Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রোজ তাই মেয়েটাই টিপ দেয় কপালে


১৯ জুলাই ২০১৮ ১৪:৫০

টিপের নানারকম

ফারহানা ইন্দ্রা।।

অফিসে প্রেজেন্টেশন আছে বলে চিকন পাড়ের সুতি শাড়ি পরেছে ইশরাত। সাথে কাজল, হালকা লিপস্টিক আর ম্যাচিং ছোট্ট টিপ। ছিমছাম অল্প সাজ কিন্তু তাতেই বেশ আলাদা করে চোখে পড়ছে!

দৃক গ্যালারিতে প্রদর্শনী চলছিল নুসরাত জাহান লাকীর। নিজের প্রদর্শনীতে এসেছেন ক্যাজুয়াল ফতুয়া, জিন্স পরে। একদমই ন্যাচারাল কিন্তু কপালে আছে বড় একটা মেরুন লাল টিপ। জানালেন, টিপ পরলেই তার মনে হয় সাজটা সম্পূর্ণ হয়।

তাহমিনা পেশায় কলেজের শিক্ষক। তিনিও জানালেন, পোশাকের সাথে মিলিয়ে টিপ পরা ভীষণ পছন্দ তার। কখনো ম্যাচিং বা কন্ট্রাস্ট পরেন তিনি। একান্তই না মিললে কালো টিপ পরেন। টিপ এতই প্রিয় তার!

উপমহাদেশের টিপের ইতিহাস বেশ পুরানো। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের সঙ্গে সৌন্দর্য ভাবনার শুরু। কেবল নারী নয়, পুরুষেরাও প্রসাধন এবং সাজে যত্নশীল ছিল। এ অঞ্চলের পুরুষেরা লম্বা চুল রাখত। কোঁকড়ানো চুলে সুগন্ধি তেল মাখাত। তারা আকর্ষণীয় পুরুষ ছিল। পুরুষেরাও নখ রাঙাত।

এ সময় সৌন্দর্য সেবার উপকরণ তারা প্রকৃতি থেকে আহরণ করেছে। কখনো ফুল, কখনো পান, কখনো লাক্ষারস, কখনো হলুদের রঙ তারা প্রসাধনে ব্যবহার করেছে। আবির-সিঁদুর এসেছে। সেই প্রাচীনকাল থেকে নারীর কপালে, ঠোঁটে, আঁখিতে, সিঁথিতে রঙের সমাবেশ দেখা গেছে। এগুলো সংগ্রহ হয়েছে প্রকৃতি থেকে পাওয়া উপাদান থেকে। এটি একটি জনগোষ্ঠীর জীবনাভ্যাসের সাথে গড়ে উঠেছে। বাঙালির এ অভ্যাস তার হাজার বছরের সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত।

সাজের অংশ হিসেবে সৌখিন নারীরা লাক্ষারস অর্থাৎ লাল এক ধরনের তরল রঙ দিয়ে ঠোঁট রাঙাত। এ দেশে পারফিউম আসার আগে ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা ধুপ দিয়ে চুলে সুগন্ধ তৈরি করত। গোলাপের পাপড়ি বাহুমূলে রেখে সুগন্ধ তৈরি করত।

বিজ্ঞাপন

বাঙালি মেয়েদের কাজল ব্যবহার অনেক প্রাচীন। রান্নার চুলার কালির কালো রঙ থেকে এর উদ্ভব, পরে কপালে টিপ হিসেবে জায়গা করে নেয়। এরপর তারা কাজল তৈরি করে টিপ হিসেবে ব্যবহার করে। শিশুদের কপালে ব্যবহার শুরু হয়। মেয়েরা চোখে কাজল আঁকে। মেয়েরা আগে সিঁদুর ঠোঁটে দিয়ে ঠোঁট রাঙাত। লাক্ষারসে ঠোঁট রাঙানোর পাশাপাশি তারা কপালে লাল রঙ দেওয়া শুরু করে। এভাবে লাল আলতা রঙ মেয়েদের কপালে ঠোঁটে, কপালে এবং পায়ে জায়গা করে নেয়।

টিপ এই উপমহাদেশের ভারত, বাংলাদেশ, নেপালসহ শ্রীলংকা, মৌরিতানিয়া, থাইল্যান্ডেও প্রচলিত। ‍ওইসব দেশে টিপকে বলে বিন্দি। আক্ষরিকভাবে এর অর্থ দাঁড়ায় ফোঁটা । আশ্চর্যজনকভাবে ঋগ্বেদে টিপের উল্লেখ আছে, যা থেকে বোঝা যায় যে টিপের প্রচলন প্রায় ৫ হাজার বছর ধরে!

