ছাদবাগানের বন্ধুরা…
১৩ অক্টোবর ২০১৮ ১৫:২৬
পর্ব-৩১।।
প্রাকৃতিক উপায়ে নির্ভর চাষাবাদে সবচেয়ে বেশী যন্ত্রণা দিয়ে থাকে পোকা মাকড়। আমার ছাদ বাগানের বয়স সাড়ে ছয় বছর হতে চলেছে। বাগানে দত্তক নেয়া গাছেরা অত্যন্ত নাজুক প্রকৃতির। একদিকে হাতির ঝিলের জমা জলের অস্বাস্থ্যকর বাতাস সরাসরি ছাদে আসে। আবার আরেকদিকে ছাদবাগানের গাছগুলোকে বিষমুক্ত রাখার জন্য কোন ওষুধ না দেওয়াতে পোকা মাকড়ের আক্রমণ হয় খুব বেশি।
গত দুই বছরের আবহাওয়া এতো বেশি দুর্বোধ্য ছিল যে কোনটা রাখবো আর কোনটা আগে করবো বুঝে উঠতে সময় গেছে অনেকটা। যেদিন থেকে বাগান করা শুরু করেছি তার পর থেকে এই দুই বছরের চাষাবাদে যে খাটুনি গেছে এমনটা আর কখনোই হয়নি। একবার হঠাৎ বৃষ্টিতে শীতের সবজির চারা সব নষ্ট হয়ে গেল। এদিকে বৃষ্টির পর গোবর মেশানো মাটিতে কেঁচো আর শামুক জন্ম নিয়েছে প্রচুর। এগুলো বাগানের সব শাক জাতীয় চারাদের আক্রমণ করেছে একাধারে। দেখে কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি সাধারণত রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করিনা। তাই আমার সবচেয়ে প্রিয় ওষুধ ‘ছাই’ দিলাম। কিন্তু দেখলাম তাতে কোন কাজ হচ্ছে না। আর কেঁচোর তুলনায় শামুক দেখা যেত বেশি।
আমি তো একসময় হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে বসে ছিলাম। ভাবতে শুরু করেছিলাম এবার বুঝি লাউ আর শিমের চারাগুলোকে বাঁচাতেই পারবো না। ছাদে যত রকমের শাক ছিল, বড় হওয়ার আগেই সব তুলে ফেলতে হয়েছে। দিনের পর দিন চিন্তা করেছি কি করব তাই নিয়ে। কেঁচোর কথা বাদ দিয়েছিলাম। কিন্তু শামুকের হাত থেকে গাছ বাঁচাতে কি করব তা জানতে চেয়েছি অন্যান্য গাছপ্রেমীদের কাছে। শামুক নিধনের তেমন কোন উপায় বলতে পারেনি কেউ। অতঃপর শেষ ভরসা গুগলের কাছে জানতে চাইলাম সমাধান। সেখানে কয়েকটা উপায় বলা ছিল।
সেগুলো থেকে আমার সাধ্যের মাঝে আছে এমন একটা সমাধান বেছে নিয়ে পরদিনই কাজে লাগালাম। শামুক শুধুমাত্র বিকালের পর বের হয়। যতক্ষণ আলো থাকে তাদের দেখা যায় না। তাই সন্ধ্যায় শামুক যেখানে বের হয় সেখানে কফির গুঁড়ো ছিটিয়ে দিতে হবে। কফির তীব্র ঘ্রাণে নাকি শামুক পালিয়ে যায়। ঘরে থাকা কফির বয়ামের অর্ধেক শেষ করে নিশ্চিন্তে ঘুম দিয়েছিলাম সে রাতে। পরদিন সন্ধ্যায় গিয়ে দেখি তারা কফি খেয়ে হজম করে লাল শাকের চারা খাচ্ছে।
