বাঙালি জীবনের সঙ্গে আলপনার সম্পর্ক বহু পুরোনো। বিয়ে, পূজা কিংবা যে কোনো আনন্দঘন উপলক্ষে আলপনা আঁকতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ঘরের নারীরা। উঠোন, সিঁড়ি, ঘরের মেঝে, এমনকি দেয়ালে আঁকা নানান রঙিন নকশা জানান দেয় আমাদের শিল্পিত মননের কথা। এই সহজ অথচ সৃজনশীল শিল্প আজও বাঙালি উৎসব-সংস্কৃতির অন্যতম পরিচায়ক।
ঐতিহ্যের শিকড়
আলপনার শিকড় গ্রামীণ বাংলার গভীরে প্রোথিত। আগে চালের গুঁড়া, হলুদ কিংবা প্রাকৃতিক রঙ মিশিয়ে আঙুল দিয়ে নকশা করা হতো। ঘরের উঠোনে, নববধূর কনের ঘরে কিংবা পূজামণ্ডপে আলপনা আঁকত গ্রামের নারীরা। প্রতিটি নকশা যেন প্রার্থনা, শুভকামনা আর আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। বিশেষত বিয়ে কিংবা পূজা-পার্বণে আলপনা ছিল অপরিহার্য।
আধুনিক সময়ে আলপনা
সময় বদলেছে, তবে আলপনার আবেদন কমেনি। শহুরে জীবনেও আলপনার জায়গা রয়েছে সমানভাবে। পূজার সময় মণ্ডপে শিল্পীরা বিশাল আকারের আলপনা আঁকেন। বিয়ের বাড়িতে মেঝেতে আলপনার সঙ্গে সাজানো হয় প্রদীপ ও ফুল। আবার আধুনিক ফ্ল্যাটে অনেকে দেয়ালকেই আলপনার ক্যানভাস বানান। এখন তো বাজারে প্রস্তুত রঙিন পাউডার ও পোস্টার কালার সহজলভ্য—ফলে আলপনা আঁকা হয়ে উঠেছে আরও আকর্ষণীয়।
উৎসবের রঙে আলপনা
পহেলা বৈশাখ, দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজা কিংবা নবদম্পতির গৃহপ্রবেশ—সব উৎসবেই আলপনার বিশেষ ভূমিকা থাকে। বৃত্ত, ফুল, পাখি, পাতা, শঙ্খ কিংবা জ্যামিতিক নকশা দিয়ে আঁকা আলপনা শুধু সৌন্দর্য বাড়ায় না, উৎসবের আবহকেও উজ্জ্বল করে তোলে। বিশেষত মেয়েরা রঙিন আলপনা আঁকতে যেমন আনন্দ পান, তেমনি সবাই মিলে এই কাজে অংশ নিলে উৎসবের আনন্দ আরও বেড়ে যায়।
ফ্যাশন ও ডিজাইনে আলপনা
শুধু ঘরের মেঝেতে নয়, আলপনার নকশা এখন ফ্যাশন ও লাইফস্টাইলেরও অংশ। জামা-কাপড়, শাড়ি, কুর্তি বা স্কার্ফে আলপনার মোটিফ ব্যবহার হচ্ছে নকশার কাজে। আবার ঘরের দেয়াল, কুশন কভার, টেবিল রানার বা মৃৎশিল্পেও আলপনার ছাপ দেখা যায়। এর মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী শিল্প আধুনিক জীবনে নতুন রূপে ফিরে এসেছে।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে
আলপনা শুধু শিল্প নয়, এটি এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে পৌঁছে যাওয়া সংস্কৃতির ধারক। অনেক পরিবারেই উৎসবের দিনগুলোতে মায়েরা মেয়েদের শেখান কীভাবে আলপনা আঁকতে হয়। এতে শুধু সৃজনশীলতাই বাড়ে না, পারিবারিক বন্ধনও আরও মজবুত হয়।
আলপনা: শিল্প, আনন্দ আর ঐতিহ্য
আলপনা আঁকার আনন্দ এক বিশেষ অনুভূতি। রঙের ছোঁয়ায় তৈরি নকশা শুধু সৌন্দর্য নয়, বাঙালি সংস্কৃতির গভীরতা বহন করে। প্রতিটি আলপনা যেন আমাদের অতীতকে মনে করিয়ে দেয়, আবার বর্তমানের উৎসবকেও করে তোলে আরও অর্থবহ।
বাঙালি জীবনের উৎসবের সঙ্গে আলপনা জড়িয়ে আছে নিবিড়ভাবে। এটি কেবল মেঝে বা দেয়ালের রঙিন নকশা নয়, বরং শিল্প, আনন্দ আর ঐতিহ্যের অনন্য প্রকাশ। তাই বিয়ে, পূজা বা যেকোনো উৎসবেই আলপনা আঁকার ধুম পড়া যেন আমাদের শিকড়ের প্রতি টান ও রঙের মাধ্যমে জীবন উদ্যাপনের প্রতীক।