কালো মেয়ে
১২ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৪:১০
রাজনীন ফারজানা।।
‘কৃষ্ণকলি’ বলে ডাকলেই কি কালো মেয়েটার দুঃখ হরণ হয়?
নামের সাথে সেই তো কৃষ্ণ অর্থাৎ কালো শব্দটা জুড়েই দেওয়া। কবি কিন্তু এখানে গায়ের কালো রঙ দেখে মুগ্ধ হননি, মুগ্ধ হয়েছেন মেয়েটার কালো হরিণ চোখ দেখে। অর্থাৎ কালো মেয়েও কবিতার বিষয় হতে পারে যদি তার থাকে হরিণের মত টানা টানা দুটি চোখ।
কিন্তু সাথীর না আছে হরিণের মত টানা টানা দুই চোখ, না আছে মেঘ বরণ কেশ। নাক বোঁচা, ছোট চোখের সাথীর চেহারায় ঢলঢল লাবণ্য নজর কাড়লেও তাকে প্রায়ই শুনতে হয় সে কালো তাই তার বিয়ে হবে না। দশম শ্রেণিতে পড়া সাথী বান্ধবীদের সাথে কথায় কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ে। যতক্ষণ স্কুলে থাকে ততক্ষণই ভালো লাগে তার। বাসায় থাকলে হয় দাদী না হয় মা কিংবা প্রতিবেশী কারও না কারও কাছে নিজের গায়ের রঙ নিয়ে খোঁটা শোনে সে। প্রতিবেশীরা কত পরামর্শ দেয়। এই ক্রিম সেই ক্রিম মাখতে বলে। দাদী তাকে রোজ হলুদের রস দুধে মিশিয়ে খাওয়ায় যদি মেয়েটার রঙ ফেরে!
শপিং করতে দারুণ লাগে সাথীর কিন্তু সে শপিং এ যেতে চায় না। কারণ সেখানে গেলে তাকে শুনতে হয় ‘এই রঙে মানাবে না তোমাকে’ ‘এই ডিজাইন তোমার জন্য নয়’। হলুদ রঙ খুব প্রিয় হলেও কখনও হলুদ রঙের কোন জামা পরতে পারেনি সাথী। মাঝেমধ্যে একা বাসায় মায়ের হলুদ শাড়ি শরীরে পেঁচিয়ে দেখে তাকে কেমন লাগে! নিজেকে তার ভালোই লাগে কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন হলুদ জামা পরা হয়নি তার। সব জামাই ঘুরে ফিরে হালকা গোলাপি, হালকা সবুজ, হালকা বেগুনি অর্থাৎ হালকার যত শেড আছে সব।
নিজের গাঁয়ের রঙ কেমন হবে তার উপর আমাদের কোন হাত থাকে না কিন্তু সাথীর মত কালো মেয়েদের জীবনের সব রঙ শৈশবেই শুষে নেওয়া হয় তার গায়ের রঙ কালো হওয়ার অপরাধে।
আহারে মেয়েটা যেমন লম্বা তেমনি টানা টানা চোখ মুখ কিন্তু গায়ের রঙ তো কালো, কে বিয়ে করবে ওকে?
মেয়েটার চোখগুলো সুন্দর কিন্তু গায়ের রঙ কালো।
মেয়েটা কালো হলেও চুলগুলো খুব সিল্কী।
যেমন কালো তেমনি মোটা কোন ছেলে পছন্দ করবে ওকে?
