সেই স্কুলে থাকতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে নিয়ে পড়েছিলাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’। সেই আরণ্যক নামের কাল্পনিক অরণ্য যেন আমাদের আশপাশেই রয়েছে, কেবল তাকে অনুভব করবার কমতি। কাল্পনিক সেই অরণ্য আমাকে ভীষণ টানে। তার খোঁজে তাই প্রায়ই পাহাড়ে যাই।
এবার আরণ্যককে খুঁজতে গিয়েছিলাম চট্টগ্রামের মিরেসরাইয়ের নাপিত্তাছড়ায়। শুনেছিলাম এই ছড়ায় যাওয়ার পথ তুলনামূলক সহজ। তাছাড়া সময়ও কম লাগে, দিনে গিয়ে দিনেই ঘুরে আসা যায়। একদিনের এমন ট্রিপ সবসময়ই আমার কাছে দারুণ লাগে। তাই এই ট্রিপের প্রস্তাব ওঠার পর থেকেই উচ্ছ্বাসের কমতি ছিল না। কিন্তু আমরা যখন হাজির, তখন প্রকৃতি কিছুটা মুখ গোমড়া করে রেখেছে, চলছে তিন নম্বর সতর্ক সংকেত। বিরূপ আবহাওয়া আর ঝুম বৃষ্টির মধ্যেও এই ট্রেইলটা এখন পর্যন্ত আমার জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর সফর।
ঢাকা থেকে মিরেরসরাই যেতে সময় লাগে চার ঘণ্টা। শ্যামলীতে ১২টায় বাস আসার কথা থাকলেও আসলো সাড়ে ১২টার পর। আমার এবারের ভ্রমণের সঙ্গী ছিল সাত জন। এদের মধ্যে শুভ্রা আপু আর টিটো ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় দামতুয়া ট্রেইলে গিয়ে। দলের অন্য দুই সদস্য নিরব আর সেহনীলার জীবনের প্রথম ট্রেকিং এটা। অন্য তিনজন মানু আপা, মানস ভাই আর তাদের মেয়ে যারা।
এবার বেড়াতে গিয়ে আরও একবার অনুধাবন করলাম, একসঙ্গে ঘুরতে গেলেই সত্যিকারের মানুষ চেনা যায়। এই ভ্রমণে গিয়েই প্রথমবারের মতো পরিচয় মানু আপুর সঙ্গে। কিন্তু মনে হচ্ছিল, কত্তদিনের চেনাজানা! মানু আপা আর মানস ভাইয়ের ১১ বছরের মেয়ে যারা যেভাবে ট্রেকিং করলো, আমি রীতিমতো মুগ্ধ। ওকে দেখে ভাবছিলাম, ওর বয়স থেকে ট্রেকিং করলে হয়তো সবকটা ঝরনা দেখে শেষ করতে পারতাম এতদিনে!
বাস যখন মীরেরসরাই বাজার, তখন ভোর ৫টা ৫০। সেখানে শুভ্রা আপু আর টিটো ভাইকে নিয়ে রওনা দেই নয় দুয়ারী বাজারের উদ্দেশে। সেখান থেকে নাপিত্তাছড়ায় যাওয়ার সরাসরি কোনো বাস নেই। লেগুনা বা সিএনজি-ই ভরসা। এসেই পড়লাম বিড়ম্বনায়। তখন আমাদের দেখে এগিয়ে আসে ‘ইশরাত’ হোটেলের মালিক। তিনি রেল লাইনের আগে থেকেই আমাদের মোটামুটি কনভিন্স করে নিয়ে গেলেন তার হোটেলে। তিনি বললেন, তার হোটেলে ব্যাগ রাখা যাবে, ট্রেকিং শেষে জামা বদলানো যাবে, আর দুপুরের খাবারের অর্ডার দেওয়া যাবে। কিন্তু সারারাত জার্নি করে এসে সকালের নাস্তা খাব, তার দোকানে সেই ব্যবস্থাই ছিল না!
যাই হোক, প্রাথমিক বিড়ম্বনা শেষে রওনা হলাম নাপিত্তাছড়া ট্রেইলের পথে। ছোট ছোট চারটা ঝিরিতেই যে পরিমাণ পানির স্রোত ছিল, তাতে আন্দাজ করা যাচ্ছিল পাহাড়ি ঝিরি পথে কী পরিমাণ স্রোত হতে পারে। যত সামনে আগাই, তত বৃষ্টির তোড় যেন বেড়েই যাচ্ছে।
অবশেষ সেই অসীম সুন্দর ঝিরি পথ ধরে এগুতে লাগলাম। পথে নাম না জানা বহু ছড়া দেখে মনে হচ্ছিল যেন ছোট ছোট ঝরনার মিনিয়েচার। মনে হচ্ছিল, ঝিরির তীব্র স্রোত উল্টো পথে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে রীতিমতো বেগ পেতে হচ্ছিল।
কিছুদূর এগোতেই দেখা পেয়ে গেলাম প্রথম ঝরনার। স্থানীয়রা একে ডাকেন ‘উজিল্লা’। এই ঝরনার স্রোত অনেক বেশি থাকায় অনেকেই দড়ি ধরে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছিল। আমরা পাশের পাহাড় ধরে এর ওপরের স্লপে চলে এলাম। যাওয়ার পথে দেখলাম এক পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাসিন্দার বাড়ি। সেই বাড়ির জানালা খুললেই দেখা যায় ঝরনা। ভাবছিলাম, কী ভাগ্যবান এই বাড়ির বাসিন্দারা! কল্পনা করতে চেষ্টা করলাম, ভরা পূর্ণিমায় ঝরনার শব্দ শুনতে শুনতে জোছনা দেখতে কেমন লাগতে পারে।
এরপর দেখা পেলাম দ্বিতীয় ঝরনা ‘কুপিকাটা কুমে’র। মনে হচ্ছিল যেন ড্রাগনের গুহার সামনের দরজা। সেখান থেকে ধেয়ে আসছিল পানির ঢল। শুনলাম, গভীরতা বেশি হওয়ায় এখানে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। তাই বেশি ভেতরে যাওয়া নিষেধ। সেই প্রশান্তিময় জলের ধারায় দীর্ঘক্ষণ গা ভাসিয়ে রওনা হলাম বাকি দুই ঝরনার উদ্দেশে।
সেখান থেকে আমাদের সাথে সঙ্গী হলো গাইড অনিল দাদা। পাহাড়ের ওপরেই ইসমাইল ভাইয়ের দোকান। সেখানে পাওয়া যায় অপূর্ব স্বাদের লেবুর শরবত, শসা আর ডিম। ট্রেকিংয়ের মাঝ পথে এটা ছিল মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। এরপর ঠিক বাঁয়ের পথ ধরে হাঁটতেই অনেকখানি নেমে পেয়ে গেলাম আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর ঝিরিপথের। কী যে সুন্দর! মনে হচ্ছিল জলদেবতার রাজ্যে চলে এসেছি। একটু পরই দেখলাম পথ দুই দিকে চলে গেছে। বাঁ দিকেরটা বান্দর কুম বা বান্দরি ঝরনার পথে; আর ডান দিকেরটা মিঠা ছড়ি বা সেই কাঙ্ক্ষিত নাপিত্তাছড়া।
মিঠা ছড়ি যাওয়ার পথটা এত সুন্দর! নিজের চোখে যে না দেখেছে, তাকে বুঝিয়ে বলা সম্ভব না। মায়াবী সুন্দর ঝিরিপথ শেষে দেখা পেলাম মিঠা ছড়ির। আহা কী অপরূপ! এত উঁচু থেকে ছড়িয়ে পড়ছে ঝরনার জল! সেই জলের ধারায় ভিজতে ভিজতে মনে হচ্ছিল— কেবল শরীর নয়, ভেতরকার জমে থাকা সব কলুষও যেন নেমে যাচ্ছে। বুক ভরে নিলাম বিশুদ্ধতা।
সেই শুদ্ধতা নিয়ে আবার সেই দুই রাস্তার মোড়ে ফিরে রওনা দিলাম বান্দর কুমের উদ্দেশ্যে। এমন একটা ঝিরিপথ ধরে যেন অনন্তকাল ধরে হাঁটা যায়। প্রকৃতির প্রতিকূলতা মানুষকে শেখায় নিজের ভেতরকার অসীম শক্তি। তাই নিজের সক্ষমতা উপলব্ধির জন্য হলেও একবার পাহাড়ের কাছে যাওয়া উচিত।
