বাঙালির বসন্ত উৎসব চিরজীবী হোক
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১২:১৪
।। রাজনীন ফারজানা ।।
‘তোমার অশোকে কিংশুকে, অলক্ষ্য রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে’
বসন্ত আসেই যেন আমাদের হৃদয়ে অকারণ খুশির দোলা দিতে। যেদিকে চোখ যায়, যেন রঙের রায়ট। এদিকে চোখ গেল তো গোধূলিরঙা পলাশ, আরেক দিকে রক্তলাল কৃষ্ণচূড়া। দখিনের জানালা খুললেই মিষ্টি বাতাস আর সারাদিন নরম কুসুমের মতো রোদ। এমন দিনেই তো উৎসব জমে ওঠে। বাঙালির বারো মাসের তেরো পার্বনের সূচনাও হয় এমনই এক ঋতুতে, যখন মানুষের মন ঠিক যেন কবিগুরুর ভাষায় ‘অলক্ষ্য রঙে’র ছোঁয়ায় অকারণের সুখে’ ভরে ওঠে।
পাতাঝরা শুষ্ক শীতের শেষে আসে রঙে রঙিন বসন্ত। চারদিকে নতুন পাতা আর ফুলের সমাহার। বাংলার ছেলে-বুড়ো সবার প্রিয় ঋতু বসন্ত। বসন্ত বারবার নানা রঙে ও নানা রূপে ফুটে উঠেছে হাজারও কবির কবিতায়, শিল্পীর তুলির আঁচড়ে। কখনও বন্দনা বসন্তের বাতাসের, তো কখনও আরাধনা বসন্তের ফুলের সুবাসের। এই নির্মম শহরেও মাঝেমধ্যেই শোনা যায় কোনো এক গাছের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা কোকিলের কুহু ডাক। বসন্তই তো ফাগুনের রঙে রাঙিয়ে ওঠার দারুণ উপলক্ষ।
ইংরেজি বছরের প্রথম বড় উৎসব পহেলা ফাল্গুন। ব্যস্ত নগরীর ঘেমে ওঠা কোলাহলের মধ্যেও রাস্তার মেহগনি বা বকুলের ভিড়ে উঁকি দেওয়া পলাশ বা কৃষ্ণচূড়া মনে দোলা দেয়। সে দোল অবহেলা করলে প্রকৃতি বড় অভিমান করতে পারে। তাই প্রকৃতির রঙে সাজিয়ে তুলুন নিজেকে। বসন্ত উৎসব হয়ে উঠুক আমাদের নববর্ষের রঙিন সূচনার সিঁড়ি। বসন্ত বরণ দিয়ে বাংলাদেশে যে উৎসবের সূচনা, তার রেশ ধরে একে একে আসে চৈত্র সংক্রান্তি, পহেলা বৈশাখ এবং আরও কত কত উৎসব।
বাংলার ছয় ঋতু আসে ছয় রকমের বৈচিত্র্য নিয়ে, ভিন্ন ভিন্ন উৎসবের উপলক্ষ হয়ে। তবে সব উৎসবের মধ্যে পহেলা ফাল্গুন আর পহেলা বৈশাখ আমরা বড় করে উদযাপন করি। কারণ এই দুই উৎসব আমাদের মনে করায়— আমরা বাঙালি, এই দুই উৎসব আমাদের রক্তে জাগায় বাঙালিয়ানার নবজাগরণ।
সেই বাঙালি চেতনা জাগ্রত করতেই আমরা শাড়ি-পাঞ্জাবি পরি, সাজি ফুলেল সাজে। মেয়েদের কপালের সিঁদুরে, কুমকুমের টিপ, আর পায়ের আলতা আমাদের মনে করায়— আমরা বাঙালি। আর সেই সঙ্গে নাচ-গানের ছন্দ আমাদের মনে জাগায় অপার আনন্দ। আমরা সারাবছরের জীবনযুদ্ধ ভুলে মেতে উঠি ফাগুন উৎসবে।
ফাল্গুনের বাঙালি নারীর প্রথম পছন্দ শাড়ি। এদিন শাড়ির সাথে চুড়ি, টিপ আর ফুলের গয়না পরতে কার্পণ্য করলে চলবে কেন! পল্লীকবি জসিমউদ্দীনের ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে আমরা দেখি, ‘মাঠের যতনা ফুল লয়ে দুলী পরিল সারাটি গায়, খোঁপায় জড়ালো কলমীর লতা, গাঁদা ফুল হাতে পায়।’
আসুন আমরাও সেজে উঠি দুলির মতো ফুলেল সাজে। আর রঙিন শাড়ির সঙ্গে হাতভর্তি চুড়ির রিনঝিন শব্দ যেন বসন্তেরই আগমনী গানের কোরাস। কপালের রঙিন টিপ দেখে মুখ টিপে হেসে উঠবে রক্তিম শিমুল। ফুলের বনে মধু খেয়ে মাতাল ভ্রমর পথ ভুলে লুটিয়ে পড়ুক মাথায় ফুলের মুকুটে বা হাতে ও গলায় ঝুলানো ফুলের মালায়।
ছেলেরাই বা পিছিয়ে যাবেন কেন? এমন দু’চারটা পার্বণই তো আমাদের মনে করায় আমরা বাঙালি। তাই চলুন না, আজকের দিনে নিজেদের সাজিয়ে তুলি বসন্তের রঙে। বসন্ত উৎসব করব আর রঙের খেলায় মাতব না, তা তো হয় না! এদিনের সাজে চাই লাল, হলুদ, কমলা কিংবা সবুজ পাঞ্জাবি বা ফতুয়া। মাথায় বাঁধা কিংবা গলায় ঝোলানো থাকলই না হয় একটা রঙিন গামছা। বসন্ত উৎসব তো এমনই হওয়া উচিত, যেখানে রঙের যেন ঘাটতি না হয়।
এই অঞ্চলের বসন্ত উৎসবের ইতিহাস বেশ পুরনো। নানা পৌরাণিক উপাখ্যান ও লোককথায় এর উল্লেখ পাওয়া যায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় থেকে শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতের মাধ্যমে বসন্তোৎসব পালনের রীতি চলে আসছে। বঙ্গাব্দ ১৪০১ সাল থেকে বাংলাদেশে প্রথম ‘বসন্ত উৎসব’ উদযাপন করার রীতি চালু হয়। সেই থেকে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ বসন্ত উৎসব নিয়মিত আয়োজন করে আসছে। দিনটি বরণ করতে এই পরিষদ প্রতিবছর চারুকলার বকুলতলায় এবং ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরের উন্মুক্ত মঞ্চে জাতীয় বসন্ত উৎসব আয়োজন করে। বসন্ত উৎসব বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড ও উড়িষ্যাসহ আরও কিছু রাজ্যে উদযাপিত হয়।
আমাদের ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনে নানারকম সংকটের মধ্যে দিয়ে যাই। আবার কখনও মৌলবাদ, কখনও সাম্প্রদায়িক অহিংসা আর জঙ্গিবাদ এসে বাঙালির অহিংস আর উৎসবমুখর স্বত্বাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। এইসব হিংসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হতে পারে বাঙালির জাতীয় উৎসবগুলোতে বাংলার চিরন্তন সাজে সেজে পথে নামা। তাই আসুন আমরা এবারের ফাগুন রাঙাই উৎসবের রঙে, অহিংসা আর প্রেমের সংগীতে নেচে-গেয়ে, আনন্দে মেতে।
আলোকচিত্র- ফারহানা আকতার, সুমিত আহমেদ এবং অলিউল্লাহ আল মাসুদ
সারাবাংলা/আরএফ/এসএস/