আশপাশে শোনা যায় প্রায়ই। কিন্তু এসব যারা বলি তারা একবারও ভাবি না কথাটার মাঝে কতখানি শ্লেষ মিশে আছে। কারণ গায়ের রঙ ফর্সা এমন কাউকে শুনতে হয়না যে গায়ের রঙ ফর্সা কিন্তু নাকটা বোঁচা। অন্তত নাক বোঁচা হওয়ার কারণে কোন মেয়ের সৌন্দর্য কম হয় না। গায়ের রঙ সাদা হলেই যেন কোন মেয়ের আর কোন যোগ্যতা অর্জন করা লাগে না।
অন্যদিকে যার গায়ের রঙ কালো তাকে কত করুণা, কত অবহেলা, কত অপমানের বাণী যে শুনতে হয় তা শুধুমাত্র সেই জানে।
গায়ের রঙের কারণে মানুষকে বিচার করার শুরুটা কীভাবে? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মানস চৌধুরী বলেন, উপনিবেশের কাল থেকে কালো রঙকে খাটো করে দেখার প্রবণতা শুরু হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়। শুধু কালো মেয়ে নয় কালো মানুষদের দিকেই কিছুটা বিদ্বেষের সাথে তাকানো হয়। তিনি বলেন বাংলাদেশে এখনও কালোদের প্রতি বর্ণ বিদ্বেষ এতটাই তীব্র যে ঢাকার রাস্তায় কোন আফ্রিকান কালো মানুষ হেঁটে তার দিকে ঠিক যেন তিনশ বছর আগের ব্রিটিশদের মত ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকানো হয়। তার মতে ব্যাপারটা যেমন বেদনাদায়ক তেমনি কৌতুককরও কোন কোন ক্ষেত্রে।
গাঁয়ের রঙ কালো হওয়া যেন চলতে না পারা, চোখে না দেখা কিংবা কথা বলতে না পারার মত বিষয়। কালো মেয়েটি যেন সবার করুণার পাত্র। অথচ কোন মানুষই অন্যের করুণা নিয়ে বাঁচতে চায়না।
কালো রঙ যে একটা অযোগ্যতা এটা প্রচার করতে মিডিয়ার ভূমিকাও কম নয়। যদিও এর সাথে বিজ্ঞাপনের স্বার্থই বেশি জড়িত। বিশ্বজুড়ে রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাবসা চলে মূলত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে লক্ষ্য করেই। বিজ্ঞাপনে একটা মেয়ের উচ্চশিক্ষা, বাইক চালানো কিংবা চাকরি বা ব্যবসা করার যোগ্যতা সবকিছুকে খাটো করে দেখানো হয় গায়ের রঙের কারণে। রূপকথার জাদুর ছোঁয়ার মত রঙ ফর্সাকারী ক্রিমকে সব সমস্যার সমাধান হিসেবে দেখানো হয়। যতক্ষণ না সে ফর্সা হচ্ছে ততক্ষণ তার ভালো বিয়ে হচ্ছে না, সে ভালো চাকরি পাচ্ছে না, না পারছে নিজের পায়ে দাঁড়াতে।
বিজ্ঞাপনের ভাষায় যদিও তেল ময়লা পরিষ্কার করে উজ্জ্বলতা ফিরিয়ে আনার কথা বলা হচ্ছে কিন্তু পণ্যের মোড়কে ঠিকই ফেয়ারনেস ক্রিম বা ফেয়ারনেস ফেশিয়াল ওয়াশ লেখাই থাকছে।
বিজ্ঞাপন নির্মাতা অমিতাভ রেজা এ প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশে এখন আর প্রসাধনীর বিজ্ঞাপনে গায়ের রঙকে খাটো করে দেখানো হয়না। এখন নারীর আত্মবিশ্বাস বাড়ানোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
অন্যদিকে বিজ্ঞাপনে ঘাম হয়, ময়লা হয় তাই এই ক্রিম মেখে উজ্জ্বলতা ফিরিয়ে আনুন ধরণের কথা বলা হলেও ক্রিমের মোড়কের ছবিতে ঠিকই অপেক্ষাকৃত কালো তেকে ফর্সা- এমন মুখের ছবি থাকে। আবার বিজ্ঞাপনে যারা মডেল তাদেরকে অতিরিক্ত ফর্সা দেখানো হয়।
এ ধরণের মনোভাবের পেছনে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা ও আমাদের দীর্ঘদিন পরাধীন থাকাকে দায়ী করেন অমিতাভ রেজা। তিনি দাবি করেন, বিজ্ঞাপনে নারীর আত্মবিশ্বাস বাড়ানোকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। গায়ের রঙের সেই জায়গা থেকে সরে এসেছে বাংলাদেশ। এখন করা হচ্ছেনা আর যদি হয়ও তিনি এর ঘোর বিরোধী বলেও জানান।
এই বাংলাদেশেই কালো মেয়ে জন্মানোকে যুগের পর যুগ ধরে অভিশাপ ধরা হয়েছে। মেয়ে মানেই তাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে হবে। আর বিয়ের ক্ষেত্রে গায়ের রঙ কালো হওয়া একটা অযোগ্যতা। অনেক সময় চাকরির ক্ষেত্রেও মেয়েরা গায়ের রঙের জন্য সমস্যায় পড়েন।
ফাতেমা তুজ জোহরার গায়ের রঙ কালো। যখন একটি বেসরকারি টেলিভিশনে কাজ শুরু করেন তখন কথাই ছিল যে তিনি সাংবাদিকতার পাশাপাশি সংবাদ পাঠও করবেন। সেই মত প্রস্তুতিও চলছিল। প্রথম দিন অন এয়ার হবার পরে ফাতেমার খবর পড়ার চাইতে তাকে দেখতে কেমন লেগেছে তাই নিয়েই অফিসে বেশি কথা হচ্ছিল। কোন কোন নারী খবর পাঠিকা নানারকম আপত্তিকর ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছিলেন, যেমন, গায়ের রঙ কালো হওয়া সত্ত্বেও নিশ্চয়ই কোন বসের সাথে অনৈতিক সম্পর্ক করে খবর পড়ার সুযোগ পেয়েছেন! দ্বিতীয়বারও খবর পড়ার পর বার্তা প্রধান ভীষণ রেগে যান ও রুমে ডেকে ফাতেমাকে যা তা বলেন। বলেন, স্ক্রিনে অনেক বাজে দেখতে লেগেছে তাকে। ফাতেমা নাকি তার চ্যানেলের স্ক্রিনের মান কমিয়ে দিচ্ছেন। এরপর বন্ধ হয়ে যায় ফাতেমার সংবাদ পাঠ।
ওই ঘটনার পর তিনি চাকরি ছেড়ে দেন।
ফাতেমা বলেন, তিনি কখনো ফর্সা হতে চাননি। নিজেকে নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট।
শাওন (৩৩) জন্মের পর থেকেই শুনে আসছে সে কালো আর খাটো, তাই তার বিয়ে হবে না। কালো মেয়ে জন্ম দেওয়ায় শাওনের মাকে খোঁটা শুনতে হয়েছে। কারণ শাওনের নানার গায়ের রঙ ছিল কালো। কিন্তু শাওনের বাবা ও বাবার দিকের প্রায় সবার রঙই কালো। এটি কারো মাথায় আসেনি।
শাওন পড়াশোনাকে বেছে নেয় মুক্তির উপায় হিসেবে। কিন্তু সেখানেও মা ছাড়া কেউ সাহায্য করেনি তাকে।
সে যখন স্বাবলম্বী হবার চেষ্টা করছে, তখন তার বাবা বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকেন। বয়স বেড়ে গেলে কালো মেয়ের বিয়ে হবে না- এই ছিল তার ভাষ্য। একের পর এক পাত্রপক্ষের সামনে গিয়ে বাতিল হতে থাকে সে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শাওনের দারুণ সিজিপিএ কোন কাজে আসেনি। গায়ের রঙ আর উচ্চতার দোহাই দিয়ে ভালোমন্দ খেয়ে বিদায় হতে থাকে একের পর এক পাত্রপক্ষ। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে শাওন। বাবা ও দাদার বাড়ির লোকজন তাকে ও তার মাকে অপমান করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত বিয়ে হয় শাওনের। পাত্র সুদর্শন ও ভালো চাকুরে। কালো এবং খাটো স্ত্রী নিয়ে পাত্রের কোন সমস্যা না থাকলেও, নতুন বউকে মানসিক আঘাত করতে থাকে শাশুড়ি ও ননদ। শুধুমাত্র কালো হওয়ার অপরাধে তাকে প্রতিনিয়ত অপমানজনক কথা শুনতে হয়েছে। এমনকি এখনও তার স্বামী তথাকথিত সুন্দর হয়েও কীভাবে তাকে বিয়ে করেছে এই নিয়ে এখনও কথা শোনে শাওন।