এবার দ্বিতীয় সমাধান নিয়ে কাজে লাগলাম। ড্রাম আর টবের চারিদিকে ডিটারজেন্ট পাউডার ছিটিয়ে রাখলে সেটার তীব্র ঘ্রাণে শামুক শুধু পালাবেই না, একদমই দূর হয়ে যাবে। এক কেজি ডিটারজেন্ট এনে সেভাবেই ছিটালাম একবার। দুই তিনদিন তাদের দেখা মিললো কম কম। এর মাঝে বৃষ্টির জলে ডিটারজেন্ট সব ধুয়ে মুছে গেলো। বৃষ্টি শামুকদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসে চার পাঁচদিনের মাথায় আবারও তাদের হেসে খেলে ঘুরে বেড়াবার সুযোগ দিয়ে গেলো। তবে সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, শামুক বৃদ্ধির কারণে আমার ছাদবাগানের সবগুলো গাছের বৃদ্ধিও দারুণ ভাবে চোখে পড়তে লাগল। ছেলেবেলায় সায়েন্স বইয়ের কথা সত্য প্রমাণিত হয়। শামুককে প্রাকৃতিক কোদাল বলা হয়। তাদের চলাচল এবং জীবন চক্র মাটিকে উর্বর করে তোলে।
এর মাঝে হঠাৎ একটি বিদেশী প্রবন্ধ চোখে আসলো আমার। তার শুরুর লাইনগুলো ছিল, তোমার বাগানের শষ্যকণা যদি পাখী, শামুক, ঝিনুক, মৌমাছি, কাঠবেড়ালীরা নিভৃতে না খেয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে তোমার বাগান পরিবেশবান্ধব নয়। তাছাড়াও খেয়াল করলাম, প্রায় দুই বছর শামুকের অত্যাচারে আমার গাছের ফলন এবং বৃদ্ধি তুলনামূলক ভাবে আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। এই বিষয়ে খোঁজ নিতে নিতে আরো জানতে পারলাম যে কেঁচোর মতনই শামুকও গাছপালার জন্য ভীষণ উপকারী। তারা যেসব খাবার হজম করতে পারেনা, সেগুলো মুখ দিয়ে বের করে দেয়। এগুলো সারা হিসেবে চমৎকার।
এটা পড়ার পর গত দুই তিনমাস ধরে আমি শামুকদেরকে তাদের মতই থাকতে দিয়েছি এবং তারা সকলে পরিবার পরিজন নিয়ে আমার ছাদবাগানে অত্যন্ত আনন্দে সময় কাটাচ্ছে। ভিমরুল আর মৌমাছিরা সোনালু, জারুল আর ফুরুসের পাতা খেয়ে যাচ্ছে, বিরক্ত করি না। শুয়োপোকা জামরুল, অড়বরই আর শিউলীর পাতায় ঝুলে ঝুলে বাতাস খায়, খবরই নেই না। পেয়ারা, কামরাঙা আর পেপে টিয়া, বুলবুলী শালিক, কবুতর, চড়ই, টুনটুনী আর দোয়েলেরা গাছের ফলগুলো খুঁটে খু্ঁটে খেয়ে রেখে যাচ্ছে, তাদের সাক্ষাত পাওয়াই যায় না। মনে হয় যেন পুরো ছাদবাগানটা যেন ওদেরই, আমি শুধু দেখভাল করি।
আমার ছাদবাগানের অভিজ্ঞতা আমাকে গাছপালা পশুপাখি সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। মনে হয় পৃথিবীর সকল প্রাণের মত আমিও একটি প্রাণ। তাদের সাথে ছন্দ মিলিয়ে প্রাণের জীবনচক্রের পরিপূর্ণতাকে কাছ থেকে দেখতে দেখতে সময় পার করি। বৃক্ষ পিতা হয়ে, ফুলের ঘ্রাণে প্রিয়জন হয়ে, ফলের স্বাদে দেশ হয়ে ছুঁয়ে দিয়ে যায় আমার চোখের পাতা। সকল প্রাণের সাথে মিলেমিশে বলে উঠি, চাষী পরিবার, সুখী পরিবার।
সারাবাংলা/আরএফ