মুনমুন’স কিচেন: থালিতে সাজানো খাঁটি বাঙালিয়ানা
৩০ জানুয়ারি ২০১৯ ১৪:৪৮
রাজনীন ফারজানা ।।
এই শহরে কাবাব থেকে ভর্তা, বিরিয়ানি থেকে চাইনিজ, কোরিয়ান থেকে আমেরিকান, তুর্কি থেকে খাঁটি চাইনিজ খাবার পাওয়া গেলেও একদম খাঁটি বাঙালি খাবার সেভাবে পাওয়াই যায়না। মোচার চপ, তোপসে ভাজা কি পোস্ত বড়ার নামই শোনা যায় শুধু। ইউটিউব বা টেলিভিশনের রান্নার অনুষ্ঠানের সূত্রে খাবারগুলো দেখতে কেমন জানলেও চাখার সুযোগ হয়নি অনেকেরই।
এমনই কিছু ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবার থালিতে সাজিয়ে পরিবেশন করা হয় মুনমুন’স কিচেনে। সার্ক ফোয়ারা থেকে ফার্মগেটের দিকে যেতে কারওয়ান বাজারের প্রজাপতি আন্ডারপাসের ঠিক পাশেই মুনমুন’স কিচেন। জনপ্রিয় নিত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদসহ আরও ছয়জন নিভৃতচারী গুণী মানুষ আছেন অনন্য এই আয়োজনের উদ্যোক্তা হিসেবে।
এখানে বাঙালি ঘরানার সাথে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গীয় খাবারের মিশেলের চেষ্টা করা হয়েছে। পাওয়া যাবে নানারকম ভর্তা, পোলাও, খিচুড়ি, ভাত, ডাল, শাক, তরকারি, মাছ, মাংস, সবজি থেকে শুরু করে শেষ পাতে দই কিংবা পায়েস। কয়েক ধরণের কম্বিনেশনের থালির পাশাপাশি এখানে স্ট্যাটার হিসেবে আছে খাঁটি বাঙালি ভাজাপোড়া খাবার। আকর্ষণ ধরে রাখতে এখানে প্রতিদিন খাবারের মেন্যু বদলানো হয়। নানা ঘরোয়া বা প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনের জন্য আছে পার্সেলের ব্যবস্থা। সেসব পার্সেলেও ভিন্ন ভিন্ন ধরণের খাবার দেওয়া হয়। আছে নিরামিষ পার্সেলের ব্যবস্থাও, যে রান্নায় একদমই পেঁয়াজ-রসুন ব্যবহার করা হয়না।
মুনমুন’স কিচেন আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে গত বছরের নভেম্বরের ১২ তারিখ। তবে এর আগে বেশ কিছুদিন ধরে কাছের বন্ধু অতিথিদের নিয়ে ‘ফুড টেস্টিং’ পর্ব চলেছে খাবারগুলো চুড়ান্ত করার জন্য। জনপ্রিয় নিত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদের নামে রেস্টুরেন্টের নামকরণ। আরও আছেন নিত্যশিল্পী তামান্না রহমান, সঙ্গিতশিল্পী সুজিত মোস্তাফা, সঞ্জয় রায়, উজ্জ্বল চ্যাটার্জি এবং মাসুম রেজাসহ অনেকে। শুরুর কথা বলতে গিয়ে মুনমুন আহমেদ বলছিলেন, সঞ্জয় রায়ের মেয়ে তার ছাত্রী। একবার কথায় কথায় নাচের পাশাপাশি কিছু একটা করার কথা বলেছিলেন। সেই কথার সূত্র ধরেই মুনমুন’স কিচেনের যাত্রা শুরু। উজ্জ্বল চ্যাটার্জি বললেন নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদের প্রতি সম্মান জানাতেই তার নামে রেস্টুরেন্টের নামকরণ করেছেন তারা।