এরকম হাজারো মেধাবী শাওন আছে যারা বুঝতে শেখার পর থেকেই নিজেদের রঙকে নিজের শত্রু ভাবতে শেখে।
গাঁয়ের রঙ কালো হলে ছেলেদেরও যন্ত্রণার শেষ নাই এদেশে। কিন্তু অর্থবিত্ত হলে বা কেরিয়ার গড়তে পারলে তাদের রঙের খোঁটা শুনতে হয়না। অন্যদিকে একটা মেয়ে যতই যোগ্যতা সম্পন্ন হোক না কেন কালো হওয়া মানেই তার বাকি সব যোগ্যতা ঢাকা পড়ে যাওয়া।
শাহানা সুলতানা। উচ্চতা পাঁচ ফিট ছয় ইঞ্চি। মেঘের মত ঘন কালো পিঠ ছাড়ানো চুল। মাস্টার্স পাশ করে বসে ছিলেন দীর্ঘদিন। এরপর একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। কখনও বড় বোনের বসায় থাকতেন তো কখনও বড় ভাইয়ের বাসায়। বয়স ত্রিশ পার করেও তার বিয়ে হচ্ছিলনা। একে কালো তার উপর উচ্চতাও বেশি, কে বিয়ে করবে একে! একের পর এক পাত্রপক্ষ ফিরে যেতে লাগলো। আসতে লাগলো ডিভোর্সি এবং কয়েক সন্তানের জনক বয়স্ক পাত্রের পক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব। এতটা অপমানিত বোধ করতেন যে এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিলেন বিয়েই করবেন না তিনি। বাড়িতেও স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন।
পরে প্রায় চল্লিশে পৌঁছে ভালবেসে একজনকে বিয়ে করেন শাহানা। ফুটফুটে এক শিশু নিয়ে এখন শাহানার সুখের সংসার। গায়ের রঙের জন্য সারা জীবন এত কথা শুনেছেন যে এক এক সময় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা করত তার। কিন্তু এখন আর সেসব দিনের কথা মনেও করতে চাননা।
অধ্যাপক মানস চৌধুরী বলেন, নারীর প্রতি বিদ্বেষ শুধু গায়ের রঙেই থেমে নেই।
মধ্যবিত্ত/চাকুরিজীবী/ডিগ্রিধারী শ্রেণির বিশেষ ধরনের কালোবিদ্বেষ উপনিবেশ কাল থেকেই শেখা। আর সেসব শেখা বমি করে খালাস করার জন্য দার্শনিক-রাজনৈতিক বোঝাবুঝি দরকার পড়ে। অত আগ্রহ নাই নেই এই শ্রেণিটির। বরং এ বিদ্বেষ দূর করতে, যেসব সাহিত্যে কালোর গুন গাওয়া হয়েছে বা কালো বন্দনা হয়েছে, তা বেশি করে পাঠ ও প্রচার করার উপর গুরুত্ব দেন মানস চৌধুরী।
আজকাল অনেক বাবা মাকেই বলতে শোনা যায় ছেলে হোক মেয়ে হোক সুস্থ হলেই হবে। কিন্তু মায়ের গায়ের রঙ যদি হয় কালো তবে গর্ভাবস্থা থেকেই তাকে নানারকম উপদেশ বাণী শুনতে হয় অনাগত সন্তান কীভাবে ফর্সা হবে তাই নিয়ে। গর্ভবতী মা কে কেউ বলে আনার খাও, ডাব খাও, কেউ বলে প্রতিদিন দুধ আর ছানা খাও বাচ্চা ফর্সা হবে।
কালো রঙটিকে একটি দোষ হিসেবে বিবেচনা করেই কালো মানুষ বিশেষত কালো মেয়েদের নানাভাবে বিচার করার প্রথা চালু এই দেশে। এজন্য চাই, কালোকে দোষ হিসেবে দেখার মানসিকতা দূর করা। কালোও একটি সুন্দর রঙ এবং এদেশের মানুষ কালোই হবে, সেটিই স্বাভাবিক- এই বিষয়টি গ্রহণ করতে শেখা খুব জরুরি। কালো মানে অসুন্দর, কালোকে তাই মুছে দিয়ে ক্রমশ সাদা হয়ে উঠতে হবে- এই আদিম চিন্তা যতদিন না আমাদের মন থেকে দূর হবে- ততদিন পর্যন্ত কালো মেয়ের দুর্ভোগ শেষ হবে না।
মডেল- মেহরান সানজানা ও ফারহানা আক্তার
সারাবাংলা/আরএফ/এসএস