সেই ৬০ কিংবা ৭০ দশক থেকে নাট্যজন ফেরদৌসী মজুমদার সবসময়েই পরেন বড় গোল টিপ । সদ্যপ্রয়াত ভাস্কর মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী সবসময়েই পরতেন বড় গোল টিপ। হাতে আঁকা টিপও পরতেন তিনি । জনপ্রিয় নজরুল গীতি শিল্পী ফেরদৌস আরাকেও সবসময়ই শাড়ির সাথে ম্যাচিং টিপ পরতে দেখা যায় ।

ব্যান্ডদল লালন’র কণ্ঠশিল্পী সুমি। তার সাজের একটি বিশেষত্ব— সব পোশাকের সঙ্গেই তিনি সবসময় বড় টিপ পরেন। বাঙালি নারীর যে মাধুর্য, তা অনেকটা টিপের মাধ্যমেই ফুটিয়ে তোলা যায়— এমনটিই মনে করেন তিনি।

নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদ বলেন, টিপের গুরুত্ব অনেক। টিপ একটি মেয়ের সাজে পরিপূর্ণতা আনে। দুই ভ্রু’র মধ্যে যখন টিপ পরা হয়, মনে হয় সাজ সম্পূর্ণ হলো।

ষাট-সত্তরের দশকে কিংবা তারও আগের সাদাকালো সিনেমায় কিংবা তখনকার ছবিতে দেখা যায় স্লিভলেস ব্লাউজ, বড় খোঁপার সঙ্গে কপালে ভ্রু’র বেশ ওপরে একটা মাঝারি কিংবা ছোট্ট টিপ। ক্রমে সেই টিপের আকার এবং আকৃতিতে পরিবর্তন এসেছে। নব্বইয়ের দশকে চিত্রনায়িকা মৌসুমীর সাজে দেখা গেল লম্বাটে পাতা টিপ।

বিজ্ঞাপন

লম্বাটে, পাতা আকৃতির, চৌকো, দুই কালারের টিপ একটার ওপরে আরেকটা বসিয়ে, পাথর বা পুঁতি বসানো, ঝুনঝুনি, হাতে নকশা করে টিপ পরা— এরকম নানা এক্সপেরিমেন্ট শুরু হলো।

নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদের পছন্দের তালিকায় আছে আলপনা টিপ। যে শাড়িটি পরেন, তারই কিছুটা নকশা তিনি তুলে ধরেন দুই ভ্রুর মধ্যে। মুনমুন বলেন, আঁকতে আঁকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। খুব তাড়াতাড়ি এখন টিপ এঁকে ফেলতে পারি।

খুব সুন্দর করে আঁকার এ দক্ষতাই আলপনা টিপকে দিয়েছে ভিন্নধর্মী প্রাধান্য। কুমকুমের টিপের ইতিহাস অনেক অনেক আগের। রাজা-রানির কপালে শোভাবর্ধন করে এখন রয়েছে আমাদের সাজের তালিকায়।

ফ্যাশনসচেতন মানুষ অবশ্য দুই-তিন ধরনের মিশ্রণে টিপ পরেন। আলপনা টিপের সঙ্গে পাথর মিলিয়ে অথবা সাধারণ টিপের আশপাশ দিয়েও এঁকে নিচ্ছেন প্রয়োজনমতো। এছাড়া সাধারণ বড় টিপের নিচে ছোট একটি, পরপর নিচে বসানো ছোট পাথরের অথবা সাধারণ গোল টিপ পরে চারপাশ দিয়ে লাইন টেনে নিচ্ছেন। মোট কথা, পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে, রুচির সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটু ভিন্নভাব আনার চেষ্টা করেন সকলেই ।

এরকম চাহিদা থেকেই বেশকিছু অনলাইন দোকানেও হাতে আঁকা টিপ পাওয়া যায়। হাতে আঁকা টিপ নিয়ে কাজ করে অনলাইনভিত্তিক দোকান গীতিকা। এর ডিজাইনার রুবানা করিম জানান, সাধারণ টিপে নকশা করে নতুনত্ব ও বৈচিত্র্য আনা হয়। দেশে এবং বিদেশে বাঙালিদের মাঝে হাতে আঁকা টিপের কদর দিনে দিনে বেড়ে চলছে। যেকোনো নকশা টিপের ওপর ফুটিয়ে তোলা সম্ভব বলে জানান তিনি। তবে এর জন্য বেছে নিতে হবে একটু বড় ধরনের টিপ। ছোট টিপে নকশা ভালো বোঝা যাবে না ।

বাড়িতে বসে সহজেই টিপে নকশা এঁকে নিতে পারেন নিজেই। সেটা কীভাবে— জানালেন রুবানা করিম।