থালি সংস্কৃতি আমাদের দেশে তেমন একটা প্রচলিত না হলেও এর সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি। মুনমুন আহমেদ জানালেন থালির ভাবনাটা পুরোপুরিই উদ্যোক্তাদের অন্যতম উজ্জ্বল চ্যাটার্জি। এমন একটা আইডিয়া নিয়ে রেস্টুরেন্ট শুরু করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলছিলেন তিনি। উজ্জ্বলের মতে, খাদ্যরসিক যারা তারা যেখানেই যাক না কেন সেখানকার স্থানীয় খাবার খেতে চান। খাবারের সাথে একটা দেশের সংস্কৃতি এবং জীবনযাপনের সংযোগ আছে। তাই মানুষ সেদেশের জীবনযাত্রা বুঝতে স্থানীয় খাবার চেখে দেখেন।
তিনি বলেন, রেস্টুরেন্টে গিয়ে মাছ, মাংস বা মিষ্টি খেতে চাওয়া সাধারণ ঘটনা। কিন্তু কোন দেশে গিয়ে সেখানকার খাবার সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা পেতে থালি বা প্ল্যাটার বেশ উপকারি। থালিতে থাকা খাবারগুলো দিয়ে একসাথে অনেকগুলো খাবারের সাথে পরিচিত হওয়া যায়। প্রকাশ পায় সেদেশের লোকের রুচিবোধ। উজ্জ্বল চ্যাটার্জি বলেন, একটা দেশের লোকজ সংস্কৃতির সাথে যেহেতু খাবারের সম্পর্ক আছে তাই সেই খাবারগুলো একসাথে এক থালায় পরিবেশনের জন্য থালি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আর এই ভাবনা থেকেই মুনমুন’স কিচেনে থালির আয়োজন। দেশের লোক যেমন নানারকম বাঙালি খাবার চেখে দেখতে পারবে, তেমনি বিদেশি পর্যটকরাও খাঁটি বাঙালি খাবার সম্পর্কে ধারণা পাবে।
আমিষের পাশাপাশি পাওয়া যাবে নানারকম সবজির পদ। পাবেন মোচার চপ, মাশরুম পাকোড়া, মিক্সড ভেজ পাকোড়া বা পোস্ত বড়া।
গরম গরম ধোঁয়া ওঠা সাদা ভাতের সাথে ঘন ডাল, ভর্তা, শাকসবজি, মাছ আর মাংস। আয়োজনের ডালা সাজিয়ে বসে আছে মুনমুন’স কিচেন। চেখে দেখতে পারেন মজাদার শুক্তো, মোচার ঘন্ট, আলুর দম, সরষে ফুলকপি, ধোকার ডালনা, ছানার ডালনা ইত্যাদি। আছে লুচি, পরোটা, লাবড়া, পোলাও আর মাংসেরও আয়োজন।
মুনমুন আহমেদ জানালেন ছাত্রছাত্রী বা চাকরিজীবীদের জন্য সুলভ মূল্যে স্বাস্থ্যকর খাবার দিচ্ছেন তারা। যারা স্বাস্থ্যসচেতন তাদের জন্য স্পেশাল ডায়েট খাবারও শিগগিরই মেন্যু তালিকায় যোগ হবে বলেও জানান মুনমুন। থাকবে সালাদ, আর অল্প তেলে রান্না করা সবজি ইত্যাদি।
