ছাদবাগানের রূপবতী ফাগুনবউ আর জমকালো বাসরলতার গল্প
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৫:১৫
পর্ব- ৩৬
ফাগুন, এক প্রতীক্ষার মাস। রঙের ছড়াছড়ি আর মাখামাখির মাস। শীতের রুক্ষতায় খটখটে হওয়া সব বৃক্ষদের গা ঝাড়া দিয়ে কচি সবুজরঙা পাতার আগমনী মাস। ফাগুন মনে হলেই আগুন রঙা শিমুল পলাশ ফুলেদের লুটোপুটির কথা মনে আসে। ফাগুন আসলে সোনা রঙা শাড়িতে কন্যারা সাজে। ফাগুনের দ্রোহ মাখা প্রলয় দোলা আমাদের রক্তে বাহিত হয়। একুশে ফেব্রুয়ারীর সুর আর বইমেলার নতুন বইয়ের ঘ্রাণ মিলেমিশে একাকার হয়ে ধাবিত হয় নগর জীবনে। আজকে ফাগুনের দুটো ফুলের গল্প বলবো।
শিমুল পলাশ বাদেও ফাগুনের ফুল হিসেবে ফাগুনবউ ফুলের কথা না বললেই নয়। সবার কাছে সাধারণত সোনাপাতি, স্বর্ণপ্রভা, টিকোমা নামে পরিচিত হলেও রবিকবি এই ফুলের নাম দিয়েছিলেন ফাগুন বউ। বাংলাদেশের প্রায় বাড়ি বা পার্কে ফাগুন বউ গাছের সন্ধান পাওয়া যায়। রবিকবির প্রিয় ফুলের তালিকায় এর নাম দেখে প্রায় বছর দুই আগে ফাগুন বউ গাছের চারা খুঁজতে নেমেছিলাম। আগারগাঁও এর এক নার্সারিতে যখন প্রথম এই গাছের সন্ধান পেয়েছিলাম তখন মনে কষ্ট হয়েছিল খুব। হাতিরঝিলের সবুজ ঝাঁকড়া পাতার সাথে থোকা থোকা গাঢ় সোনালী হলুদ ফুলের বাড়াবাড়ি, না আমার দত্তক নেয়া চারাটি ছিল একেবারে লিকলিকে। পাঁচ ছয়টা পাতা শুধু আর ডাল হেলে পড়ছিল বারবার।
বেশি ছোট হওয়ায় তাকে মাঝারি মাটির টবে বাসস্থান করে দিয়েছিলাম। অবাক কান্ড, ধুপধাপ করে সবুজ পাতায় ভরে গিয়েছিল পনেরো দিনের মাথায়। সাথে কুঁড়ির আগমনে আশ্চর্য হয়েছিলাম অনেক। দুই মাসের মাথায় তাকে বেশ বড়সড় একটা বাসস্থান তৈরী করে দিয়েছিলাম। মাটি আর জৈবসারের মিশ্রনে একটা মাঝারি ড্রামে। অদ্ভুত গাছ এই ফাগুন বউ। শীত শেষ হবার আগ দিয়েই ফুল ফোঁটানো আরম্ভ করে। ফাগুন আসলে ফুলের সংখ্যা বেড়ে যায় দ্বিগুণ। আর সারা বছর দুই একটা ফুল দিতে থাকে কিন্তু গাছের তেমন বেশী পাতা দেখা যায় না। এখন আমার ফাগুন বউ বেশ বড় হয়েছে। যদিও বছরে একবার ছেঁটে দেই তাকে। আর একবার গোড়ার মাটি আধহাত সরিয়ে নতুন মাটি আর জৈবসার দিয়ে থাকি। জল দিতে হয় রোজ। নরম গাছ, জলের অভাবে নেতিয়ে যায়। অতি রোদেও একই অবস্থা হয়ে থাকে।+
ফাগুনের আরেকটি অতি প্রিয় ফুল, বাসরলতা নাম যার। অসাধারণ শৈল্পিক আঙ্গিকে বাসরলতার বসবাস। প্রথম যেদিন বাসরলতা গাছ দেখেছিলাম সেদিনই আবার প্রমাণ পেয়েছিলাম, প্রকৃতি আমাদের জীবনমাতা। প্রকৃতি আমাদের শিখিয়েছে যাপিত জীবনের সকল ধারা। প্রকৃতি দিয়েছে ক্ষুদা নিবারণের উপকরণ। প্রকৃতি আর জীবন একে অপরের সাথে জট বেঁধে বসবাস করে। গাছ দত্তক নেয়ার তালিকায় যুক্ত হয়েছিল এই ফুলের নাম। খুঁজতে খুঁজতে ব্র্যাক নাসারীতে একখানা ছোট্ট চারা পেয়ে গিয়েছিলাম এই বছর শীত শুরুর সময়।
বাসরলতা অন্যের কাঁধ ছাড়া বেড়ে উঠতে পারে না। কাঁধ পেলেই লতিয়ে ধরধর করে বড় হয়ে ওঠে। মাঘের শেষে বাসর লতার একটা দুটো করে গুচ্ছ ধরে কুঁড়ি বের হতে থাকে। প্রতিটা পাতার গিঁট থেকে ঝুলে ঝুলে বের হয়। বেশ সময় নিয়ে বাসরলতা ফুলের পরিপূর্ণতা আসে। আমার ছাদবাগানে বাসরলতার জন্য বাসস্থান হিসেবে মাঝারি ড্রাম আর কাঁধ হিসেবে ছোট চারকোনা মাচাঙ করে দিয়েছি। তড়তড়িয়ে মাচাঙ ধরে উঠে গেছে সে। ফাগুন শুরু না হতেই কুঁড়ি থেকে ফুল বের হওয়া শুরু হয়েছে। মাচাঙ এর নিচে দাঁড়ালে মনে হয় নতুন দম্পতির বাসর ঘরের খাটে বসে আছি। খাট জুড়ে কাগজ বা তাজা ফুলের ঝুলানো লহর যেমন ঠিক তেমন করে ঝুলে ঝুলে ফুলগুলো বাতাসে দুলে দুলে থাকে। কে জানে কত শত বছর আগে বাসরলতা ফুল দেখে বাসর ঘর সাজানো কোন মানুষটি শুরু করেছিল!!
বাংলাদেশের ফুলের তালিকা ধরে সব গাছ সংগ্রহে এনে বাগান করতে গেলে হয়তো দুই এক একর জায়গা লেগে যাবে। ছাদবাগানে আমি অতি সাধারণ কিন্তু বিলুপ্তপ্রায় বাংলাদেশি ফুল গাছ সংগ্রহ করা শুরু করেছি। সীমিত জায়গা তাই বেছে বেছে গাছ দত্তক আনি। আজকে গাছ দুটো খুব সহজে আপনার ছাদে বা বারান্দায় বেড়ে উঠবে। প্রতিদিন জল ছাড়া তেমন কোন যত্ন লাগে না। শুধু রোদের আনাগোনাটা জরুরি। আগামী ফাগুনে আমার মতন ফাগুন বউ আর বাসরলতা ফুল আপনার কাছে দেখবো, আশা করতেই পারি। আমরা যে চাষী পরিবার, সুখি পরিবার।
সারাবাংলা/আরএফ/এসএস