ব্লাউজ যখন অন্যরকম, শাড়ি তখন আনন্দের!
২০ আগস্ট ২০১৮ ১৫:৩০
রাজনীন ফারজানা।।
ব্লাউজ মানেই যে শাড়ির নিচে পরার আঁটসাঁট অন্তর্বাস তা কিন্তু নয়। ব্লাউজ শব্দটার উদ্ভব ফরাসি শব্দ ব্লাউজ থেকে যার অর্থ ডাস্ট কোট যা ফরাসি ক্রুসেডার বা ধর্মযোদ্ধারা পরত। ঐতিহাসিকভাবে ব্লাউজ হচ্ছে একধরণের কাস্ক (cask) বা পিপে স্টাইলের ঢিলেঢালা পোশাক। ঢোলা এই পোশাক কোমরের কাছে সেলাই করে, কুঁচি, বেল্ট বা কোমরবন্ধনী দিয়ে আটকে/চেপে রাখা হত একসময়।
১৮৬০’র দশকেই ইউনিসেক্স বা ছেলেমেয়ে সবার পোশাক হিসেবে জনপ্রিয় হতে শুরু করে ব্লাউজ। ইতালির বিখ্যাত দেশপ্রেমিক যোদ্ধা জোসেফ গ্যারিবল্ডি ও তার স্ত্রী আনিতাকে যুদ্ধক্ষেত্রে সেসময়ের জনপ্রিয় লাল রঙের গ্যারিবল্ডি শার্ট বা ব্লাউজ পরতে দেখা যায়। তবে ১৮৯০ এর আগ পর্যন্ত এইটা সর্বজনীনভাবে নারীদের পোশাক ছিল না। কৃষক, শ্রমিক, চিত্রশিল্পী ও শিশুরা পরত কোমর পর্যন্ত ঝুলের এই পোশাক। এখনকার দিনে ব্লাউজ মূলত মেয়েদের পোশাক হলেও একটু ঢোলাঢালা পোয়েট শার্ট আবার ইউনিসেক্স। রোমান্টিক সাহিত্যের যুগে বিখ্যাত ব্রিটিশ কবি লর্ড বায়রন এ ধরণের শার্ট বা ব্লাউজ পরতেন। তখনকার দিনের ব্রিটিশ নারীরাও এমন ব্লাউজ পরতেন। এরপর একটা সময়ে ইউরোপীয় পোশাক ব্লাউজ হয়ে ওঠে এই উপমহাদেশের নারীদের পোশাক।
তবে ঢোলাঢালা ইউরোপীয় ব্লাউজ এই উপমহাদেশের গরম আবহাওয়ায় এসে হয়ে ওঠে আঁটসাঁট ইনারঅয়্যার বা অন্তর্বাস।
আজ আমরা পেটিকোট আর ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি পরার কথা চিন্তা করতে না পারলেও ব্লাউজ আবহমান কাল ধরে বাঙালি নারীর পোশাক ছিল না। একটা সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের নারীরা ব্লাউজ ছাড়াই শাড়ি পরত। আমাদের দাদী নানীরা তাদের ছোটবেলায় আর তাদের মায়েরা আজীবন শাড়ির নিচে সেমিজ নামে এক ধরণের পোশাক পরতেন। আর সাধারণ মেয়েরা ব্লাউজ ছাড়াই শাড়ি পরত।
কিন্তু ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি পরার কথায় একসময় বেঁকে বসলেন একজন বাঙালি বধূ। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজ ভাই সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। শিক্ষাদীক্ষা ও সমাজকর্মে তিনি নিজেই নিজের পরিচয় তৈরি করে নিয়েছিলেন।
জ্ঞানদানন্দিনী দেবী এই নিয়মে আর শাড়ি পড়তে চাননি। স্বামী প্রথম ভারতীয় হিসেবে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে যোগদান করার পরে শ্বশুরবাড়ি কলকাতা থেকে বোম্বে গিয়ে থাকতে শুরু করেছিলেন তিনি। সেখানেই ইউরোপীয়দের সামাজিক বলয়ের মধ্যে পড়ে তিনি ইংরেজ আদবকায়দা রপ্ত করেন। এরপর স্বামীর সাথে গুজরাত বেড়াতে গিয়ে পার্সি নারীদের শাড়ি পরার ধরণ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে নতুন করে শাড়ি পরতে শুরু করেন। বামপাশে আঁচল দিয়ে শাড়ি পরার বর্তমান ঢং তিনিই চালু করেন। এতে করে ডান হাত ফ্রি থাকায় কাজ করতে সমস্যা হত না। আর ইংরেজ মহিলাদের দেখে শাড়ির নীচে ব্লাউজ আর স্কার্টের মত পেটিকোট পরতে শুরু করেন।