মুনমুন’স কিচেনের রসুইঘরের দায়িত্বে আছেন এক্সিকিউটিভ শেফ দীপক ভট্টাচার্য। কলকাতার বাসিন্দা দীপক ভট্যাচার্যের সাথে বাংলাদেশের নাড়ীর যোগ। মা চট্টগ্রামের আর বাবা কুমিল্লার। দীপক জানালেন তার বেড়ে ওঠা কলকাতাতেই। কিন্তু পছন্দ করেন বাঙাল খাবার। জানতে চাইলাম কলকাতায় প্রচলিত বাঙাল আর ঘটি রান্নার পার্থ্যকটা কী? দীপক ভট্টাচার্জ জানালেন, যারা কলকাতার আদি বাসিন্দা তাদের ঘটি আর বাংলাদেশ থেকে যারা গিয়েছেন তাদের বাঙাল বলা হয় মজা করে। এই দুই অংশের রান্নার মূল পার্থক্য খাবারে মিষ্টির ব্যবহারে। কলকাতার স্থানীয়রা রান্নায় মিষ্টি দেন বেশি। তিনি নিজে কিধরণের খাবার পছন্দ করেন জানতে চাইলে বললেন, তার পছন্দ একদম খাঁটি বাঙালি খাবার। শুঁটকি, মাসকলাইর ডাল, শিমের বিচির তরকারি, কচু এসবই তার পছন্দ।
হোটেল ম্যানেজমেন্টে ডিপ্লোমা থাকলেও আছে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্র সাহিত্যের উপর মাস্টার্স ডিগ্রী। ৯৩ সাল থেকে কাজ করেছেন কলকাতার বিখ্যাত পিয়ারলেস ইনের আহেলি রেস্তোরায়। সবমিলিয়ে রান্নার অভিজ্ঞতা প্রায় তিরিশ বছরের।
বাঙালি এবং কনটিনেন্টাল সবধরণের রান্নায় পারদর্শী দীপক ভট্টাচার্যের বাংলা খাবারের প্রতি অসম্ভব ভালোবাসা। তিনি মনে করেন রেস্তোরার টেবিলে যদি মমো, স্যুপ, সুশি, বা অন্য খাবার পরিবেশন করা যায় তাহলে বাংলার কচুঘেঁচুও কেন দেওয়া যাবেনা। সেই ভাবনা থেকেই মুনমুন’স কিচেনে রয়েছে হরেক রকমের বাংলা খাবারের ব্যবস্থা। ঘি, কাজু এসব ব্যবহারে দাম বেড়ে যায়। রেস্তোরার আয়োজকরা নিজেরাই তদারকি করেন সব। রান্নায় ব্যবহার হয় খাঁটি ঘি, বাদাম, দুধ ইত্যাদি। স্বাস্থ্যগত মান ঠিক রাখতে সব রান্নায় ফিল্টারের পানি ব্যবহার করা হয়।
বাংলাদেশে প্রথমবারের মত কাজ করতে এসেছেন। নতুন জায়গায় নতুন চাকরির চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি প্রতিদিন বাংলায় কথা বলার অন্যরকম আনন্দ আছে বলে জানালেন দীপক ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, শেফ হিসেবে তৃপ্তি পান যখন লোকজনকে প্রথমে অনাগ্রহ নিয়ে খেতে বসলেও খাওয়া শেষে হাসিমুখে বের হতে দেখেন। আনন্দ কয়েকগুণ বেড়ে যায় যখন অনেককেই বারবার ফিরে ফিরে আসতে দেখেন।
এইযে তার রান্না খেতে খাদ্যরসিকরা বারবার আসছেন এর রহস্য কি? দীপক ভট্টাচার্য বলেন, রান্না তার কাছে বিজ্ঞান। সবারই মায়ের হাতের রান্না মজা লাগে কারণ মা জানেন তার সন্তানদের পছন্দ কেমন। কিন্তু রেস্টুরেন্টে অনেকের জন্য রাঁধতে গেলে তাকে সব উপাদানের পরিমাপ আর রন্ধপ্রণালী ঠিক রাখতেই হয়। নিজেকে তাই রন্ধনশিল্পী না বলে ফুড সাইন্টিস্ট বলতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন দীপক। তিনি বলেন, খাবার তখনই স্বাদের হবে যখন খাবারের উপাদান, মাপ আর রন্ধনপ্রণালী ঠিকঠাক থাকে। খাদ্যবিজ্ঞানের সাথে নিজের সিল্পসত্তাকে মেশানোর চেষ্টাই তার রান্নাকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে বলে মনে করেন মুনমুন’স কিচেনের এক্সিকিউটিভ শেফ দীপক।
এদেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাস বুঝতে ঢাকার স্থানীয় জনপ্রিয় রেস্টুরেন্টগুলোর খাবার চেখে দেখেছেন তিনি। বলেন, এদেশের খাবারের স্বাদ তার কাছে কিছুটা আলাদা মনে হয়েছে। আবার মুনমুন আহমেদ, তামান্না রহমান, উজ্জ্বল চ্যাটার্জিদের পরামর্শ নিলেও তিনি তার মত করেই রান্না করেন। এভাবেই মুনমুন’স কিচেনের খাবার হয়ে উঠেছে সবার থেকে আলাদা আর স্বাদে অনন্য।
যেকোন ঘরোয়া অনুষ্ঠানের জন্য আগে থেকে খাবার অর্ডারের ব্যবস্থা আছে। বিশ জন থেকে শুরু করে পাঁচ হাজার লোকের খাবারের অর্ডার নেন তারা। ছোট অর্ডারের ক্ষেত্রে অ্যাডভান্স করা না লাগলেও বড় অর্ডারের লোকসংখ্যা বুঝে চল্লিশ থেকে ষাট শতাংশ অ্যাডভান্স নেওয়া হয়।
পার্সেলের দাম পড়বে- ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা। ভেজ থালির দাম ২০০ টাকা আর ননভেজ থালি ৩০০ টাকা। পোলাও ভেজ থালি ২৫০ টাকা আর পোলাও নন ভেজ থালি ৩৫০ টাকা। সব খাবারের সাথে ১৫% ভ্যাট।
যেকোন পার্টির জন্য পোলাও পার্সেলে থাকবে পোলাও, চিকেন কষা, ১ টা পেয়াজি, ১ টা বেগুনি আর ঘন ডাল। সাদা ভাত পার্সেলে ভাতের সঙ্গে ডাল, শাক, ভর্তা। খিচুড়ি পার্সেলে সবজি খিচুড়ির সঙ্গে বেগুনভাজা, মুরগি। মাছ-ভাত পার্সেলের পাবেন একপিস মাছ, ডাল, একটা ভর্তা, একটা শাক। এছাড়াও আছে ভেজিটেরিয়ান পার্সেল যেখানে ভাতের সাথে আছে ডাল, শাক, ভর্তা, আলুর দম/ধোকার ডালনা/ ছানার ডালনা/ফুলকপির তরকারি ইত্যাদি। এছাড়াও আছে আরও কিছু কমবিনেশনের পার্সেল। এসব পার্সেলের দাম পড়বে ১০০ থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে।
ঢাকা, যে মহানগরীতে গাছের চাইতে বাড়ি বেশি। খোলা মাঠের চাইতে বেশি সুপার মলের সংখ্যা। পরিবার কিংবা বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোর মত পার্কও আছে হাতেগোনা। তবে চারপাশে নিত্য নতুন খাবারের দোকানের ছড়াছড়ি। দেশি-বিদেশি এমন কোন খাবার নাই, যা আজকাল ঢাকায় পাওয়া যায়না। বিনোদনের সুযোগ কমে যাওয়ায় মহানগরীর বাসিন্দারা এখন নানারকম রেস্টুরেন্ট বা ফুড জয়েন্টেই সময় কাটান, মেতে ওঠেন আড্ডায়। তেমনই একটা নতুন আড্ডার জায়গা হয়ে উঠতে গড়ে উঠেছে মুনমুন’স কিচেন। যেখানে রসনাবিলাসের সাথে মিলবে ঐতিহ্যবাহী খাবারের অনন্য স্বাদ।
ছবি: আশীষ সেনগুপ্ত
সারাবাংলা/আরএফ/ এসএস