লবণ বা নুন যে নামই হোক না কেন এটি আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কারণ আমাদের সব খাবারের স্বাদ অতুলনীয় রাখতে লবণ লবণের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের দেহের তরলের ভারসাম্য রক্ষার জন্য সোডিয়াম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্নায়ু ও পেশীর কাজ ঠিক রাখতে ও শরীরের তরল নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে লবণ।
লবণ কী?
এটি একটি খনিজ উপাদান ইহা সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCl) দ্বারা গঠিত একটি রাসায়নিক যৌগ যা লবণের বৃহত্তর শ্রেণীর অন্তর্গত। লবণ এক ধরনের প্রাকৃতিক স্ফটিক যা খনিজ লবণ বা হ্যালাইট নামেও পরিচিত।
বিভিন্ন ধরণের লবণ রয়েছে, যেমন অম্লীয় লবণ, মৌলিক লবণ, নিরপেক্ষ লবণ এবং দ্বিগুণ লবণ।
বৈজ্ঞানিকভাবে নানান রকমের লবণ রয়েছে, সেগুলো হলো –
Neutral Salt: তীব্র অম্ল ও তীব্র ক্ষার, প্রশমন বিক্রিয়ায় উৎপন্ন হয় যেমন table salt (NaCl)
Acidic Salt: তীব্র অম্ল ও মৃদু ক্ষার, প্রশমন বিক্রিয়ায় উৎপন্ন হয় যেমন NH4Cl, CuSO4
Basic Salt: মৃদু অম্ল ও তীব্র ক্ষার, প্রশমন বিক্রিয়ায় উৎপন্ন হয় যেমন Na2S, CH3COONa
Mixed Salt: মিশ্র লবণে একাধিক cation (H*+ ব্যতীত) বা anion থাকে যেমন bleaching powder Ca(OCl)Cl, NaKCO3
Double Salt: যখন দুটো সরল বা সাধারণ লবণকে সমমোলার (equimolar) অনুপাতে কেলাসিত বা crystallized করা হয় তখন যে লবণ উৎপন্ন হয় তখন সেটাকে double salt বলে। Doubled salt জলে দ্রবীভূত হয়ে দুটো সরল লবণ হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
উপযোগিতা _
সামুদ্রিক লবণ বা কেল্টিক সামুদ্রিক লবণ: এটি একটি অপরিশুদ্ধ, অপ্রক্রিয়াজাতকৃত লবণ। এর গন্ধও অনন্য। সামুদ্রিক লবণ সমুদ্রের পানিকে বাষ্পীভূত করে উৎপাদন করা হয়।
পাথুরে লবণ বা হিমালয়ের গোলাপি লবণ: ‘কালা নামাক’ নামে অপরিশোধিত লবণ পানির এই কাঁচামাল পাওয়া যায় হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে। এই লবণ ব্যবহারে যা কিছুই প্রস্তুত করা হোক না কেন তাতে এক ভিন্ন ধরনের সুগন্ধ যুক্ত হয়।
রসুন বা সেলারি লবণ: এই সুগন্ধি লবণ তৈরি হয় টেবিল, পাথুরে বা সামুদ্রিক লবণের সঙ্গে শুকনো রসুন বা সেলারি নামের বিশেষ সুগন্ধিযুক্ত গাছের পাতার মিশ্রণে। এটি তরকারিতে বিশেষ স্বাদ যুক্ত করে।
পরিশোধিত আয়োডিন লবণ: আমাদের খাবার টেবিলে হরহামেশাই আয়োডিনযুক্ত এই লবণের উপস্থিতি থাকে। এই লবণ বুদ্ধিবৃত্তিক এবং দৈহিক উন্নয়নের অক্ষমতাগুলো দূর করে।
লবণে যেসব পুষ্টিগুণ রয়েছে _
১ কাপ (২৯২ গ্রাম) লবণে ক্যালশিয়াম রয়েছে ৭০.১ মিলিগ্রাম, আয়রন ১.০ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ২৩.৪ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম ১১৩১৭৪ মিলিগ্রাম, সেলেনিয়াম ০.৩ মাইক্রোগ্রাম, ফ্লুরাইড ৫.৮ মাইক্রোগ্রাম, জিঙ্ক ০.৩ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেশিয়াম ২.৯ মিলিগ্রাম, কপার ০.১ মিলিগ্রাম, ম্যাঙ্গানিজ ০.৩ মিলিগ্রাম, পানি রয়েছে ০.৬ গ্রাম
এবার জানা যাক এ লবণের কিছু উপকারিতা _
