Monday 11 Aug 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

খাঁটি পণ্যের আকাল
ঘি, মধু ও সরিষার তেলের বাজারে ভেজালের ছড়াছড়ি

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)
১১ আগস্ট ২০২৫ ১৯:১৯

ভোজ্য তেল হিসেবে সরিষার তেল, রান্নার স্বাদ বাড়াতে ঘি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে মধু—এই তিনটি পণ্য বাংলাদেশের দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য। কিন্তু দেশের বাজারে এখন এসব পণ্যের খাঁটিত্ব নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে। উৎপাদন, চাহিদা, আমদানি এবং বাজারজাতকরণের জটিল সমীকরণে ভেজালের এক বিশাল সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে, যা একদিকে ভোক্তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলছে, অন্যদিকে দেশীয় উৎপাদনকারীদের জন্য তৈরি করছে এক অস্থিতিশীল পরিবেশ।

উৎপাদন বনাম চাহিদা: ঘাটতির বড় চিত্র _

বাংলাদেশে ঘি, মধু এবং সরিষার তেল এই তিনটি পণ্যেরই চাহিদা ব্যাপক, কিন্তু উৎপাদনের পরিমাণ চাহিদার তুলনায় অনেক কম।

বিজ্ঞাপন

সরিষার তেল _

ভোজ্য তেলের ক্ষেত্রে সরিষাই বাংলাদেশের প্রধান উৎস। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ভোজ্য তেলের চাহিদা প্রায় ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে সরিষা, তিল ও সূর্যমুখী থেকে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয় মাত্র ৩ থেকে ৪ লাখ টন, যা মোট চাহিদার মাত্র ১২-১৫%। অর্থাৎ, চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশই পূরণ করতে হয় আমদানির মাধ্যমে। সরকারের লক্ষ্য আছে ২০২৪-২৫ সালের মধ্যে স্থানীয়ভাবে তেলের উৎপাদন ১০ লাখ টনে উন্নীত করার, যা চাহিদার প্রায় ৪০% পূরণ করবে। এই বিশাল ঘাটতির কারণে বিদেশ থেকে পাম অয়েল এবং সয়াবিন তেল আমদানি করতে হয়, যা পরে বিভিন্ন অসাধু চক্রের হাতে ভেজালের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

মধু _

স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে মধুর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বিসিকের (বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন) তথ্য অনুসারে, দেশে গত কয়েক বছরে মধুর উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, বার্ষিক চাহিদার তুলনায় উৎপাদন এখনও অপ্রতুল। দেশীয় মধুর বাজার প্রায় ১,২০০ থেকে ১,৫০০ কোটি টাকা। প্রাকৃতিক ও চাষ থেকে বছরে ২০-২৫ হাজার টন মধু সংগ্রহ করা হলেও, আধুনিক প্রক্রিয়াজাতকরণের অভাবে প্রতি বছর প্রায় ২ হাজার টন মধু আমদানি করতে হয়। সুন্দরবনের মধু এর অন্যতম একটি উৎস হলেও, মৌচাষের মাধ্যমে উৎপাদিত মধুই দেশের বেশিরভাগ চাহিদা পূরণ করে।

ঘি _

ঘি-এর উৎপাদন মূলত দেশীয় দুগ্ধ উৎপাদনকারী অঞ্চলগুলোর ওপর নির্ভরশীল। পাবনা, সিরাজগঞ্জ এবং দেশের অন্যান্য দুগ্ধ উৎপাদনকারী অঞ্চলে ছোট-বড় অনেক ঘি উৎপাদনকারী কারখানা গড়ে উঠেছে। পাবনা জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, শুধু পাবনাতেই বছরে ৭ লাখ ৪৫ হাজার ৭২০ কেজি ঘি উৎপাদন হয়। তবে এর পাশাপাশি দেশজুড়ে যে বিশাল চাহিদা, তার তুলনায় এই পরিমাণ খুবই কম। তাই, অনেক ব্যবসায়ীই অতিরিক্ত মুনাফার লোভে ঘি-এর মধ্যে ভেজাল মেশানোর প্রবণতা দেখায়।

