সূচীশিল্পীর ঘর- চোখ ফেরানো দায় যে অন্দরে
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৫:২২
রাজনীন ফারজানা।।
পেশায় তিনি সূচিশিল্পী। সারাদেশ থেকে নানা রকম সূচিকর্ম ও হস্তশিল্প সংগ্রহ করে দেশের শীর্ষস্থানীয় বুটিকশপে সরবরাহ করা তার পেশা। এসব সূচিকর্ম ও হস্তশিল্প তিনি নিজের ডিজাইনে বানিয়ে নিয়ে আসেন।
সূচিশিল্পী আমিনুল ইসলামের বাড়িটা যে নানা ধরণের বৈচিত্র্যময় শিল্পকর্মের প্রদর্শনীকেন্দ্র হবে সেটা আগে থেকেই অনুমান করতে পারছিলাম। কিন্তু ঢাকার বিখ্যাত জ্যাম ঠেলে পল্টন থেকে সুদূর দক্ষিণখান যেতে যেতেই ক্লান্তিতে আর কিছু ভালো লাগছিল না। তবে নানা অলিগলি পার হয়ে সবুজে মোড়ানো বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মুগ্ধতা ঘিরে ধরল আমাদের (আমি আর আর আমার সহকর্মী ফটোগ্রাফার এরিন)। সবুজ বাড়িটার বাইরের রূপ দেখেই আমাদের সব ক্লান্তি নিমেষে উধাও। বাড়িটার অন্দরমহলে আমাদের জন্য কী বিস্ময় অপেক্ষা করছে তখনও জানিনা।
দারোয়ানের সাথে দোতলা যেতে যেতেই সিঁড়ির দেওয়ালে হস্তশিল্পের নমুনা দেখতে পেলাম। দোতলার যে ঘরে হস্তশিল্পী আমিনুল ইসলাম আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন সেটা তার ওয়ার্ক স্টেশন। চারদিকে অপূর্ব সব হাতের কাজের জিনিসের ছড়াছড়ি। দেওয়ালে ঝুলছে বড় বড় ওয়াল হ্যাঙ্গিং যেগুলোতে সুই সুতার সাহায্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নিপুন সব কারুকার্য।
আমিনুল ইসলাম জানালেন এর বেশিরভাগ কারুকার্যই তার নিজের ডিজাইন করা। এই নিয়েই তিনি আছেন গত আটাশ বছর ধরে। শিল্প নিয়েই তার বসবাস। তিলে তিলে গড়ে তোলা এই সবুজ নিবাসে নিরিবিলিতে তিনি শিল্পের চর্চা করেন। নিজের বাড়িতেই ওয়ার্ক স্টেশন। শুধুমাত্র পেশাগত কাজে ঢাকার কোলাহলময় পরিবেশে আসেন কয়েক ঘন্টার জন্য। বাকি পুরোটা সময় এই শান্তির নীড়ে শিল্পের সাধনা করে আর প্রিয় গাছপালার মাঝে কাটান। এই বাড়ির প্রতিটা আসবারের ডিজাইন থেকে শুরু করে বাড়ির পুরো ইন্টেরিয়র তিনি নিজেই করেছেন। প্রতিটা কাঠের আসবাব নিজে ডিজাইন করে কাঠমিস্ত্রী বাসায় এনে কাজ করিয়েছেন।
দোতলার অফিস কক্ষেই অসাধারণ সব স্টিচের কাজের নমুনা দেখে ওনার বাসা দেখার জন্য তর সইছিল না যেন। ফরমাল কথাবার্তা সেরে উপরে যাওয়ার প্রস্তাবে লাফিয়ে উঠলাম তাই। তিনতলা যাওয়ার সিঁড়ির দেওয়ালেও দারুণ সব ওয়াল হ্যাঙ্গিং ঝুলছে। তিনতলার বসার ঘরের দরজা খোলার সাথে সাথে মুগ্ধতা আর বিস্ময়ে দুজনেই ‘ওয়াও’ বলে উঠলাম। খোলামেলা বিরাট ঘরটায় সাদা টাইলের মেঝেতে যেন আমন্ত্রনের গন্ধ।
