যে ঘর নিসর্গের, যে জীবন শিল্পের
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১২:৩৭
‘ভোর ৫ টায় পাখি আসে বারান্দায়। ঠিক ৭ টা পর্যন্ত থাকে। কখনও ফুলের ওপর বসে, কখনও বারান্দা পেরিয়ে ঘরের ভেতরে চলে আসে। ঘরে কেউ আছে কিনা পাখি হয়তো তা বুঝতে পারে না। ঢাকা শহরে যে পাখি আছে তা এই বাসায় এসে বুঝেছি’- কথাগুলো বলছিলেন লীমা হক। নির্মল এই অভিব্যক্তির মতোই মায়াময় সুন্দর ব্যারিষ্টার তানজীব-উল আলম ও অধ্যাপক লীমা হক দম্পতির বাসা। ছিমছাপ ও প্রাণবন্ত ঘরখানি যেন শিল্পীর আপন তুলিতে আঁকা।
চমৎকার খোলামেলা অন্দর
ভারী আসবাবে ঘর সাজানোর প্রতি নয় বরং বাসায় খোলামেলাভাব বজায় রাখার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন এই দম্পতি। এজন্য দেওয়াল যতটা সম্ভব কম রেখেছেন। ঘরের প্রায় তিনদিকেই গ্লাস ব্যবহার করা হয়েছে, যেগুলো প্রয়োজনমতো খোলা বা বন্ধ করা যায়। এই প্রসঙ্গে তানজীব-উল আলম বলেন, আইডিয়া অফ ওপেননেস বা খোলামেলা ভাবধারা বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। যেখানে দেওয়াল না দিলেই নয়, শুধু সেখানেই দেওয়া হয়েছে। ঘরের চারপাশে খোলা রাখার ইচ্ছা আগে থেকেই ছিল।
বারান্দাগুলোও একেবারে খোলা। বারান্দায় কোন গ্রিল বা ওপরে ছাদ দেওয়া হয়নি। প্রত্যেকটি ঘরের সাথে একটি করে বারান্দা আছে। তানজীব-উল আলম বলেন, ‘আমাদের পুরনো বাসার বারান্দায় গ্রিল ছিল। নতুন বাসায় গেলে গ্রিল বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা আগে থেকেই ছিল। গ্রিল না থাকার ব্যাপারটি শুনে প্রথমে অনেকেই ভয় দেখাত- বাচ্চারা পড়ে যাবে। এখন আমাদের বারান্দা দেখে সবাই মুগ্ধ হয়। গ্রিল না থাকায় পূর্ণিমা রাতে চাঁদ দেখতে বেশ ভালো লাগে।’
তানজীব-লীমা দম্পতি জানালেন, আত্মীয় ও বন্ধুরা বাসায় বেড়াতে এলে ভীষণ উপভোগ করেন এবং কেউ কেউ রিসোর্টের সাথেও তুলনা করেন। যেহেতু বারান্দা ও ঘরের পার্টিশন গ্লাসের, ফলে বৃষ্টি উপভোগ করতে অনেকেই আসেন তাদের বাসায়। সময় পেলে নিজেরাও বৃষ্টিতে ভিজতে ভোলেন না।
পরিপাটি আসবাব
‘ফার্নিচারের ক্ষেত্রে আমাদের দুজনেরই মিনিমালিষ্ট অ্যাপ্রোচ (ছিমছাম) পছন্দ। ভারী ফার্নিচার অনেকসময় জবরজং মনে হয়। খুব উঁচু না, বরং চোখের সামঞ্জস্য রেখে ফার্নিচার কেনা হয়েছে।’ জানালেন গৃহকর্তা। দেওয়াল ও আসবাবপত্রের ক্ষেত্রে বেজ রং (চাপা সাদা) রাখা হয়েছে। যে রঙের উপস্থিতি নজরকাড়া না হলেও চোখের জন্য অত্যন্ত আরামদায়ক। একারণে ঘরে ঢুকলেই শান্তির আবেশ পাওয়া যায়।
দেওয়াল একটু ভিন্ন
দেওয়ালের একটি অংশে প্লাস্টার নেই। কারণ জানতে চাইলে তানজীব-উল আলম জানান, এই ধারণাটি হলো ‘bringing outside into your home’, যা তাদের স্থপতির কাছ থেকে পাওয়া। যেহেতু বিল্ডিংয়ের বাইরেও প্লাস্টার নেই, তাই বাইরের সাথে সামজ্ঞস্য রেখে বাসার ভেতরের একটি অংশে প্লাস্টার করা হয়নি।
আঁকা ছবি বা পেইন্টিং এর প্রতি আকর্ষণ
বিশ্বে অসংখ্য বিখ্যাত পেইন্টিং আছে। চিত্রকররা রংতুলির জাদুতে ফুটিয়ে তুলেছেন অসংখ্য গল্প, অনুভূতি আর ঘটনাপ্রবাহ। তানজীব-উল আলমের সংগ্রহে আছে এমনই সব অসাধারণ পেইন্টিং। দেশীয় চিত্রকরের পেইন্টিং তো আছেই, এছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘুরতে গেছেন সেখান থেকেই নিয়ে এসেছেন জগৎখ্যাত চিত্রকরদের আঁকা ছবি। শৈল্পিক দৃষ্টি ও সৃষ্টিশীল মনের পরিচয় যেন এই বাসার প্রত্যেকটি পরতে পরতে।
কাইয়ুম চৌধুরী, মনিরুজ্জামান, হাসেম খান, বুলবুল হক, মনিরুল ইসলামসহ বিখ্যাত চিত্রকরদের সৃষ্টিকর্ম সংগ্রহে রেখেছেন তানজীব-উল আলম। তিনি জানান, পৃথিবীর যেখানেই যান সেখানকার শিল্পকর্মের দোকানগুলো ঘুরে আসেন, সংগ্রহ করেন নানারকম পেইন্টিং।
