট ছোট পাথর স্মৃতি হিসেবে রাখার জন্য সংরক্ষণ করলাম। আমরা ভ্রমণে গিয়েছি শীত মৌসুমে। বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি বেড়ে পাথরগুলো আরও চকচকে হয়ে উঠে। সিলেট সীমান্তের সবটায় জুড়েই রয়েছে মেঘালয় রাজ্যের সবুজে ঘেরা পাহাড়। প্রকৃতি যে এত সুন্দর ও মোহনীয় হতে পারে তা সাদা পাথর রাজ্যে না গেলে বুঝতে পারতাম না। ভোলাগঞ্জ ও এর আশপাশের লোকজন পাথর উত্তোলন করে জীবিকা নির্বাহ করে। স্থানীয় অর্থনীতিতে পাথর উত্তোলনের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। প্রায় দেড় ঘন্টার মতো সাদা পাথর রাজ্যে অবস্থান করেছিলাম। সাদা পাথর ভ্রমণ এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা! বেলা তখন প্রায় ২টা। নৌকার মাঝিকে ফোন দিই। ফিরতি পথে শেষ সময় ধলাই নদীর সৌন্দর্য আরেকবার দেখে নিলাম। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে সাদা পাথরকে বিদায় জানালাম।

স্বচ্ছ ও নীল পানির ছোঁয়া পেতে দর্শনার্থীরা দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসে
যেভাবে যাবেন _
ঢাকা থেকে সিলেটে বাস বা ট্রেনে (উপবন/পারাবত) আসতে হবে। তবে ট্রেনে আসলে রাতের ট্রেনে আসায় ভালো হবে। তাহলে দিনে ঘুরার জন্য বেশি সময় পাওয়া যাবে। ঢাকা থেকে ট্রেনে ৭ ঘন্টায় সিলেট আসা যাবে। বাসে ঢাকা থেকে সিলেট আসতে সময় লাগবে প্রায় ছয় ঘন্টা। তারপর সিলেট শহর থেকে স্থানীয় যানে এক ঘন্টার মধ্যে ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর এলাকায় যাওয়া যাবে। তবে ব্যক্তিগত গাড়ি আনলে সরাসরি ভোলাগঞ্জে আসা যাবে। অনেকে আবার দলবল নিয়ে বাসে সাদা পাথর ভ্রমণে আসে! একদিনের পুরো সময় নিয়ে আসলে ভোলাগঞ্জ ভ্রমণ শেষে জাফলংও ভ্রমণ করা যাবে। আমরা সাদাপাথর ভ্রমণ শেষ করে আরেক বিখ্যাত পর্যটন স্পট জাফলং ভ্রমণ শেষে রাতে ঢাকার উদ্দেশ্যে সিলেট ছেড়েছিলাম।
লেখক: জলবায়ু ও পরিবেশকর্মী, সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)