দুজনে হারাব আজ…. (পর্ব-১)
৪ জানুয়ারি ২০১৮ ১৭:১০
সন্দীপন বসু
বিয়ের পর ৩ মাস পেরিয়ে গেছে, এখনও মধুচন্দ্রিমায় যাবার ফুসরত মেলেনি জুয়েল দীপ্তির। পড়াশোনার পাঠ চুকানোর পরপরই চাকরিতে ব্যস্ত দুজনার বাহুডোরে মেলানোর পালাতো মিটেছে। কিন্তু দুজনে একান্তে কুয়াশার আস্তরণ ফুঁড়ে বেরুনো হলদেটে লাল সূর্যিমামার রূপ হয়নি দেখা। হয়নি দুজনে মিলে কোনো সবুজ নিঝুমপুরীতে থরথর হৃদয়ে একান্তে বসা…।
কর্মস্থল ব্যাংকে বসে অন্যের টাকাপয়সার হিসেব কষতে কষতে দীপ্তি যখন এসব ভাবছে- ঠিক সেই সময়ে অফিসের বেলকনিতে লুটোপুটি খাচ্ছে হেমন্তের রোদ। ফেসবুকের পাতায় পাতায় প্রিয়তমা বান্ধবী আর তার বরের লুতুপুতু ট্রাভেলগ। দেখে হঠাৎই বিদ্রোহী হয়ে ওঠে ছকেবাঁধা মন। মধ্যহেমন্তের মিঠে হাওয়ার এই সময়ে বেরুতে না পারলে কীসের জীবন! যেই ভাবা সেই কাজ। সঙ্গে সঙ্গে ফোন ঢুকল জুয়েলের নেটওয়ার্কে। কড়া বার্তা ডেলিভারড- ‘এক সপ্তাহের মধ্যে ঘুরতে যাবো। কীভাবে ম্যানেজ করবে জানি না। না পারলে চুলোয় যাক চাকরি-সংসার!’
কিন্তু ঘুরতে যাবো বললেই তো হয় না। প্ল্যানিং আছে, ছুটি আর খরচের হিসেব মেলানোর বিষয় আছে। ঘরকুনো জুয়েলের কোনোকালেই এসব হিসেব মেলানোর অভ্যাস ছিল না। কিন্তু এবার তো এসবের বন্দোবস্ত না করেও উপায় নেই। অগত্যা, চ্যাট উইথ ফ্রেন্ডস…।
বন্ধুদের মধ্যে মুন্নার ঘোরাঘুরির অভিজ্ঞতা প্রচুর। আর তাকে নক করতেই মেলে পজেটিভ সাড়া। জানা যায়, বাজেট, সময়, আর ঘোরার মানসিকতা- সব মিলিয়ে মধুচন্দ্রিমার গন্তব্য হতে পারে দু’ধরনের। দেশে আর দেশের বাইরে। ‘তা তো সবাই জানে, ডিটেইলে বল, দেশে কই কই যাবো…। থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা বল।’
কিছুক্ষণের মধ্যে মুন্নার রিপ্লাই মেলে, ‘ পাহাড়, নদী, সমুদ্র আর বন সবই রয়েছে বাংলাদেশে। কিছুদিন আগে সুইজারল্যান্ডের একটি পত্রিকার জরিপে দেখা গেছে, পৃথিবীর সুখীতম দেশের একটি এ বঙ্গভূমি। তাই সবচেয়ে সুখের দেশে মধুচন্দ্রিমা যাপনের সুযোগ হাতছাড়া করাটা বোধহয় তোদের ঠিক হবে না।’
এবার মেজাজটা না খিচড়ে উপায় কি! জুয়েলের পাল্টা রিপ্লাই, ‘ভাই, সাবজেক্টে আয়। দেশে এই সময়ে হানিমুনে কোথায় যাওয়া সুবিধার হবে?’
‘শীতের শুরুতে দেশের ভেতর যদি ঘুরতে চাস, শুরুতেই মনস্থির করতে হবে ঠিক কী ধরনের জায়গা পছন্দ তোদের। যদি পাহাড় পছন্দ হয়, তাহলে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম আর সিলেটের সবুজে ঘেরা পাহাড়গুলো। বর্ষার শেষে এখনও সবুজ। ছবি ভালো আসবে।’ যোগ করে মুন্না।
‘যদি ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় হারাতে চাস, তাহলে আছে কক্সবাজার, কুয়াকাটা, সেন্টমার্টিন। আর যদি চান জঙ্গলেই মঙ্গল মনে করিস তাহলে খুলনা-বাগেরহাটের সুন্দরবন, মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়াসহ দেশে গোটা বিশেক জঙ্গল আছে।’
‘তবে নিরিবিলি ভ্রমণ উপভোগের জন্য একটুখানি অচেনা জায়গাও বোধহয় খারাপ নয়। যেতে পারিস ময়মনসিংহে সোমেশ্বরীর মায়ায় ঘেরা বিরিশিরি, বান্দরবানের শহুরে ভিড় থেকে একটু দূরে বগালেকের সিয়াম দিদিমণির পান্থশালায় বা মিলনছড়ির বিলাসী অতিথিশালায়। রাঙ্গামাটির নগর দর্শন না করে পাবলাখালির জঙ্গলে, যেখানে বাংলাদেশের শেষ ধনেশ পাখিগুলো এখনও ডেকে বেড়ায়। ভোলার শেষপ্রান্তের মনপুরা দ্বীপ বা মানুষের তৈরি ম্যানগ্রোভ জঙ্গল নিঝুম দ্বীপও খারাপ হয় না মধুচন্দ্রিমার জন্য।’
‘জায়গা ধরে ধরে আরেকটু ডিটেইলে বল। না হলে আমি বিষয়টা ব্যাখ্যা করে বলতে পারবো না দীপ্তির কাছে। আর ও যে খুঁতখুঁতে… জানিসই তো।’ বন্ধুর কাছে অনুরোধ করে জুয়েল।
‘একটু সময় দে তাহলে। আমি রাতের মধ্যে তোদের জন্য একটা মারদাঙ্গা প্ল্যান তৈরি করে দিচ্ছি।’- মুন্নার রিপ্লাই আসে একটু পরেই।
মধ্যরাতের একটু পরে আবার চ্যাটবক্সের পরিচিত ধ্বনি। ‘দুজনে হারাব আজ…’ শিরোনামে বন্ধু আর বন্ধুপত্নীর জন্য হানিমুন প্ল্যান বানিয়ে পাঠিয়েছে মুন্না।
ঝিনুক ফোঁটা সাগর বেলায়…
মধুচন্দ্রিমায় গন্তব্য পছন্দের এক্কেবারে ওপরে থাকে সমুদ্র। তা দেশেই হোক বা দেশের বাইরে। আর এ ব্যাপারে আমরা পৃথিবীতে সবচেয়ে এগিয়ে। এ ধরিত্রীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার যে আমাদেরই। ভিড় এড়িয়ে একটু নিরিবিলিতে যারা অপূর্ব সুন্দর এ সৈকতে ঘুরতে চায়, তাদের জন্য ইনানির আগে ঋজু খাল ঘেঁষে গড়ে ওঠা মারমেইড ইকো রিসোর্ট পারফেক্ট। পাশেই ইনানি বিচ, টেকনাফের বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ইসলামগঞ্জ আর শাপলাপুর গ্রামের অনিন্দ্যসুন্দর সৈকত। ইনানি পেরিয়ে মেরিন ড্রাইভ ধরে টেকনাফ যাওয়ার পথের সৈকতগুলো এখনও বাণিজ্যিক হয়ে ওঠেনি।
নিরাপত্তার ব্যাপারে একটু সাবধান থাকলেই সমুদ্র আর বালিয়াড়ি দুটোই উপভোগ করা যাবে। টেকনাফ পেরিয়ে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ নারকেল জিঞ্জিরা বা সেন্টমার্টিন দ্বীপও হতে পারে মধুচন্দ্রিমার গন্তব্য। সেন্টমার্টিনের যাত্রায় সঙ্গ দেবে ঝাঁক ঝাঁক গাংচিল। দ্বীপটিতে নারকেল গাছের সারি, মন কেমন করা নীরবতা, পানির স্বচ্ছতায় সাগরতলার প্রবাল আর শৈবালগুচ্ছ তোদের মুগ্ধ করবেই। সেন্টমার্টিনের জেটির উত্তর ও পূবদিকের রিসোর্ট ও হোটেলগুলো দুজনে একসঙ্গে হারাতে বেস্ট!
মেঘ পাহাড়ের মিতালি
পাহাড় যাকে একবার ডাকে, সে বারবার পাহাড়ে ছুটে যায়- কথাটা স্যার এডমন্ড হিলারির। বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটির পাহাড়গুলো আকাশছোঁয়া না হলেও মেঘছোঁয়া। শীতের শুরুতে উপত্যকায় জমে থাকা কুয়াশা আর তার ওপর সূর্যোদয় দেখার অনুভূতি অতুলনীয়।
বান্দরবান থেকে খুব সহজেই ঘুরে আসা যায় নীলাচল, স্বর্ণমন্দির, মেঘলা, নীলগিরি আর শৈলপ্রপাতে। বান্দরবান শহরের পাশের সাঙ্গু নদীতেও নৌকা নিয়ে দিন পার করে দেয়া যায়। একটু এগুলেই থানচির তিন্দু, রেমাক্রি, নাফাখুম, অমিয়াখুম, আলীকদম। একটু হাঁটাহাঁটির অভ্যাস থাকলে ক’টা দিন কাটিয়ে আসতে পারিস বগা লেকের ‘বম’ অথবা ‘মুরং’ পাড়ায়। পাহাড়ের ওপরের লেকের ধারে আদিবাসীদের আতিথেয়তা মন্দ লাগবে না।
খাগড়াছড়িতে গেলে আলুটিলা, রিসাং ঝরনা, দেবতাপুকুর, নিউজিল্যান্ডপাড়ায় তো সবাই যায়ই। একটু এগিয়ে দীঘিনালা পেরুলেই দেশের কমলার ভাণ্ডার বলে খ্যাত ফ্রুটসভ্যালি রাঙ্গামাটির ‘সাজেক’ উপত্যকা। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বেশ ক’টা ভালোমানের রিসোর্ট তৈরি হয়েছে সেখানে। রাঙ্গামাটিও এখান থেকে কাছাকাছি দূরত্বে। আশপাশে আরও আছে কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান, কর্ণফুলী পেপার মিল ও কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। রাঙ্গামাটি শহরে এসে কাপ্তাই আর কর্ণফুলীর শীতকালীন মন্থর স্রোতে দুজনে ভাসাতে পারিস নৌকা। শহর থেকে শুভলং ঝরনায় যাওয়া যায় নৌপথে।
চারদিকে পাহাড়, নৌকায় করে স্বচ্ছ পানির ওপর দিয়ে ছুটে চলা। মাঝে মধ্যে দু-একটি বক ও নাম না জানা পাখির ওড়াউড়ি। কখনও লেকের পানিতে ঝপ করে লাফিয়ে পড়ে সাঁতরে পার হচ্ছে গুইসাপ। দুধারে উঁচু পাহাড়ের মাঝ দিয়ে নৌকা চলার সময় দূর পাহাড় থেকে আদিবাসী গ্রামগুলোকে ছবির মতো মনে হবে। সঙ্গে বোনাস মনোরম পরিবেশ আর নির্জনে তোরা। যদি নৌকার মাঝি আর হেলপারের কথা বাদ দেস আরকি! মধুচন্দ্রিমার কল্পনায় এমন জায়গাই তো মানানসই।
বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি- তিন জেলাতেই রয়েছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মোটেল। এছাড়া বান্দরবানে মিলনছড়ি রিসোর্ট, সেনাবাহিনীর নীলগিরি রিসোর্ট, সাকুরা রিসোর্টসহ আরও বেশকিছু ভালোমানের রিসোর্ট রয়েছে। ভাড়া নেটে সার্চ করলেই পেয়ে যাবি।
(চলবে)
ছবি- লেখক
সারাবাংলা/এসএস