একেকটি পেইন্টিং এর পেছনে রয়েছে একেকটি গল্প বা ইতিহাস। তেমনি একটি পেইন্টিং এর গল্প বেশ মনে ধরলো। বেইজিং থেকে সংগ্রহ করেছেন এটি। ছবিটি এমন- আটটি ঘোড়া দৌড়াচ্ছে। চীনে একে ‘Symbol of fortune’ বা সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করে। কারণ জীবন মানেই গতিশীল। আর গতিশীলতাকে কেন্দ্র করেই মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ হয়।
তানজীব-উল আলমের অন্যতম শখের কাজ হলো ফটোগ্রাফি। সঙ্গীতে ভীষণ আগ্রহ তার। সময় পেলেই তবলা নিয়ে বসেন। ছুটির দিনে বাসায় তবলার প্রশিক্ষণ নেন।
শো-পিস হিসেবে কচ্ছপ সংগ্রহ করতে পছন্দ করেন তিনি। দেশ-বিদেশ থেকে বিভিন্ন উপাদানের তৈরি কচ্ছপ নিয়ে আসেন। তার সংগ্রহে আছে- জেইড পাথরের কচ্ছপ, যা খুবই বিরল। এছাড়া অনিক্স স্টোন, রুপা, ব্রোঞ্জসহ নানা উপাদানে তৈরি কচ্ছপ বাসা ও অফিসে সাজিয়ে রেখেছেন তিনি।
বারান্দাগুলো অপার মুগ্ধতায় ভরা
এই শহরের কোন বাসায় এত বারান্দা থাকতে পারে আগে জানা ছিল না। বারান্দায় বিভিন্ন ধরনের গাছপালা আর ওপরে খোলা ছাদ। ডুপ্লেক্স এই বাসার ওপর ও নীচের বারান্দার মধ্যে সংযোগ রাখতে বারান্দার ছাদ খোলা রাখা হয়েছে। ফলে এক বারান্দা থেকে আরেকটি দেখা যায়।
বেশ পরিপাটিভাবে সাজানো হয়েছে বারান্দাগুলো। রাখা হয়েছে নানা ধরনের গাছ- ইউফোরবি, ফাইকাস, ক্র্যাব পাম, কাঠগোলাপ, বাগান বিলাস, ব্লিডিং হার্ট, রাবিশ পাম ও বার্ড অফ প্যারাডাইস। কিছু বড় গাছের নীচে ছোট গাছ লাগানো হয়েছে। এতে ছোট গাছগুলো দেখতে অনেকটা বিছানার মতো লাগে। এই বাসায় মাঝে মাঝে মৌমাছিরাও আসে। বট গাছের ছোট ছোট ফল খেতেই তাদের এই ভীড়- জানালেন গৃহকর্ত্রী লীমা হক।
বারান্দায় বসার ব্যবস্থাও আছে। প্রকৃতির সৌন্দর্য, চাঁদনী রাত কিংবা ভোর- সবকিছুই উপভোগ করার জন্য দারুণ আয়োজন!
এই বাসায় প্রথমবারের মতো দেখলাম সিমেন্ট দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি করা গাছের টব। গৃহকর্তা জানালেন, কিছু দেশে এই ধরনের টব দেখা যায়। তবে ঢাকায় এর প্রথম পরিচিতি ঘটে তার বাসায়। বাসার স্থপতির পরামর্শে তিনি এই টব বানাতে আগ্রহী হন।
এক টুকরো বাঁশবন
‘বাঁশ গাছগুলো আমাদের পর্দা হিসেবে কাজ করে। তাই কাপড়ের পর্দা বা গ্রিল না দিয়ে জানালার বাইরে লাগিয়েছি বাঁশ গাছ’- বললেন গৃহকর্ত্রী। খাবার টেবিলের কাছাকাছি জানালাটি বাঁশগাছের দখলে। আর পাশেই এঁটে দেওয়া হয়েছে প্রখ্যাত শিল্পী হাশেম খানের চিত্রকর্ম। বাসার এই জায়গাটি স্বস্তির পরশ বুলিয়ে দিতে বাধ্য।
বাসায় যখন ব্যায়ামাগার
‘নিয়মিত ব্যায়াম করা শরীরের জন্য ভালো’ এই কথাটি আমরা সবাই জানি। কিন্ত নিয়ম করে ব্যায়াম করেন ক’জন? এই দম্পতি শরীরচর্চাকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখেন। নিয়মিত শরীরচর্চাকেন্দ্রে যাওয়ার ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে বাসায় রেখেছেন শরীরচর্চার নানা সরঞ্জাম।
ব্যায়ামের অন্যতম ভালো মাধ্যম হলো সাঁতার। তাই ছাদে সুইমিং পুলের ব্যবস্থাও করেছেন এই দম্পতি।
সুইমিং পুল শিশুর পায়ের আকারে তৈরি করা হয়েছে, জানালেন গৃহকর্তা। সুইমিং পুলের চারপাশে নানাজাতের গাছপালা প্রকৃতির সাথে মেলবন্ধন ঘটায়।
সৃষ্টিশীল মানুষের সৌন্দর্যবোধের পরিচয় পাওয়া যায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই। তানজীব-উল আলম ও লীমা হক দম্পতির বাসায় পেলাম সেই বোধের দারুণ এক নির্যাস। প্রকৃতি তাদের দুহাত ভরেই দিয়েছে, নিশ্চয়ই তারাও প্রকৃতিকে কম দেননি!
ছবি- আশীষ সেনগুপ্ত