যা যা লাগবে—

  • বড় আকারের টিপ – ১ পাতা
  • ফ্যাব্রিক কালার – পছন্দমতো
  • তুলি – ১ ও ২ নম্বর আকারের একটি করে

এবার রঙ-তুলি দিয়ে মনের মতো নকশা এঁকে নিন টিপে। আর নতুনত্বের ছোঁয়ায় ষোলো আনা বাঙালিয়ানা ফুটিয়ে তুলুন নিজের সাজে ।

কপালে টিপ পরাটা একান্তই নিজস্ব স্টাইল এবং ব্যক্তিত্বের ওপর নির্ভর করে— এমনই মনে করেন ফ্যাশন ডিজাইনার তাহসিনা শাহিন। তিনি নিজেও টিপ পরতে পছন্দ করেন, বিশেষ করে শাড়ির সঙ্গে সবসময় টিপ ব্যবহার করেন। বললেন, শাড়ির সঙ্গে টিপ বেশি ভালো মানালেও সালোয়ার-কামিজ, লম্বা স্কার্ট কিংবা জিনস-ফতুয়ার সঙ্গেও দিব্যি টিপ মানিয়ে যায়। তবে সেটি নির্ভর করবে ব্যক্তিগত রুচি ও স্বাচ্ছন্দ্যের ওপর।

তাহসিনা শাহিন জানালেন, টিপ বাছাই করার সময় শাড়ির ধরন ও অনুষ্ঠানের বিষয় খেয়াল রাখা প্রয়োজন। জমকালো অনুষ্ঠানে বড় নকশা করা টিপ বেশি ভালো লাগবে। আবার টিপের সঙ্গে গয়নাও হতে হবে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

‘আর হাতে আঁকা টিপ নিজেই যেন একধরনের অলংকার। তাই বেশি গয়না পরার প্রয়োজন পড়ে না। গলায় লম্বা গয়না পরলে টিপ ছোট আর আঁটসাঁট গয়নায় সঙ্গে বড় টিপ ভালো লাগে,’— বলেন তাহসিনা শাহিন।

রূপবিশেষজ্ঞ অঞ্জলি মোস্তফা জানান, কপালের দিকটি খেয়াল করেও আমাদের টিপ পরা উচিত। যাদের কপাল আকারে ছোট, তাদের জন্য ছোট টিপ মানানসই। যাদের কপাল বড়, তারা বড় টিপ পরলেও সমস্যা নেই। বড় দুল পরলে সে ক্ষেত্রে ছোট আকারের টিপ পরলে ভালো লাগবে। তবে মাঝেমধ্যে ছাঁটের কিছুটা অদলবদল মন্দ লাগবে না।

টিপের আঠার কারণে অনেক সময় র‌্যাশ দেখা দিতে পারে। টিপ খোলার পর বেবি অয়েল দিয়ে আঠা মুছে ফেললেই এ ঝামেলার অবসান হবে জানালেন অঞ্জলি মোস্তফা।

সাধারণ টিপের পাতা পাওয়া যায় সব জায়গাতেই। ১০-২০ টাকা পাতা দাম হয় আকারভেদে। এছাড়াও কসমেটিক্সের দোকানে পাথর বসানো টিপ বিক্রি হয় পিস হিসেবে। ডিজাইনার চকমকে টিপও পাওয়া যায়। আকারভেদে এবং নকশার ওপর নির্ভর করে দাম।

এছাড়াও হাতে আঁকা টিপ অনলাইন কিছু পেজে পাওয়া যায়। প্রিয়জনকে চমকে দেওয়ার জন্য বাক্সভরা হরেক রকমের টিপের প্যাকেজ পাওয়া যাচ্ছে এখন।

শাড়ি, চুড়ি আর টিপেই যেন পরিপূর্ণ বাঙালি নারীর সাজ। একাল কিংবা সেকাল নয়, সব কালে এর আবেদন একই রকম। সাজপোশাকে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও টিপের চাহিদা বা আকর্ষণ কোনোটাই কমেনি। টিপের জয়গান এখন বাঙালিদের সীমানা ছাড়িয়ে অবাঙালির হৃদয়ও ছুঁয়ে গেছে। বৈশাখ, বসন্ত, নবান্ন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাদের সঙ্গে তারাও শরিক হন রঙিন টিপের সাজে। আর কিছুতে হোক না হোক— কপালে ছোট একটু রঙের ছোঁয়া তুলে ধরে আমাদের বাঙালিয়ানাকে।

ফিচার ফটো মডেল- বীথি সপ্তর্ষী

ডিজাইনার টিপ (ছবি)- দয়ীতা

সারাবাংলা/এসএস

কপালের টিপ টিপ ডিজাইনার টিপ বাঙালি নারীর সাজ বিন্দি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর