যখন গায়ে হলুদ হয় ‘হালদি’ আর বৌভাত ‘ওয়ালিমা’; আমরা তখন কী?
৩০ জানুয়ারি ২০১৮ ১৫:১৭
রাজনীন ফারজানা।।
সাথী কিছুদিন আগে এক বান্ধবীর বিয়েতে গিয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা ছবির একটি অ্যালবামের নাম দিল সে ‘জারা’র হালদি নাইট’।
তাকে জিজ্ঞাসা করা হল ‘হালদি’ কী জিনিস, কোন ভাষার শব্দ। উত্তরে সে বলে যে নিজেও জানে না কেন, সবাই দেয় তাই সেও দিয়েছে। তবে তার মনে হয় এটা হিন্দি শব্দ।
‘হলুদ বাটো মেন্দি বাটো, বাটো ফুলের মৌ
বিয়ের সাজে সাজবে কন্যা করম চারণ বউ’
এই প্রজন্মের বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই হয়ত এই গান শোনেনি। কিন্তু ৫ থেকে ৮৫ সব বয়সীকেই জিজ্ঞেস করুন। দেখবেন, তারা ভারতীয় অভিনেত্রী ক্যাটরিনার ‘কালা চশমা’ শিরোনামের গানটি ঠিকই শুনেছে। কারণ, এই গান এখন বিয়ের অনুষ্ঠানের হিট বা জনপ্রিয় গান।
শুধু গানই যে হিট তাই নয়, গায়ে হলুদে বা বিয়ের অনুষ্ঠানে এসব গানের পাশাপাশি বলিউডের নায়ক নায়িকাদের অনুকরণে পোশাক, সাজগোজ আর নাচও আজকাল নিজেকে ট্রেন্ডি বা যুগোপযোগী দেখানোর অনুসঙ্গ।
ঠিক কবে থেকে ‘হলুদ বাটো মেন্দি বাটো’ গানের সাথে সাথে বিয়ের অনুষ্ঠানমালা থেকে বাঙালি সংস্কৃতি হারিয়ে গেল তা দিন তারিখ নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব না। কিন্তু ব্যপারটা চলতি শতাব্দীর প্রথম দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়েছে। আজকাল সব জায়গাতেই এই ব্যপার দেখা যায়।
সাংবাদিক ও অনলাইন একটিভিস্ট আরিফ জেবতিক বলেন, সামগ্রিকভাবেই আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির উপর হিন্দি সংস্কৃতির প্রভাবের কারণে জীবনযাপনের ধারা বদলে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে বিয়ে শাদীর অনুষ্ঠানেও।
তিনি বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে অনেকের হাতেই প্রচুর টাকা এসেছে। আর বিয়েতে জাঁকজমক করাটাকে তারা টাকা খরচের একটা উপলক্ষ্য হিসেবে নিয়েছে। হাতের কাছে হিন্দি সিনেমা এবং চ্যানেল থাকায় তাই বিয়ের অনুষ্ঠানে তারা বলিউডি সংস্কৃতিকেই লুফে নিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এম সাইফুল ইসলামের মতে, সংস্কৃতি গতিশীল তাই সময়ের সাথে সাথে এর পরিবর্তন স্বাভাবিক। আর বছর দশেক কিংবা তারও আগে প্রযুক্তি মানুষের অতটা হাতের মুঠোয় ছিলনা তাই তখন বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রভাব ততটা পড়েনি। আর এখন সবার হাতের মুঠোয় প্রযুক্তি, টেলিভিশনে বিদেশি অনুষ্ঠান দেখার ঝোঁক বেশি। তাই মানুষ খুব সহজেই অন্য সংস্কৃতিকে নিজেদের করে নিচ্ছে।
গত কয়েক দশকে বিদেশি সংস্কৃতিকে এমন অন্ধ অনুকরণের হার বেড়েছে। অন্যের সংস্কৃতি নিয়ে এমন গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যাবার উদাহরণ আমাদের দেশেই বেশি। এটি খুবই লজ্জার। আরিফ জেবতিক এবং ড. ইসলাম দুজনই এধরণের প্রবণতাকে আইডেন্টিটি ক্রাইসিস বা জাতিগত সংকট বলে অভিহিত করেন।
ড. ইসলামের মতে, আমরা জাতি হিসেবেই অনুকরণপ্রিয়। এর প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে প্রায় দুইশ বছরের ব্রিটিশ শাসন, তার আগের চারশ বছরের মোঘল শাসন ইত্যাদির প্রভাবে।
তরুণ প্রজন্মের অনেকের সাথে কথা বলে ব্যাপারটা বোঝা যায় যে আমরা আসলে বিভ্রান্ত যে কোনটা গ্রহণ করব আর কোনটা বর্জন করব তাই নিয়ে। কেউই নির্দিষ্ট করে বলতে পারে না ঠিক কবে থেকে আমাদের প্রচলিত বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা বাদ দিয়ে আজকাল অনেকগুলো নাম না জানা অনুষ্ঠানের প্রচলন হল আর তারা কেনই বা এটি অনুকরণ করছে।
একসময় আমাদের দেশের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানগুলোতে নামের ভিন্নতা আনা হোত ‘হলুদ ছোঁয়া’, ‘হলুদ সন্ধ্যা’ কিংবা ‘অমুকের গায়ে হলুদ’ ইত্যাদি নামে। দেখা যেত বর এবং কনে পক্ষ দুদিন দু’বাড়িতে আলাদা আলাদা করে হলুদের তত্ব নিয়ে হলুদ দিতে যাচ্ছে। মেয়েরা সব একইরকমের শাড়ি আর পুরুষেরা একইরকমের পাঞ্জাবি পরত। অনেকে আবার তত্বের ভেতরে আলাদা আলাদা জিনিসে আলাদা আলাদা চিরকুট লিখে দিত। অন্য পক্ষকে স্বাগত জানাতে হলুদ আর লাল কিংবা সবুজ পোশাক পরে হাতে রজনীগন্ধা আর গোলাপ হাতে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত অন্যপক্ষ। কেউ কেউ ফুলের সাথে ছোট ছোট সাবান, চিরুনি, মোমবাতি, রাখী, চাবির রিং, চকলেট ইত্যাদি দিয়ে উপহারের প্যাকেট বানাত। আরিফ জেবতিক বলেন, ‘স্টেজ সাজিয়ে, তত্ত্ব নিয়ে গাঁয়ে হলুদ দেওয়াও খুব পুরনো সংস্কৃতি নয়। আশির দশকের শেষের দিক থেকে এর প্রচলন শুরু হয়েছে। কিন্তু এতে দেশীয় সংস্কৃতির ছোঁয়া ছিল। বাঙালি গাঁয়ে হলুদের সংস্কৃতি হিসেবে এটা চমৎকার ছিল। কিন্তু আকাশ সংস্কৃতির প্রাদুর্ভাবে হিন্দীর আধিপত্য বাড়ায় আমাদের জীবনযাত্রার সব ক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়েছে। আর এভাবেই নব্বই দশকে প্রদর্শনবাদিতার কারণে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় বলিউডের প্রভাব পড়েছে সবচাইতে বেশি।’
বিয়ের নানা আয়োজন, তত্ত্ব সাজানো, হলুদ বাটা, মেহেদী বাটা, বরযাত্রী কিংবা কনেপক্ষর জন্য ছোট ছোট উপহারের প্যাকেট করা, সারাবাড়িতে আলপনা আঁকা, স্টেজ সাজানো, ছোট ছোট মাটির প্রদীপ আর হাড়িতে রঙ করে সাজানো, মিষ্টান্ন কিংবা পিঠা বানানো সব মিলিয়ে বিয়ে মানে ছিল প্রকৃত অর্থেই এলাহী আয়োজন। আর সেই আয়োজনে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব প্রতিবেশী সবার মিলিত অংশগ্রহনে মুখর হতে উঠত বিয়ে বাড়ি। এমনকি গায়ে হলুদে আশপাশের বাড়ি থেকে আসত বাড়িতে তৈরি মিষ্টি খাবার বা হলুদের সাজানো থালা। আর গ্রামের দিকে তো গায়ে হলুদে রঙ খেলা ছিল অন্যতম আনন্দ আয়োজন। সেসব আয়োজনে মানুষের হৃদ্যতা আর আন্তরিকতা মিশে থাকত। তাই এক বাড়িতে বিয়ে মানে ছিল পাড়া শুদ্ধ সবার আনন্দে মেতে ওঠার উপলক্ষ।
দিনে দিনে আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে সমাজে পরিবর্তন আসবে এটা স্বাভাবিক হলেও আমাদের দেশের মত একবারে হঠাৎ করে বদলে যাওয়াটা খুব চোখে লাগে অনেকেরই। তাই বিয়েতে হিন্দি সংস্কৃতি অনুকরণ নিয়ে সমালোচনাও আসে। নিজেদের নিয়ে জাতিগত স্বত্বা নিয়ে আমাদের আত্মসম্মানবোধের অভাব এতটা প্রকট হল কবে থেকে আর কীভাবে- এর উত্তরও খোঁজেন অনেকে। ড. ইসলাম বলেন, এর নির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া কঠিন তবে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে তুলে ধরার অভাব অনেকাংশেই এর জন্য দায়ী। সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপন সবক্ষেত্রেই নিজস্ব বিয়ের সংস্কৃতিকে ক্রমাগত অবহেলা করার কারণেই মানুষ নিজেকে যুগোপযোগী দেখাতে অন্যদেশের সংস্কৃতির অনুসরণ করছে অন্ধের মত।
আরিফ জেবতিক মনে করেন, আমাদের মিডিয়ার পাশাপাশি শো-বিজ জগতের তারকারাও নিজেদের ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ। যাদের মানুষ অনুসরণ বা অনুকরণ করে তারা অনেকসময় বিদেশি পোশাক কিংবা আনুষ্ঠানিকতাকে প্রমোট করে। এতে করেও মানুষ দেশি শাড়ি বাদ দিয়ে বলিউডি ডিজাইনারের শাড়ি কিনতে আগ্রহী হয়।
এক সময়ে বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হত এনগেজমেন্ট আর হিন্দুদের মাঝে আশীর্বাদের মাধ্যমে। তারপর গায়ে হলুদ, বিয়ে আর সবশেষে বৌভাত। আর সব অনুষ্ঠানেই বরপক্ষ আর কনেপক্ষ কয়েকবার করে আসা যাওয়া করত একে অন্যের বাড়িতে। এতে করে পারস্পারিক আদান প্রদান আর বোঝাপড়াও বাড়ত।
এখনও আনুষ্ঠানিকতা অনেক আগে থেকেই শুরু হয় তবে তা হয় প্রিওয়েডিং ফটোশুটের মাধ্যমে। তারপর ব্রাইডাল শাওয়ার, জয়েন্ট গায়ে হলুদ, সঙ্গিত বা মেহেন্দি নাইট আর শেষে রিসেপশন। কেউ কেউ আবার রিসেপশনের নাম দিচ্ছে ‘ওয়ালিমা’। কারণ ‘বৌভাত’ শব্দটা ভীষণ ‘ক্লিশে’ আর ‘ততটা হ্যাপেনিং’ না আজকাল বলে মনে করছেন অনেকে। আর এখনকার দিনের বিয়ের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে গায়ে হলুদ আর সঙ্গীত, যেখানে প্রধান আকর্ষন কে কতটা নির্ভুলভাবে হিন্দি সিনেমার হিট গানের তালে তালে সেদেশের নায়ক নায়িকার অনুকরণে নাচতে পারে।
আমরা যখন যুগোপযোগী হতে গিয়ে ভিনদেশী সংস্কৃতির অনুকরণ করছি তখন বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতির অস্তিত্ব হুমকির মুখেও পড়তে পারে বলে মনে করেন অনেকে। আমাদের নিজস্ব কোন সস্কৃতি আছে কি নাই তা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরির সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে অন্য দেশের মানুষের মনে।
বিয়ে একটা জাতির নিজস্ব সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান। এটার মাধ্যমে আমরা নিজেদের সঙ্গীত, নাচ, পোশাক, ঐতিহ্য বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে পারতাম। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। তবে কী এর থেকে মুক্তির উপায় নাই। ড. ইসলাম মনে করেন, এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। মিডিয়ার ভূমিকা হতে পারে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের নাটক, সিনেমা, গল্প, কবিতা, বিজ্ঞাপন, গান সবকিছুতেই প্রচলিত বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা আধুনিকভাবে তুলে ধরতে পারলে নতুন প্রজন্মের বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ কমে আসবে। এছাড়াও আমাদের স্কুলের পাঠ্যসূচীতে ঐতিহ্য হিসেবে যোগ করা যায় বিয়ের গানসহ আচার অনুষ্ঠান। আর একটি বিষয়ে তিনি গুরুত্ব দেন আর তা হল, পরিবারের ভূমিকা। পারিবারিকভাবে বাবা মা সচেতন হলে সন্তানের মাঝে বিদেশি সংস্কৃতিকে অনুকরণের আগ্রহ কমে যাবে।
আরিফ জেবতিক বলেন, নিজেদের দেশি পোশাক এবং সংস্কৃতিকে তুলে ধরার কারনেই পহেলা বৈশাখ এখন এতটা জাঁকজমকের সাথে পালিত হয়। ঠিক একইভাবে মিডিয়া, বিনোদন, তারকারা সবাই দেশিয় বিয়ের আনুষ্ঠানিকতাকে তুলে ধরলে বাঙালি বিয়ের আনুষ্ঠানিকতাও মানুষের মনে জায়গা করে নেবে আর বলিউডি সংস্কৃতিকে অনুসরণের চলও কমে আসবে।
নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি আছে এমন জাতি খুব বেশি নাই পৃথিবীতে। এই বিরল সম্মানের অংশ আমরা তাই আমাদের সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে নিজেদের নিয়ে লজ্জিত না হয়ে গর্ব করার পথে পা বাড়াতে। আমরা নিজেদের সংস্কৃতিকে গর্ব আর আত্মবিশ্বাসের সাথে তুলে ধরতে শুরু করলে একদিন হয়ত আমাদের দেশের গাঁদা ফুলের মালা পরে আমেরিকান কোন বউকেও ‘লিলাবালী লিলাবালী বড় যুবতী সই গো, কী দিয়া সাজাইমু তোরে’ গানের সাথে কোমর দুলিয়ে আর হাত ঘুরিয়ে নাচতে দেখা যাবে!
ছবি- ইন্টারনেট
সারাবাংলা/আরএফ/এসএস