ঘরে ঢুকে যেদিকে তাকাই সেদিকেই চমৎকার সব জিনিসে চোখ আটকে যায়। কি রেখে কি দেখব বুঝে পাইনা। এরিন এদিকে জানতে চাচ্ছে কিসের কিসের ছবি তুলবে। আমি বললাম একদিক থেকে শুরু করে একে একে সবকিছুর ছবিই যেন তুলে ফেলে। প্রাথমিক উত্তেজনা কেটে গেলে ভাবলাম একদিক থেকেই দেখতে শুরু করি।
সবার আগে দৃষ্টি কেড়ে নেয় দরজার বরাবর কাঁচের দেওয়ালের বাইরের সবুজ বাগান। না, ঠিক ব্যালকনির টবের বাগান না, কিছুটা ভিন্ন। কাছে গিয়ে দেখা গেল বারান্দায় কিছুটা গভীর করে মাটি ফেলে সেখানেই গাছপালা লাগানো হয়েছে। কিছু টবও আছে। উপর থেকেও ঝুলছে গাছ। বুঝলাম, উপরের ফ্লোরগুলোতেও একইভাবে হ্যাঙ্গিং ওপেন গার্ডেন করা হয়েছে। আর এই হ্যাঙ্গিং গার্ডেনগুলোর জন্যই বাড়িটাকে বাইরে থেকে দেখলেই সবুজে মোড়ানো লাগে।
তিলে তিলে গড়ে তোলা স্বপ্নের বাড়িটার বসার ঘর সাজাতে মিনিমালিস্টিক ধারা বজায় রেখেছেন আমিনুল ইসলাম। বিশাল স্পেসজুড়ে টুকরো টুকরো সিটিং এরেঞ্জমেন্ট। হ্যাঙ্গিং গার্ডেনের ধারে বসানো ছোট্ট কালো চেয়ার আর টেবিল। বাইরে যখন মুষলধারে বৃষ্টি, তখন এক কাপ গরম কফির মগ হাতে বসে একটা বিকেল কাটিয়ে দেওয়ার জন্য একদম পারফেক্ট প্লেস। কফির মগে ধীরে ধীরে চুমুক দিতে দিতেই নানা রকম গাছের পাতায় ঝরে পড়া বৃষ্টির জল আপনাকে মনোমুগ্ধ করবেই। এইসব সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অনুভুতির স্বাদ পেতেই আমিনুল ইসলামের বাড়িতে এতো গাছপালার সমারোহ।
পেশাগত কাজেই নানা জায়গায় শিল্পের/ শিল্প বস্তুর খোঁজে যেতে হয় আমিনুলকে। যেখানেই যান সেখান থেকেই কাঁসা, পিতল, স্টিচের কাজ সংগ্রহ করেন। সেসবের নমুনা ছড়ানো পুরোটা ঘর জুড়ে। একটা লম্বা পিলারের পাশের দুটো দেয়ালজুড়ে টেরাকোটার সমারোহ। কথায় কথায় জানলাম, অনেকদিন ধরে দেশের নানা জায়গা থেকে জমিয়েছেন টেরাকোটার টুকরোগুলো। তারপর এই দেওয়ালে জায়গা পেয়েছে মূল্যবান সেসব টেরাকোটার টালি।