এরপর ঠাকুর বাড়ির অন্য মেয়েদের এভাবে শাড়ি, ব্লাউজ পরতে শেখান তিনি। এমনকি তখনকার দিনের জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’য় তার মত করে শাড়ি পরার পরামর্শ দিয়ে বিজ্ঞাপনও করেছিলেন তিনি। ব্রাম্ম সমাজে জ্ঞানদানন্দিনীর অনুগত ছাত্রী আইসিএস বিহারীলাল গুপ্তের স্ত্রী সৌদামিনী গুপ্ত তার অনুকরণে শাড়ি পরতে শুরু করেন। এভাবে কলকাতার ব্রাম্ম নারীদের মাঝে জনপ্রিয়তা পায় এই নতুন ধরণের শাড়ি পরার চল। জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর চালু করা এই শাড়ি পরার ধরণের নাম হয় ‘ব্রাম্মিকা শাড়ি’। এরপর আস্তে আস্তে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশের নারীরা তা অনুসরণ করতে শুরু করে।
শুরু থেকেই শাড়ির নিচে পরা হলেও ব্লাউজে নানা ধরণের ডিজাইন করা হয়। জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর ছবিতেও দেখা যায় তার ব্লাউজে লেইস, ফ্রিলের ব্যবহার। সময়ের সাথে সাথে ব্লাউজের কাট, হাতার দৈর্ঘ্য, গলার ডিজাইন, ব্লাউজের দৈর্ঘ্যে নানা পরিবর্তন এসেছে। কখনও বিখ্যাত নায়িকা সুচিত্রা সেনের ব্লাউজের কাট অনুসরণ করে কাঁধ ঢাকা সুচিত্রা কাট জনপ্রিয় হয়েছে তো কখনও পিঠখোলা ছোট দৈর্ঘ্যের ব্লাউজ।
নানা বিবর্তনের পর ব্লাউজ এখন আরও বেশি ফ্যাশনেবল আর ডিজাইনেও দেখা যাচ্ছে নানা বৈচিত্র্য। শুধু ডিজাইনেই নয়, ব্লাউজের ফেব্রিকেও দেখা যাচ্ছে বৈচিত্র্যের ছোঁয়া। কোন ব্লাউজ হয়ত বানানো হচ্ছে চকচকে চুমকির কাজ করা ফেব্রিকে, তো কোনটা তৈরি হচ্ছে পাতলা নেট কাপড় দিয়ে। এক রঙা কিংবা প্রিন্টেড কাতানের ব্লাউজ তো বেশ কয়েকবছর ধরেই চলছে। এখন আবার একটু আরামদায়ক কাপড়ের ভিন্নধর্মী ব্লাউজের দিকে মানুষের ঝোঁক বেশি। দৃষ্টিনন্দন এসব ব্লাউজকে তুলে ধরতে তাই শাড়ি পরার ঢঙেও এসেছে ভিন্নতা।
কুঁচি হাতা, হেমলাইনের অ্যাসিওমেট্রিক্যাল কাট, বদ্ধগলা, বোটনেক, হাতাকাটা, নেকলাইনে নেটের ব্যবহার, দুইরকম কাপড়ের ব্যবহার, পাইপিন, বর্ডার, লেইস- সব মিলিয়ে ব্লাউজ নিজেই এখন একটা আকর্ষনীয় পোশাক। সম্প্রতি কোন কোন ডিজাইনার ব্লাউজের পিছনের অংশে হ্যান্ডপেইন্টের মাধ্যমে পোশাকটিতে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছেন। কেউ বা ফতুয়া, শার্ট, জ্যাকেট কাটের ব্লাউজ বানিয়ে সেটাকে আলাদা করে টপস হিসেবে ব্যবহারের অপশন রাখছেন। ঠিক যেন অতীতের ইউরোপীয় ঢোলাঢালা পোশাক ব্লাউজ আবার নতুন রূপে ফিরে এসেছে।
শাড়ির পাশাপাশি জিনস, প্যান্ট, স্কার্ট, ড্রপ ক্রচ (drop crotch), কিউলটস (culottes) ইত্যাদির সাথে সিঙ্গেল টপ বা ক্রপ টপ হিসেবে পরার মত কনটেমপোরারি বা আধুনিক ডিজাইনের ব্লাউজ বানান শারমিন রহমান। এশিয়াটিক জেডাব্লিউটির অ্যাসোসিয়েট ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত শারমিন রহমান বলেন, তার বানানো ব্লাউজগুলো প্রত্যেকটাই ইউনিক বা আলাদা ডিজাইনের এবং একের বেশি শাড়ির সাথে পরার মত। প্রচলিত ওয়ান ডাইমেনশনাল টাইট ফিটেড ব্লাউজের থেকে আলাদা ধরণের ব্লাউজ উপহার দিতেই তিনি ব্লাউজ ডিজাইন করতে শুরু করেন। ম্যাটেরিয়াল হিসেবে খাদি, সুতি, এন্ডির সাথে নানা রঙের গামছা, ক্রুশের লেইস, টাসেলের ব্যবহার থাকে তার বানানো ব্লাউজে। সেই সাথে কাট এবং প্যাটার্নে রয়েছে আধুনিকতার ছোঁয়া।
