ফ্যাশন জগৎ সবসময়ই নতুন অনুপ্রেরণার খোঁজে থাকে। প্রকৃতি, ইতিহাস কিংবা সংস্কৃতি— সবকিছুই পোশাকের নকশায় কোনো না কোনোভাবে জায়গা করে নেয়। সাম্প্রতিক সময়ে একটি বিশেষ ধারা ধরা পড়ছে— পোশাকে স্থাপত্যকলার মোটিফ ব্যবহার। ইটের গাঁথুনি, খিলান, মিনার, দরজার জ্যামিতি কিংবা জানালার অলংকরণ—এসব মোটিফ যেন কাপড়ের ক্যানভাসে নতুন ভাষায় গল্প বলছে।
স্থাপত্য থেকে ফ্যাশনে
স্থাপত্যকলা সবসময়ই মানুষের সৃজনশীলতার প্রতিচ্ছবি। যেমন আমাদের বাংলার প্রাচীন মন্দির ও মসজিদগুলোর টেরাকোটা অলংকরণ, অথবা ইউরোপের গথিক স্থাপত্যের খিলান। ফ্যাশন ডিজাইনাররা সেই সব নিদর্শন থেকে তুলে আনছেন রেখা, আকার ও অলংকরণ। কখনো ব্লক প্রিন্টের মাধ্যমে, কখনো এমব্রয়ডারি বা ডিজিটাল প্রিন্টে ফুটে উঠছে সেই মোটিফ।
একজন ডিজাইনার বলছিলেন, ‘স্থাপত্যকলা আর পোশাক— দুটোই আসলে সৌন্দর্য আর কাঠামোর খেলা। একটি পাথর আর ইট দিয়ে দাঁড় করানো, আরেকটি সুতো আর কাপড় দিয়ে বোনা।’
বাংলার ছোঁয়া
বাংলাদেশের ফ্যাশন হাউসগুলোতেও এই ট্রেন্ড ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে। লালগোলা মসজিদের জ্যামিতিক নকশা কিংবা পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের টেরাকোটা টালি এখন জামদানির আঁচলে বা কুর্তির গলার কাটে দেখা যাচ্ছে। এমনকি কারও কারও ডিজাইনে পুরনো ঢাকার জানালার লোহার গ্রিলের নকশাও শাড়ির বর্ডারে রূপ নিচ্ছে। এতে শুধু ফ্যাশন নয়, ইতিহাসের সঙ্গেও এক ধরনের সংযোগ তৈরি হচ্ছে।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় পুরোনো নকশা
শুধু ঐতিহ্য নয়, আধুনিক স্থাপত্যও এখন পোশাকের মোটিফে প্রভাব ফেলছে। বহুতল ভবনের কাচঘেরা জ্যামিতি, সেতুর বাঁকানো স্টিল স্ট্রাকচার, কিংবা মেট্রোরেলের সোজা লাইন—এসবও ডিজাইনারদের কাছে নতুন অনুপ্রেরণা। কালো-সাদা গ্রাফিক প্রিন্ট, জ্যামিতিক কাটা কাট, কিংবা অ্যাসিমেট্রিকাল পোশাক তার প্রমাণ।
বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা
পশ্চিমা ফ্যাশন জগতে অনেকদিন ধরেই স্থাপত্য থেকে অনুপ্রাণিত পোশাক জনপ্রিয়। প্যারিস ফ্যাশন উইকে প্রায়ই দেখা যায় আইফেল টাওয়ারের লাইন বা নটর ডেমের খিলান মোটিফের ব্যবহার। ভারতীয় ডিজাইনাররাও তাজমহল কিংবা রাজস্থানের প্রাসাদের জানালার ঝালরকে ব্লাউজ বা লেহেঙ্গার নকশায় ব্যবহার করছেন।
কেবল সাজ নয়, বার্তা
স্থাপত্যকলা যেমন ইতিহাস বহন করে, তেমনি পোশাকও সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ। তাই পোশাকে স্থাপত্যকলার মোটিফ আসলে কেবল সাজ নয়, বরং বার্তা। এটা জানান দেয় আমরা কোথা থেকে এসেছি, কীভাবে আমাদের শহর-গ্রাম দাঁড়িয়েছে, আর আমাদের সৌন্দর্যের ধারণা কেমন।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
ডিজিটাল প্রিন্ট ও থ্রিডি ফ্যাশন প্রযুক্তি আরও এগোলে এই ধারা আরও বৈচিত্র্যময় হবে। হয়তো ভবিষ্যতে আমরা এমন শাড়ি দেখব যেখানে স্মার্ট ফ্যাব্রিকের মাধ্যমে যমুনা সেতুর লাইট ঝলমল করবে, কিংবা এমন জ্যাকেট যেখানে ঢাকার আধুনিক স্কাইলাইন জীবন্ত হয়ে উঠবে।
শেষ কথা
পোশাকে স্থাপত্যকলার মোটিফ আসলে অতীত ও বর্তমানকে এক সুতোয় বেঁধে ফেলে। একদিকে প্রাচীন অলংকরণের গর্ব, অন্যদিকে আধুনিক জ্যামিতির সাহসী উপস্থাপন। এই মিশ্রণ শুধু চোখ ধাঁধানো নয়, বরং ফ্যাশনকে দেয় এক নতুন বর্ণময়তা।