মেহেদী— নারীর সৌন্দর্যের অনন্য অলংকার। হাজার বছরের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ভালোবাসার প্রতীক এই সবুজ পাতার রঙ আজও নারীর রূপচর্চায় অপরিহার্য অংশ। বিয়ে, ঈদ, পূজা কিংবা যে কোনো আনন্দঘন উৎসব—সবখানেই হাত ও পায়ে মেহেদীর নকশা যেন সৌন্দর্যের পরিপূর্ণতা আনে।
ঐতিহ্য ও ইতিহাস
মেহেদীর ব্যবহার প্রাচীন মিসর, ভারত ও আরব সংস্কৃতিতে পাওয়া যায়। রাণী ক্লিওপেট্রাও নাকি নিজের হাত রাঙাতেন মেহেদীতে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে—বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা জুড়ে। আজও এটি নারীর সাজে আনন্দ, আস্থা ও ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে টিকে আছে।
প্রাকৃতিক রঙে সৌন্দর্যের ছোঁয়া
মেহেদীর পাতায় থাকে প্রাকৃতিক রঞ্জক, যা ত্বকের কোনো ক্ষতি করে না। বরং এতে থাকা অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান ত্বককে সতেজ রাখে। যারা রাসায়নিক রঙে অ্যালার্জিতে ভোগেন, তাদের জন্য খাঁটি মেহেদী নিরাপদ ও প্রাকৃতিক বিকল্প।
নকশায় ব্যক্তিত্ব
মেহেদীর নকশা শুধু সাজ নয়, এক ধরনের শিল্প। আরবি, ভারতীয়, মরোক্কান—বিভিন্ন ধাঁচের নকশা ব্যক্তিত্বে এনে দেয় ভিন্নমাত্রা। কেউ পছন্দ করেন হালকা ফুলেল ছোঁয়া, কেউবা জটিল জ্যামিতিক প্যাটার্ন। নকশা বেছে নিতে পারেন অনুষ্ঠান ও পোশাকের ধরন অনুযায়ী।
নকশা ও আল্পনার জাদু
মেহেদীর নকশা শুধু একটি অলংকার নয়, এটি এক ধরনের জীবন্ত শিল্প। হাতে বা পায়ে ফুটে ওঠা নকশাগুলো যেন উৎসবের ভাষায় সৌন্দর্যের কবিতা।
আরবি ডিজাইন: বড় বড় ফুল, লতা, পাতার মোটিফ—খোলা ফাঁকা জায়গা রেখে তৈরি হয় এই ডিজাইন, যা মার্জিত ও আধুনিক দেখায়।
ভারতীয় ডিজাইন: সূক্ষ্ম ও ঘন নকশা—বিয়ের কনে সাজে এই ডিজাইন সবচেয়ে জনপ্রিয়। এতে দেখা যায় ময়ূর, বর-কনের চিত্র কিংবা ধর্মীয় প্রতীক।
মরোক্কান ডিজাইন: জ্যামিতিক ও সিমেট্রিক্যাল প্যাটার্নের ব্যবহার—যা আধুনিক রুচির নারীদের কাছে বিশেষভাবে প্রিয়।
বাংলা আল্পনা ধাঁচ: আমাদের গ্রামীণ নারীরা আজও ফুল, পাখি, চাঁদ-তারার ছোঁয়া দিয়ে মেহেদীতে আল্পনার মতো নকশা আঁকেন।
মেহেদীর যত্ন ও টিপস
১. মেহেদী লাগানোর আগে ত্বক পরিষ্কার ও শুকনো রাখুন।
২. শুকানোর পর লেবু-চিনি মিশ্রণ হালকা করে লাগালে রঙ গাঢ় হয়।
৩. পেস্টে কয়েক ফোঁটা লবঙ্গতেল বা ইউক্যালিপটাস তেল মেশালে গন্ধ ও রঙ দুটোই সুন্দর হয়।
৪. রঙ স্থায়ী করতে পানি দিয়ে ধোয়া এড়িয়ে চলুন অন্তত ৮ ঘণ্টা।
মেহেদী: রূপ ও মনের রঙ
মেহেদী শুধু হাতের সাজ নয়—এটি আনন্দের ভাষা, ভালোবাসার প্রকাশ। মেহেদীর ঘ্রাণে যেমন থাকে উৎসবের আমেজ, তেমনি এর আল্পনায় মেলে ব্যক্তিত্ব ও রুচির প্রকাশ।
আজকের আধুনিক নারী ফ্যাশনের সঙ্গে মেহেদীকেও মিলিয়ে নিচ্ছেন নিজের স্টাইলে। কেউ পরছেন সোনালি বা রুপালি গ্লিটার মেহেদী, কেউবা অর্গানিক পাউডার দিয়ে তৈরি হরবাল মেহেদী।
যত্ন ও স্থায়িত্বের টিপস
মেহেদীর রঙ গাঢ় করতে লেবু-চিনি মিশ্রণ হালকা করে লাগাতে পারেন শুকানোর পর। রঙ বসার পর হাত ধোয়ার আগে অন্তত ৬-৮ ঘণ্টা অপেক্ষা করা ভালো। প্রয়োজনে মেহেদীর পেস্টে কিছুটা লবঙ্গতেল বা ইউক্যালিপটাস তেল মেশালে রঙ আরও উজ্জ্বল হয়।
শেষকথা
মেহেদীর রঙ ধীরে ধীরে মুছে যায়, কিন্তু এর সৌন্দর্য ও স্মৃতি থেকে যায় অনেক দিন। উৎসবের দিন হোক বা সাধারণ সময়—একটু মেহেদীর ছোঁয়ায় নারীর হাসি আরও উজ্জ্বল হয়, মনও হয় রাঙা।
কারণ, নারীর সৌন্দর্যের এই প্রাচীন অলংকার কেবল রঙ নয়—এ এক অনুভব, এক আনন্দ, এক শিল্প।