প্রতিটা টেরাকোটায় যদি অলঙ্কৃত থাকে আলাদা আলাদা কারুকার্য ঘরের মাঝ বরাবর হ্যাঙ্গিং গার্ডেনের পাশের এক পিলারে দেখতে পাবেন লম্বা একটা সূচিকর্মের ওয়াল হ্যাঙ্গিং। লম্বা ফ্রেমটাতে ভাগে ভাগে আলাদা আলাদা সাতটা গল্প ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নিপুন সূচিকর্মের মাধ্যমে। সব ছবিতেই গ্রামীন কৃষিজীবী সমাজের জীবনযাপন উঠে এসেছে। কোথাও কৃষক বাঁশি বাজাচ্ছে। পিঠ ঘেঁষে বসা মুগ্ধ শ্রোতা তার প্রেয়সীই হবে। কোন ফ্রেমে আবার কাজে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ঘরণীর কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে কৃষক স্বামী। আবার কোনটাতে গ্রামীন বধূ সারাদিনের কাজ শেষ করে উঠোনে নকশিকাঁথা সেলাইয়ে ব্যস্ত। এমন কিছু গ্রামীণ গল্প সুই সুতোর বুননে উঠে এসেছে একটি ফ্রেমে।
সূচিশিল্পীর বাড়ি এসে এমন চমৎকার হস্তকর্মের নমুনা না দেখলে এখানে আসাটাই যেন ব্যর্থ হত। সূচের কাজের এমন নিদর্শন আরও কিছু আছে এই বাড়িতে।
বসার ঘরের নানা জায়গায় প্রচুর পিতল ও মাটির জিনিসের নমুনা সাজানো আছে। শিল্পকর্মের মিনি জাদুঘর বসার ঘরের একপাশে সূক্ষ্ম কাজের কাঠের স্টেয়ারকেস ও সিঁড়ি। সিঁড়ির নীচের অংশ পিতলের হাড়ি, পাতিল, গ্লাস, জগ, চামচ থেকে শুরু করে কত কি। এখানে একটা পুরনো দিনের লোহার সিন্দুকও আছে। এসব জিনিস নিজের আর শ্বশুর বাড়ি থেকে তো এনেছেনই, আত্মীয়রাও তাদের বাড়িতে থাকা পুরনো দিনের কাঁসার জিনিস এ বাড়িতে পাঠিয়ে দেন যত্নে সাজিয়ে রাখার জন্য।
বসার ঘরের এক কোণে চোখ কেড়ে নেবে দারুণ একটা কাঁসার তৈরি রথ। রথে বসে আছেন রাজা রাণি কিংবা রাধা কৃষ্ণ। পুরো রথটাই দারুণ সূক্ষ্ম কারুকাজ করা। হাতে তৈরি অমূল্য এই জিনিসটি ধামরাই থেকে সংগ্রহ করা।
অন্যদিকে টিভির পাশে মেঝেতে একটা মাটির কলস। আমিনুল ইসলাম জানালেন তার গ্রামের বাড়িতে তার মায়ের ব্যবহৃত কলসটা স্মৃতি ধরে রাখার উদ্দেশ্যেই এনে রেখেছেন এখানে। আধুনিকতার সাথে ঐতিহ্যের মিশেলের সৌন্দর্য ধরা পড়ল আবার।
সিঁড়ির সামনের দিকে দেওয়ালে একটা প্রত্নতাত্ত্বিক কারুকার্যময় ড্রেসিং টেবিল। লম্বা পায়ার টেবিল আর ডেস্কের সাথে এটাচড খাটো আয়না। টেরাকোটা টাইলের দেওয়ালের পাশে রাখা রংজ্বলা ড্রেসিং টেবিলটা অন্য মাত্রার সৌন্দর্য যোগ করেছে ঘরটাতে। পুরনো দিনের পিতলের পাউডারদানি আর ছোট ছোট পিতলের পুতুল সাজিয়ে রাখা হয়েছে ডেস্কের উপর।
উপরের শোবার ঘরটাও বিশাল। এ ঘরের আসবাব সজ্জায়ও খোলামেলা ভাবটা বজায় রাখা হয়েছে। এই রুমের বাইরেও দোতলার মতই হ্যাঙ্গিং ওপেন গার্ডেন। একপাশে বিরাট বারান্দা। সেই বারান্দা সকাল সন্ধ্যায় পাখিদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে থাকে। এখানে বসে থাকলে কে বলবে আপনি ইটকাঠের জঞ্জাল এই ঢাকায় আছেন!