মস্তিষ্ক সক্রিয় রাখে: সোডিয়াম শরীরের জল প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে, যা স্নায়ুতন্ত্রকে সঠিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। আর এই সোডিয়াম লবণে আছে। এছাড়াও এই সোডিয়াম মস্তিষ্ক সক্রিয় রাখতে সাহায্য করে।
ওজন হ্রাস করে: লবণ অতিরিক্ত ওজন হ্রাস করতে সাহায্য করে।
হাই ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে: যেসব ব্যক্তিদের ব্লাড প্রেসার হাই তারা খাবার সময় একটু লবণ খেতে পারেন। কারণ লবণ হাই ব্লাড প্রেসারকে লো করতে সাহায্য করে।
ইলেকট্রোলাইটের ঘাটতি পূরণ করে: আমাদের অনেক সময় প্রচণ্ড শারীরিক পরিশ্রম করতে হয়। এ সময় শরীর থেকে সোডিয়াম ও পটাশিয়ামের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইলেকট্রোলাইট বের হয়ে যায়। এক চিমটি লবণযুক্ত পানি খেলে ইলেকট্রোলাইটের ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়। তাতে স্নায়ুর কার্যকারিতা, পেশির সংকোচন এবং কোষের স্বাভাবিক কাজ বজায় থাকে।
স্নায়ু ও পেশি ভালো রাখে: স্নায়ুতে সঠিক সংকেত পাঠাতে এবং পেশির সংকোচনের জন্য অপরিহার্য হলো সোডিয়াম। এক চিমটি লবণযুক্ত পানি পর্যাপ্ত পরিমাণে সোডিয়াম সরবরাহ করতে পারে, যা পেশির খিঁচুনি প্রতিরোধ করে এবং স্নায়ুর কার্যকারিতা ঠিক রাখে।
হজমপ্রক্রিয়াকে সক্রিয় করে: লালা উৎপাদন করা এবং হজমকারী এনজাইম সক্রিয় করতে সাহায্য করে লবণ, যা হজমপ্রক্রিয়া শুরু করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এক চিমটি লবণযুক্ত পানি হজমশক্তি বাড়াতে পারে এবং পুষ্টি শোষণ উন্নত করতে সহায়তা করে।
টক্সিন দূর করে: লবণের জীবাণুনাশক গুণ শরীর থেকে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া ও টক্সিন দূর করতে সাহায্য করে। এক চিমটি লবণযুক্ত পানি খেলে দেহের ডিটক্সিফিকেশন প্রক্রিয়া আরও কার্যকর হয়।
ভালো ঘুম নিশ্চিত করে: লবণ স্ট্রেস হরমোন (কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিন) নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে। রাতে ঘুমানোর আগে অল্প লবণযুক্ত পানি খেলে এসব হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা হয়, যা ভালো ঘুম এনে দিতে পারে।
ত্বক ভালো রাখে: লবণে থাকা ম্যাগনেশিয়াম ও ক্যালসিয়ামের মতো খনিজ উপাদান ত্বকের জন্য উপকারী। খনিজসমৃদ্ধ লবণযুক্ত পানি খেলে শরীর এসব খনিজ পায়, যা ত্বককে হাইড্রেটেড ও নমনীয় রাখতে সাহায্য করে এবং ত্বককে আরও উজ্জ্বল করে তোলে।
শক্তি বাড়ায় ও ক্লান্তি দূর করে: কোষের শক্তি উৎপাদনের জন্য সঠিক ইলেকট্রোলাইট ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পানিতে এক চিমটি লবণ যোগ করলে এই ভারসাম্য বজায় থাকে, যা ক্লান্তি দূর করতে পারে এবং সারা দিনের শক্তি ধরে রাখতে সাহায্য করে।
লবণের অপকারিতা _
লবণ ছাড়া যে কোনো খাবার খাওয়া কঠিন। কারণ লবণ ছাড়া খাবারে কোনো স্বাদ পাওয়া যায় না। তবে অতিরিক্ত লবণ খাওয়া শরীরের জন্য বিপত্তির কারণ হতে পারে। হতে পারে নানা অসুখ। এবার জানা যাক লবণের কিছু অপকারিতা-