আমদানির উৎস এবং ভেজালের যোগসূত্র _

যেহেতু সরিষার তেল এবং মধুর চাহিদা স্থানীয় উৎপাদনের চেয়ে বেশি, তাই এই পণ্যগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। সরিষার তেলের ক্ষেত্রে সরাসরি আমদানি কম হলেও, এর কাঁচামাল অর্থাৎ সর্ষে বীজ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। অন্যদিকে, মধু সরাসরি বিদেশ থেকে আমদানি হয়, বিশেষ করে ভারত এবং চীন থেকে।

এই আমদানি নির্ভরতা অনেক ক্ষেত্রে ভেজালের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমদানিকৃত পণ্য, বিশেষত সরিষার তেল এবং মধু, মানসম্মত না হলে অথবা কম দামে নিম্নমানের পণ্য আমদানি করে দেশীয় পণ্যের সাথে মিশিয়ে বিক্রি করার সুযোগ তৈরি হয়। এছাড়াও, অসাধু ব্যবসায়ীরা পাম অয়েল, সয়াবিন তেল বা কৃত্রিম সুগার সিরাপের মতো সস্তা উপাদান ব্যবহার করে খাঁটি পণ্যের মোড়কে ভেজাল পণ্য বিক্রি করে।

অনলাইন ও অফলাইন বাজার: কোথায় আসল আর কোথায় নকল?

অনলাইনে এবং অফলাইনে ঘি, মধু এবং সরিষার তেলের বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে। কিন্তু এই বাজারের কতটুকু আসল এবং কতটুকু নকল, তা যাচাই করা কঠিন।

অনলাইন ই-কমার্স ও এফ-কমার্স: ফেসবুকভিত্তিক অসংখ্য ছোট-বড় অনলাইন শপ শতভাগ খাঁটি ঘি, মধু এবং সরিষার তেল বিক্রির দাবি করে। এই উদ্যোগগুলো অনেক ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান তৈরি করলেও, এর একটি বড় অংশই পরিচালিত হয় কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে। বিএসটিআইয়ের মান সনদ ছাড়া, নিম্নমানের প্যাকেজিং ব্যবহার করে এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এসব পণ্য তৈরি ও বিক্রি করা হয়। এতে করে গ্রাহকরা প্রায়শই প্রতারিত হন। ন্যাশনাল কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকও স্বীকার করেছেন যে, অনলাইনে খাদ্যপণ্য কেনার ক্ষেত্রে ভোক্তার প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।

অফলাইন বাজার: মুদি দোকান, সুপারশপ এবং স্থানীয় বাজারগুলোতেও ভেজালের ছড়াছড়ি। অনেক বড় বড় ব্র্যান্ডের পণ্যের মধ্যেও ভেজাল পাওয়া যায়। বিএসটিআই যদিও বিভিন্ন পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু বাজারের প্রতিটি দোকানে বা কারখানায় নিয়মিত নজরদারি করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। ফলে, অসাধু ব্যবসায়ীরা সহজেই তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারে।

প্রতারণার ফাঁদ এবং উত্তরণের উপায় _

গ্রাহকদের প্রতারিত হওয়ার মূল কারণ হলো সচেতনতার অভাব এবং পণ্যের মান যাচাই করার সুযোগের অভাব। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পণ্যের লেবেলে লেখা তথ্যের উপর অন্ধভাবে ভরসা করা হয়। কিন্তু ভেজালকারীরা এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে।

এই প্রতারণা থেকে বাঁচতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি _

১. সচেতনতা বৃদ্ধি: গ্রাহকদের মধ্যে খাঁটি এবং ভেজাল পণ্য চেনার উপায় সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। গণমাধ্যম এবং সরকারি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে এই ধরনের তথ্য প্রচার করা যেতে পারে।

২. বিএসটিআই অনুমোদন যাচাই: পণ্য কেনার আগে অবশ্যই প্যাকেজিং-এর উপর বিএসটিআইয়ের লোগো এবং লাইসেন্স নম্বর ভালোভাবে দেখে নিতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, অনেক ক্ষেত্রে অনুমোদিত কোম্পানির পণ্যের মোড়কে নকল পণ্য বিক্রি করা হয়।