ডাইনিং রুমে ওপেন কিচেন সিস্টেম রাখা হয়েছে। সেখানেও একপাশের নীচু দেওয়ালে সাজিয়ে রাখা পিতলের বাসন কোসন।
এরপর আমরা গেলাম ছাদবাগান দেখতে। নিচের সিঁড়িগুলোর মতই অন্যান্য সিঁড়ির দেওয়াল জুড়েও ফ্রেমে বাঁধানো কাপড়ে কাঁথা স্টিচ, ফটোগ্রাফ বা অন্য কোন ওয়াল হ্যাঙ্গিং দিয়ে সাজানো।
ছাদ বাগানটা দুই ভাগে বিভক্ত। নিচের অংশে ছাদের চারধারে উঁচু করে ঘিরে মাটি ফেলে বাগান করা হয়েছে। আমলকি, আম, সফেদা, সজনের মত বড় বড় গাছের পাশাপাশি এখানে ছোট ছোট অন্যান্য গাছও আছে। সেখানে বারো তেরো বছর আগের গাছও আছে যাদের কালো হয়ে যাওয়া গুঁড়িতে রোদ বৃষ্টির চিহ্ন আঁকা। লোহার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই আরেক জগত। সবুজে ঘেরা এই জগতে সাজানো হাতের ছোঁয়ার মাঝেও আছে প্রাকৃতিক পরিবেশ।
আলাদা আলাদা গার্ডেন বেডের পাশাপাশি এখানে আছে ছোটবড় নানা আকারের টব। একপাশের গার্ডেন বেডে বিরাট এক আমলকি গাছের নিচে কংক্রিটের ছোট পুকুর। পুকুরের জলে পদ্মপাতা আর কচুরির ফাঁকে ফাঁকে রঙিন মাছের উঁকিঝুকি। ছাদের ফ্লোরে আরও কিছু ছোটবড় মাটির ও প্লাস্টিকের গামলায় একইভাবে রঙিন মাছের আনাগোনা।
ছাদের এই অংশের অন্যদিকেও ধাপে ধাপে করা গার্ডেন বেডে ঢেঁড়স, পেঁপে, করলা, মরিচসহ নানারকম ফুলের গাছ। এই জায়গাটায় গাছের বুনন এত ঘন যে এক মুহুর্তে মনে হয় বুঝি কোন ছোটখাট জঙ্গলেই চলে এলাম। আমগাছের নিচে বসে চুপটি করে বিকেলের চা উপভোগ করতে করতে সন্ধ্যা নামার অপেক্ষা করাই যায় এখানে। পুরো ছাদের চারপাশ ঘিরেই টবে ফল, ফুল আর সবজির গাছ। একপাশে আছে জুঁইফুলের গাছ ঘেরা আখের ঝোপ। মাথার উপর মাচায় ঝুলন্ত চালকুমড়ো আর করলার মাঁচায় ঝুলন্ত কচি করলা মনে করাবে গ্রামের বাড়ির স্মৃতি। এভাবেই এই বাড়ি জুড়ে ক্ষণে ক্ষণে গ্রামীণ জীবনের নস্টালজিয়া উঁকি মেরে যায়।
ঝিনাদহের যে গ্রামে বেড়ে উঠেছেন সেই বাড়ির চারপাশে ছিল নানারকম গাছগাছালি সেই স্মৃতি ধরে রাখতেই আমিনুলের যত চেষ্টা। সেই সাথে নতুন প্রজন্মকে গাছের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে তার বাড়িময় এতো গাছ আর গাছ। গাছের প্রতি গভীর মমতার কারণে ছয়তলা এই বিশাল বাড়িতে কোন এসি নাই। পাছে, এসির ক্ষতিকর গ্যাসে গাছগুলোর কষ্ট হয়।
বাড়ি সাজানোর অনুপ্রেরণা কোথায় পেলেন জিজ্ঞাসা করাতে জানতে পারলাম শুধু গাছাপালাই নয়, ইতিহাস, ঐতিহ্য আর বাঙ্গালিয়ানার প্রতিও আমিনুল ইসলামের অসম্ভব টান। সেই টান থেকেই তার বাড়ি জুড়ে স্মৃতিময়তার ছড়াছড়ি। জানালেন ছোটবেলা থেকেই নানারকম দেশি বিদেশি ম্যাগাজিনে ঘর সাজানো দেখতে ভালোবাসতেন। সেই থেকেই মনের মাঝে স্বপ্ন বুনতেন মনের মত করে সাজাবেন নিজের স্বপ্নের বাড়ি। সেই স্বপ্ন পূরণ করতেই নিজের শিল্পী মনের পুরোটা ঢেলে দিয়ে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তিলে তিলে এই বাড়ি গড়েছেন ও সাজিয়েছেন। আমিনুল ইসলামকে দেখে ও তার কথা শুনেই মনে হল কিছু মানুষ তার স্বপ্নের মাঝেই শুধু বাঁচে না, সেই স্বপ্নকে সত্যি করতেই ভালোবাসে।
ছায়াময় এই সুন্দর বাড়ি থেকে বের হতে হতে ভাবছিলাম, এই বাড়ির সবুজ মায়া দীর্ঘদিন ধরে এই নগরের ইট কাঠের রাজত্বে অক্সিজেনের জোগান দিয়ে যাবে আমাদের।
আলোকচিত্র- আবদুল্লাহ আল মামুন এরিন
সারাবাংলা/ আরএফ/ এসএস