এবার পেয়ে গেলাম অদ্ভুত গাম্ভী্যপূর্ণ দুই পাহাড়ের মধ্যের খাঁজে অবস্থিত ঝরনা ‘বান্দরকুম’ বা বাঘ বিয়ানি। এই ঝরনাও অনেক ওপর থেকে পড়ছিল। পাহাড়ের ফাঁপা দেয়ালে আমাদের কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, যেন পাহাড় দেবতার মন্দিরে চলে এসেছি।
মন্দিরে ইচ্ছেপূরণ আধুলি দিয়ে নিজের ইচ্ছেগুলোকে রেখে ফিরে এলাম নগর জীবনের পথে। ভরা বর্ষায় ঝরনার এই রূপ মস্তিষ্কের নিউরনে ভালোবাসা হয়ে বেঁচে থাকবে চিরদিন। মৃত্যুর ঠিক আগে মানুষ নাকি তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম স্মৃতিগুলো দেখতে পায়। আমিও আশা রাখি, জীবনের শেষ সময়ে ঝরনার এই মায়াবী রূপ দেখতে পাব। আবার ফিরে যাব কোনো এক ‘আরণ্যকে’।
ভ্রমণ শেষের উপলব্ধি
আমাদের দেশে এত সুন্দর সব টুরিস্ট স্পট আছে, অথচ যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঠিক দৃষ্টির অভাবে এখনাকার যোগাযোগ ব্যাবস্থা খুবই নাজুক। মীরেরসরাই থেকে নয়দুয়ারি হাট পর্যন্ত নেই কোনো নির্দিষ্ট পরিবহন। এ কারণে সিএনজি বা লেগুনাগুলোর ভাড়ারও কোনো ঠিকঠিকানা নেই। যার কাছে যেমন পায়, তেমন ভাড়াই হাঁকিয়ে বসে। আগে থেকে ধারণা না থাকলে সেখানেও দরকারের তুলনায় বেশি টাকাই খরচ করতে হবে। সিএনজি ৪০০ টাকা আর লেগুনা রিজার্ভ ৩০০ টাকা হলে ধরে নেবেন, ভাড়াটা ঠিকঠাক আছে।
ট্রেইল শেষ করে এসে চট্টগ্রামগামী হাইওয়ে বাসে ওঠাও অনেক সময় বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নয় দুয়ারী বাজার থেকে রেললাইনের পরে নাপিত্তাছড়া ট্রেইলটি একেবারেই কাঁচা রাস্তা, ঝরনার মৌসুমে যা পর্যটকদের জন্য বিরক্তির কারণ হতে পারে। এখানে থাকার মতো ভালো কোনো হোটেল নেই। তাই দিনে এসে দিনেই ফেরত যেতে হয়। থাকতে হলে চলে যেতে হয় মীরেরসরাই কিংবা চট্টগ্রাম শহরে। এতে অনেকেই এখানে আসতে নিরুৎসাহিত বোধ করে থাকেন।
তারপরও এলাকাবাসীকে ধন্যবাদ দিতে হয়, যারা নিজ উদ্যোগেই এখানে আসা ভ্রমণকারীদের জন্য কিছু রেস্টুরেন্টের মতো ব্যবস্থা করে রেখেছেন। ফলে ভ্রমণপিপাসুরা খাওয়া-দাওয়া, ব্যাগ রাখা, বাথরুম সারা, জামা-কাপড় বদলানোর মতো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজগুলো সেরে নিতে পারছেন। ট্রেইলে ঢোকার আগে ট্রেইলে পথনির্দেশনার দুইটি সাইনবোর্ডও চোখে পড়বে। এই দুইটি সাইনবোর্ডও বসানো স্থানীয়দের উদ্যোগেই। অথচ সরকারিভাবে একটু উদ্যোগ নিলেই নাপিত্তাছড়ার এই ট্রেইলটিতে অত্যন্ত নির্বিঘ্নে ও সুচারুরূপে ভ্রমণ করতে পারবেন পর্যটকরা।
সে সুযোগ তৈরি হোক বা না হোক, আপাতত নাপিত্তাছড়ার যে সৌন্দর্য মনের ভেতরে গেঁথে এলাম, সেটুকুই বহুদিন কাজ করবে সঞ্জীবনী হিসেবে।
লেখক: রেডিও ব্রডকাস্টার, এ বি সি রেডিও ৮৯.২ এফ এম