দর্জিকে দিয়ে নিজেদের পছন্দমত ব্লাউজ বানিয়ে নেন অনেকেই। আবার আজকাল ফ্যাশন হাউজের পাশাপাশি অনলাইনেও পাওয়া যাচ্ছে বৈচিত্র্যময় ব্লাউজ। এমনই একটি অনলাইন বুটিক হাউজ রঙধনু ক্রিয়েশন। পিঠের দিকে বৈচিত্র্যময় হ্যান্ডপেইন্ট করা ব্লাউজ পাওয়া যায় এখানে।
কথা হল এই বুটিকের প্রতিষ্ঠাতা ও ডিজাইনার শাহানাজ সুলতানার সাথে। ভিন্নরকম ডিজাইনে ব্লাউজ বানানোর শুরু কীভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শাড়ি তার পছন্দের পোশাক। গতানুগতিক ম্যাচিং ব্লাউজ সব সময় পরতে ইচ্ছা হত না। আগে থেকেই শাড়ি আর কামিজে আঁকছিলেন, তাই পাশাপাশি ব্লাউজের জন্যও কিছু আঁকার পরিকল্পনা করেন তিনি। তার তৈরি ব্লাউজে হাতে আঁকা ফুল, প্রজাপতি, নারীর মুখের অবয়ব, নানারকম নকশা থাকে। আবার কাটের ধাচ পাল্টেও ব্লাউজ করে থাকেন, বলেন শাহনাজ।
ভিন্নধর্মী এসব ব্লাউজ কারা বেশি কেনেন জানতে চাইলে তিনি বলেন ২০ থেকে ৪০ বছরের নারীরাই তার মূল ক্রেতা। মূলত তরুণীরা কিনলেও অনেক প্রবীণ রুচিশীল নারীও তার ব্লাউজ কিনে থাকেন বলে জানান তিনি। আবার অনেক ক্রেতাই তাকে জানান যে ব্লাউজের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে শাড়ি পরা শুরু করছেন না আগ্রহী হয়েছেন।
ব্লাউজ নিয়ে ভিন্নধারার কাজ করেন ফ্যাশন হাউজ মানাসের ডিজাইনার ফাইজা আহমেদ। আমাদের দেশে শাড়ির আঁচল নিয়ে আলাদা মনোযোগ দিতে দেখা যায়। ট্র্যাডিশনাল ব্লাউজ আকারে ছোট হওয়ায় আঁচল পড়ে যাওয়া নিয়ে চিন্তায় থাকেন অনেকেই। ফাইজা আহমেদ চাইতেন ব্লাউজটাই এমনভাবে বানাবেন যাতে শাড়ির আঁচল নিয়ে অত মনযোগী না হলেও চলে। আবার ব্লাউজ যেন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। তাই তিনি ফতুয়া, জ্যাকেট, শার্ট স্টাইলে ব্লাউজ বানান যা আলাদা করে টপস হিসেবেও পরা যায়। ব্লাউজকে আরও কার্যকরী করতে ব্লাউজে আজকাল পকেট যোগ করছেন তিনি। সিঙ্গেল পিসের পাশাপাশি মানাসে মিলবে শাড়ির সাথে ম্যাচিং ভিন্নধারার ব্লাউজ। যেমন এখানকার রবীন্দ্রনাথের চিঠির থিমে বানানো শাড়ির ব্লাউজে হাতে বানানো ফুল, রুদ্রাক্ষ যোগ করে বৈচিত্র্য এনেছেন ফাইজা আহমেদ।
ফ্যাশন বদলের ধারায় ব্লাউজের ডিজাইন ও কাটেও এসেছে নানা পরিবর্তন। আধুনিক সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলা তারুণ্য সানন্দে বেছে নিচ্ছে এসব ব্লাউজ। নানারকম ব্লাউজের জন্য অনেকেই তাই শাড়ি পরেন আজকাল।
ফিচার ফটো মডেল- আত্রোলিতা
ফিচার ফটো ছবি- আশীষ সেনগুপ্ত
ছবি কৃতজ্ঞতা- রঙধনু ক্রিয়েশনস, মানাস ও শারমিন রহমান
সারাবাংলা/আরএফ/এসএস
জ্ঞনদানন্দিনী দেবী নানারকম ব্লাউজ পোয়েট শার্ট ব্লাউজ মানাস রঙধনু ক্রিয়েশনস