৩. সরকারের নজরদারি: নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের নিয়মিত ও কঠোর অভিযান পরিচালনা করা জরুরি। অনলাইন এবং অফলাইন উভয় বাজারেই তদারকি জোরদার করতে হবে।

খাঁটি পণ্য চেনার সহজ উপায় _

গ্রাহকরা নিজেরা কিছু সহজ পরীক্ষার মাধ্যমে ভেজাল পণ্য চিনতে পারেন …

খাঁটি সরিষার তেল:
ফ্রিজিং পরীক্ষা: খাঁটি সরিষার তেল সহজে জমে না। একটি পাত্রে তেল রেখে ২-৩ ঘণ্টা ফ্রিজে রাখলে যদি তেল সাদা হয়ে জমে যায়, তবে সেটি ভেজাল।

ঝাঁঝালো গন্ধ: খাঁটি সরিষার তেলে তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ থাকে, যা চোখে পানি এনে দেয়। ভেজাল তেলে এমন ঝাঁঝ থাকে না।

রঙ: খাঁটি সরিষার তেলের রঙ গাঢ় হলুদ বা হালকা বাদামী হয়।

খাঁটি মধু:
আগুনে পরীক্ষা: একটি ম্যাচের কাঠির মাথায় সামান্য মধু লাগিয়ে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করুন। খাঁটি মধুতে আগুন জ্বলবে, কারণ এতে কোনো অতিরিক্ত জলীয় উপাদান নেই। ভেজাল মধুতে আগুন জ্বলবে না।

পানিতে দ্রবণীয়তা: এক গ্লাস পানিতে এক চামচ মধু ঢেলে দিন। খাঁটি মধু সহজে পানির সাথে মিশে যাবে না এবং গ্লাসের নিচে তলিয়ে যাবে।

টিস্যু পেপার পরীক্ষা: একটি টিস্যু পেপারে সামান্য মধু দিন। খাঁটি মধু টিস্যু পেপার শোষণ করবে না, কিন্তু ভেজাল মধু শোষণ হয়ে যাবে।

খাঁটি ঘি:
তাপ পরীক্ষা: একটি প্যানে সামান্য ঘি গরম করুন। খাঁটি ঘি দ্রুত গলে যায় এবং গাঢ় বাদামী রঙ ধারণ করে। ভেজাল ঘি গরম করলে সাদা ফেনা তৈরি হয় এবং এর রঙ হালকা থাকে।

পাম অয়েল পরীক্ষা: ঘি গরম করার পর ফ্রিজে রেখে দিন। যদি ঘি দুই স্তরে জমে যায় (উপরের স্তরটি হালকা এবং নিচের স্তরটি গাঢ়), তাহলে এতে পাম অয়েল মেশানো আছে। খাঁটি ঘি সম্পূর্ণভাবে এক স্তরবিশিষ্ট ও দানাদার হবে।

হাতের তালুতে পরীক্ষা: হাতের তালুতে সামান্য ঘি ঘষুন। শরীরের তাপমাত্রায় খাঁটি ঘি দ্রুত গলে যায়। ভেজাল ঘি সহজে গলে না।

ভবিষ্যতের পথচলা _

খাঁটি পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সরকারি এবং বেসরকারি উভয় ক্ষেত্র থেকে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সরকার কর্তৃক দেশীয় ঘি, মধু এবং সরিষার তেলের উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য কৃষকদের আরও সহায়তা প্রদান করতে হবে। একই সাথে, বিএসটিআই এবং নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের তদারকি আরও কঠোর করতে হবে, বিশেষ করে অনলাইন বাজারের উপর।

গ্রাহকদেরও সচেতন হতে হবে। শুধুমাত্র জনপ্রিয় ব্র্যান্ড বা অনলাইন শপের মোড়কে বিশ্বাস না করে, পণ্যের মান যাচাই করে কেনাকাটা করতে হবে। একটি সুস্থ ও ভেজালমুক্ত খাদ্য সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য ভোক্তা, উৎপাদক এবং সরকারের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। এই পদক্ষেপগুলোই পারে একটি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত বাজার নিশ্চিত করতে, যা দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার পাশাপাশি অর্থনীতির উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব

সারাবাংলা/এনএল/এএসজি

ঘি মধু ও সরিষার তেলের বাজারে ভেজালের ছড়াছড়ি মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর