দাঁত থাকতেই দাঁতের যত্ন নিন (পর্ব ১)
৫ জানুয়ারি ২০১৮ ১৩:৩৭
ডাঃ মেজবাহ উল আজীজ
দাঁত সম্ভবত মানুষের শরীরের সেই অংশ, যার অবদান সৌন্দর্য রক্ষায় সবচেয়ে বেশী, অথচ তার প্রতিই মানুষ সবচেয়ে বেশী উদাসীন থাকে। তাই এই কলামে আমরা চেষ্টা করব দাঁতের যেসব রোগ সচরাচর হয়ে থাকে, সেগুলোর কারণ, প্রতিরোধ ও প্রতিকারের বিষয়াবলী নিয়ে আলোচনা করতে।
দাঁতের রোগ নিয়ে আলোচনার আগে প্রয়োজন দাঁত সম্পর্কে একটু বিশদ ভাবে জানা। তাহলে পরবর্তীতে বিভিন্ন বিষয় বুঝতে আমাদের কাছে সহজ হবে। নীচের ছবিটি থেকে চলুন আমরা দাঁতের বিভিন্ন অংশ সম্পর্কে একটু ধারণা নেই।
ছবি থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে একটি দাঁতের প্রধানত তিনটি অংশ থাকে, ক্রাউন, নেক ও রুট। আমরা যাদি কারো মুখের ভেতরে তাকাই, তাহলে যে অংশটি দেখতে পাই তা হচ্ছে ক্রাউন। নেক অংশটুকু থাকে আমাদের মাড়ির নীচে এবং রুট অংশটুকু থাকে মাড়ির নীচের হাড়ের ভেতরে।
আমরা যাদি এবার দাঁতটিকে লম্বচ্ছেদ করি, তাহলে আমরা আরো বিশদভাবে জানতে পারব যে , দাঁতের ভেতরে আসলে বেশ কয়েকটি লেয়ার রয়েছে। ক্রাউন অংশের সবচেয়ে বাইরের লেয়ার টির নাম এনামেল, তার নীচে আছে ডেন্টিন এবং সবচেয়ে ভেতরে আছে পাল্প (মজ্জা)। রুট অংশেও তেমনি, শুধু বাইরের দিকে এনামেলের পরিবর্তে রয়েছে সিমেন্টাম, তার নিচে ডেন্টিন এবং ভিতরে পাল্প। ক্রাউন অংশে পাল্প বা মজ্জা যেখানে থাকে তার নাম পাল্প ক্যাভিটি আর রুট অংশে যেখানে পাল্প থাকে তার নাম রুট ক্যানাল।
দাঁতটি চোয়ালের হাড়ের একটু ভেতরে সকেটের মধ্যে বসানো থাকে। হাড়ের উপরে মাড়ি দিয়ে ঢাকা থাকে। দাঁতটি হাড় ও মাড়ির সাথে পেরিওডন্টাল লিগামেন্টের মাধ্যমে আটকানো থাকে। নিচের ছবিটি দেখলে ব্যাপার টা আরেকটু স্পষ্ট হবে আশা করছি।
যেহেতু আমরা মোটামুটি দাঁতের বিভিন্ন অংশের নাম ও তাদের অবস্থান বুঝে ফেলেছি, সুতরাং এবার আমরা দাঁতের রোগ নিয়ে আলোচনা শুরু করতে পারি। দাঁতের সবচেয়ে কমন যে সব রোগ হয়ে থাকে, তার মধ্যে নিম্নলিখিত রোগগুলো উল্লেখযোগ্য।
– ক্যারিজ, ক্যাভিটি অথবা ক্ষয়রোগ
– মাড়ী থেকে রক্তক্ষরণ
– মুখে দুর্গন্ধ
– দাঁতে ব্যাথা
– দাঁত শিরশির করা (ঠান্ডা, গরম, টক বা মিষ্টি খেলে)
– দাঁত ধীরে ধিরে হলদেটে হয়ে যাওয়া
– দাঁত নড়ে যাওয়া
– বিবিধ
আমরা ধারাবাহিক ভাবে এই সকল সমস্যা নিয়ে আলোচনা করব বলে আশা রাখছি।
প্রথমেই আসা যাক ক্যারিজ, ক্যাভিটি বা ক্ষয়রোগ প্রসংগে। এইটা সম্ভবত সবচেয়ে কমন রোগ। বাংলাদেশের খুব কম মানুষই আছে, যার কোন না কোন দাঁত তার জীবনকালে অন্তঃত একটি ক্যারিজের শিকার হয় নি। শুধু বাংলাদেশ নয়, ২০১৫ সালের একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে, সারা বিশ্বের প্রায় ৩২% মানুষ এই ডেন্টাল ক্যারিজে আক্রান্ত। কি এমন জিনিস এই ডেন্টাল ক্যারিজ? চলুন একটু বিষদ ভাবে জানা যাক
ক্যারিজ (Caries) শব্দটি ল্যাটিন, যার আক্ষরিক অর্থ rottenness অথবা Decay। সোজা বাংলায় ক্ষয়ে যাওয়া। এই ক্ষয় সামান্য থেকে শুরু করে অনেক বড় পর্যন্ত হতে পারে। এই ব্যাপ্তি এমনও হতে পারে , যে এনামেল ডেন্টিন লেয়ার পার হয়ে ক্যারিজ পাল্প পর্যন্ত চলে যেতে পারে, ফলে প্রচন্ড ব্যাথার উদ্রেগ হয়। সাধারনত দাঁতের প্রচুর খাঁজের মত অংশ (pits and fissures) অংশে খাবার জমে এবং সেখান থেকেই ক্যারিজ শুরু হয়।
কিন্তু কেন হয় দাঁতের এমন ক্ষয়? গবেষণা থেকে জানা যায় যে, শর্করা জাতীয় খাদ্য (Carbohydrates) এর হজম প্রক্রিয়া মুখগহবর থেকেই শুরু হয়। আমাদের মুখগহবরে প্রচুর ব্যাকটেরিয়ার বসবাস রয়েছে, যার মধ্যে একটি বড় ব্যাকটেরিয়া গ্রুপ হচ্ছে Streptococcus ও lactobacillus গ্রুপ। এদের কাজ মূলত শর্করা কে ভেঙ্গে এসিড তৈরীর প্রক্রিয়া শুরু করা, যা শর্করা জাতীয় খাদ্য হজম প্রক্রিয়া শুরুর অন্যতম ধাপ। এই এসিড জাতীয় পদার্থ যদি মুখের ভেতরে বেশীক্ষন থাকে তাহলে তা দাঁতের এনামেল কে ক্ষয় করতে শুরু করে। এখান থেকেই আস্তে আস্তে ক্ষয় হতে হতে একসময় দেখা দেয় ডেন্টাল ক্যারিজ।
এখানে মনে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, যে তাহলে এই ক্যারিজের প্রতিরোধ করার উপায় কি! আমরা কি শর্করা জাতীয় খাবার বন্ধ করে দেব? কিন্তু মানুষের শরীরে শর্করা জাতীয় খাদ্যের প্রয়োজন ত অনস্বীকার্য। তাহলে কি আমরা Streptococcus ও Lactobacillus গ্রুপের ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলার জন্য কোন ব্যবস্থা নেব? কিন্তু তাহলে আমরা যে শর্করা জাতীয় খাদ্য খাব, তা ত অনেকাংশেই হজম হবে না, ফলে তা থেকে পুষ্টি লাভ হবে না। তাহলে কি আসলে ক্যারিজ হবেই? তা প্রতিরোধের উপায় নেই?