হাড়ের ক্ষতি: অতিরিক্ত লবণ খেলে হাড় থেকে ক্যালসিয়াম ক্ষয় হতে পারে। যা অস্টিওপরোসিসের সমস্যা হতে পারে।
শরীরকে ডিহাইড্রেশন করে দেয়: অতিরিক্ত লবণ খেলে শরীরকে ডিহাইড্রেশন করে তোলে।
শরীরে পানি জমে যাওয়া: অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ শরীরের কোষে পানি ধরে রাখার প্রবণতা বাড়ায়। এর ফলে শরীরে ফোলাভাব, ভারী অনুভূতি ও অস্বস্তি দেখা দেয়। বিশেষ করে লবণাক্ত খাবার খাওয়ার পর পেট ভার লাগার অনুভূতিই এর প্রমাণ।
অস্বাভাবিক ক্লান্তি: লবণের ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে শরীরের ইলেকট্রোলাইট ব্যাল্যান্স নষ্ট হয়, যা ক্লান্তি ও শক্তিহীনতার অন্যতম কারণ হতে পারে। যদি খাবার খাওয়ার পর প্রায়ই দুর্বলতা বা অলসতা অনুভব করেন, একবার খাবারে লবণের মাত্রা যাচাই করে দেখুন।
লবণ বেশি খেলে শরীরে পানি জমে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ে হজম ব্যবস্থায়। পেট ফাঁপা, অস্বস্তি, এমনকি কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যাও হতে পারে। যাদের পেট সংবেদনশীল, তাদের জন্য এটি আরও বেশি কষ্টকর হয়ে উঠতে পারে।
মাথাব্যথার প্রবণতা: অনিয়ন্ত্রিত লবণ গ্রহণ শরীরে পানিশূন্যতা তৈরি করে, যার ফলে মাথাব্যথা বা মাইগ্রেনের মতো সমস্যা দেখা দেয়। শরীর যখন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি ধরে রাখতে পারে না, তখন মস্তিষ্কে চাপ সৃষ্টি হয়, যা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি: লবণ বেশি খাওয়ার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো উচ্চ রক্তচাপ। সোডিয়াম রক্তনালীগুলোকে সংকুচিত করে, যার ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায়। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং কিডনি রোগের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
লবণ আমাদের শরীরে একদিকে বেশকিছু উপকার করলেও উপকারের তালিকাও কিন্তু কম নয়। তাই লবণ আমাদের খাবারের তালিকা থেকে যেমন বাদ দেয়ার সুযোগ নেই, তেমনি বেশি খাবারও সুযোগ নেই। তাই নিজের শরীরের প্রয়োজন বুঝে খেতে হবে লবণ। তাহলে এখন প্রশ্ন জাগে কতটা পরিমান লবণ খাওয়া উচিত আমাদের। আসুন জেনে নেই সে বিষয়েও-
কতটা পরিমাণ লবণ খাওয়া উচিত _
‘আমেরিকান হেলথ অ্যাসোসিয়েশন’-এর গবেষকদের দাবি, লবণে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হতে পারে। অতিরিক্ত লবণ খাওয়ার ফলে শরীরের পানি কমে যেতে পারে। ফলে ব্রেন স্ট্রোকের শঙ্কা বাড়ে। ক্ষয়ে যেতে থাকে হাড়ের ক্যালসিয়াম।
এছাড়া অতিরিক্ত লবণ খাওয়ার ফলে, মস্তিষ্কের নিউরোনকেও প্রভাবিত করে। কোলন ক্যানসার, পাকস্থলীর ক্যানসার ও শরীরে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ারসহ মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
কী পরিমাণ লবণ খাবেন, সে ব্যাপারে তথ্য জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, লবণ অতিরিক্ত বা খুব কম খাওয়া ঠিক নয়। তবে প্রতিদিন দুই গ্রাম বা হাফ চা চামচের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখুন লবণের পরিমাণ। এছাড়া কাঁচা লবণ খাওয়া যাবে না।