অবশ্যই আছে, এবং সেই উপায় হলো সঠিক নিয়মে দাঁত ব্রাশ করা। আমরা খাবার পরে মুখের ভেতরে শর্করা প্রক্রিয়াজাত হতে সময় বেশ কমই প্রয়োজন হয়, তার পরে যদি আমরা আমাদের দাঁত যথাযথ নিয়মে ব্রাশ করে ফেলি, তাহলে মুখের ভেতরে যে এসিড তৈরী হয়েছে, তা কমে যাবে, ফলে ক্যারিজ শুরু হবে না। এখানে মনে রাখতে হবে যে, মুখে যে এসিড তৈরী হয় তা আসলে খুবই দুর্বল এসিড এবং লম্বা সময় ধরে যদি তা মুখের মধ্যে না থাকে, তাহলে তা কাজ শুরু করতে পারে না। এ জন্য দাঁতের ডাক্তার রা পরামর্শ দেন রাতে ও সকালে খাবার পরে দাঁত মাজার। সঠিক পদ্ধতিতে দাঁত মাজার পদ্ধতি নিয়ে পরে কখনো বিস্তারিত আলাপ করব আমরা।
এবার তাহলে দেখি, যদি কারো ডেন্টাল ক্যারিজ হয়েই যায়, তবে তা প্রতিকারের উপায় কি। সহজ ভাবে বলতে গেলে, যদি ক্যারিজ এনামেল ও ডেন্টিন অংশেই সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে ফিলিং করে চিকিৎসা করা সম্ভব। তবে যদি তা পাল্পে ছড়িয়ে যায়, তাহলে রুট ক্যানাল ট্রীটমেন্ট করতে হবে। এরপরে ফিলিং করে নিতে হবে। রুট ক্যানাল করা দাঁতটিতে অবশ্যই ক্যাপ করিয়ে নিতে হবে, না হলে দাঁতটি ভেংগে যাবার সম্ভাবনা থাকে। আশা করছি ভবিষ্যতে প্রতিটি চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে আমরা ধীরে ধীরে বলব।
প্রথম পর্বের সমাপ্তি টানছি এখানেই। আগামী পর্বে দাঁতের অন্য রোগ, প্রতিকার ও প্রতিরোধের বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাবে।
পরামর্শ কণিকাঃ
-বাইরে থেকে দেখতে হয়ত ক্যারিজ টা অনেক ছোট মনে হতে পারে, কিন্তু ভিতরের দিকে অনেক বড় ব্যাপ্তি থাকতে পারে, যা ডাক্তারী পরিক্ষা ছাড়া খালি চোখে বোঝা সম্ভব না। তাই উপর থেকে দেখে “ছোট্ট একটা ফুটা” বলে ভুল ধারণা নিয়ে থাকবেন না।
– দিনে ব্রাশ করতে ভুলে গেলেও, রাতে শোবার আগে অবশ্যই ব্রাশ করুন। নিজের বাচ্চা কে ব্রাশ করানোর অভ্যাস করুন। এই ছোট অভ্যাস টা আপনার বাচ্চার মুখের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করবে।
– দাঁতপোকা বলতে কিছু নেই। ক্যারিজকেই সাধারণ ভাষায় দাঁতের পোকা বলে সবাই অভিহিত করে। ফুটপাথে বসা প্রতারক দের দাঁতের ভেতর থেকে বের করা পোকা দেখে বিভ্রান্ত হবেন না। এবং অবশ্যই দাঁতের দাক্তারের কাছে দেখানোর আগে তার বিএমডিসি নিবন্ধন সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নিন।
মনে রাখবেন, বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিল এর বিধি মোতাবেক নূন্যতম এমবিবিএস অথবা বিডিএস ডিগ্রী ব্যতীত আর কেউ ডাক্তার নয়। দাঁতের সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে প্রতারকদের এড়িয়ে চলুন।
লেখক- দন্ত চিকিৎসক (প্রতিষ্ঠাতা), Tooth Care, শ্যামলি, ঢাকা। সাবেক প্রভাষক, সাপ্পেরো ডেন্টাল কলেজ।
সারাবাংলা/এসএস/আরএফ