পূজার নৈবেদ্য ঘিরে শান্তির আবহ যে ঘরে
৬ অক্টোবর ২০১৯ ১০:০০
‘আমার বাড়ি তো দেশের কোনায় কোনায়’, বলছিলেন চিকিৎসক সঙ্গীতা হালদার তুলি। সামরিক কর্মকর্তার গিন্নী হিসেবে দেশের নানা প্রান্তের ক্যান্টনমেন্টে সরকারিভাবে বরাদ্দ ঘর আর আসবাব নিয়েই তার সংসার। এখন যে বাড়িতে আছেন সেটি তার মায়ের । গীতা হালদার আর মেজর হরবিলাস হালদারের বাড়ির সদর দরজার পাশে নামফলকে ‘হরবিলাস’ লেখা। কিন্তু এই বাড়িটা যে সঙ্গীতারও, তাই তার ঘরের দরজার পাশে টানানো ‘সঙ্গীতা’ নামফলক।
হাতে সেলাই করা নামফলকগুলো গীতা হালদারের নিজের হাতে বানানো শিল্প। এছাড়াও পুরো বাড়ির বিভিন্ন দেয়ালে টানানো ওয়াল হ্যাঙ্গিংগুলোও তার হাতেই বানানো। তুলি বলছিলেন, ‘একটি ওয়াল হ্যাঙ্গিংয়ে মা-মেয়ের গল্প আছে। সেটি মা আমায় ভেবে করেছিলেন মেডিকেল কলেজে পড়ার সময়ে যখন দূরে ছিলাম। শেষ করতে পারেন নি অসুস্থতার জন্য। পরে আমায় উপহার দিয়েছেন আমার প্রথম সন্তান হওয়ার সময়ে।’ তুলি সেটি এ বাড়িতেই রেখে দিয়েছেন যেন যতবার প্রয়োজনে বা কাজে মায়ের বাড়িতে আসেন ততবারই মনে হয় মেয়ে এসেছে মায়ের কাছে।
প্রধান দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকতেই হাতের ডানে একটা ডিভান। এর ঠিক পাশের ঘরটাই এই বাড়ির পূজোর ঘর। দরজা খুলতেই আগরবাতি, তাজা ফুল আর পবিত্রতার গন্ধ। ঘরের এক কোনে জানালার ধার ঘেঁসে বানানো একান্ত এক ছোট্ট মন্দির। নিজে ডিজাইন করে কাঠমিস্ত্রীর সঙ্গে মিলে এই ঠাকুর ঘরটি বানিয়েছিলেন গীতা হালদার। ঘরের এক পাশ জুড়ে জানালা। সারাদিন আলো-হাওয়ার অভাব নাই এই ঘরে। পাশেই দেয়ালের সঙ্গে লাগোয়া তাকে ধর্মীয় বই আর ছোটদের বই। পূজোর এই ঘরটিতেই জমে সঙ্গীতার সন্তানদের সঙ্গে দিদিমার খেলা। বাচ্চাদের দুপুরের ঘুমের জায়গাও বটে এটি। আবার এখানেই চলে হারমোনিয়াম-তবলা নিয়ে নাতি নাতনিদের সঙ্গে দাদু-দিদিমার গানের আসর।
ঘর সাজানো প্রসঙ্গে তুলি জানান ছোটবেলা থেকেই তার ঘর সাজানোর শখ। খাটের জায়গা পরিবর্তন করে, কি কার্ড দিয়ে, কি ডিমের খোসায় পুতুল বানিয়ে, কি মায়ের ছিড়ে যাওয়া পুতির মালাগুলো কোনা ভাংগা কাচের বাটিতে সাজিয়ে নিজের ঘরটাই সাজাতেন তিনি। এখন নিজের ঘরটাই সাজান মনের মতো করে। উৎসাহ, মা, সানন্দা আর মাঝেমধ্যে পিন্টারেস্ট!
ঘর সাজানোর ক্ষেত্রে প্রচুর আলো-বাতাস আর আলোছায়ার আবছা খেলাই এবাড়ির লোকের পছন্দ। সেই রঙের খেলার টানেই ঘরে টার্কিশ আলো লাগানো। খাবার ঘরের বাতিগুলো হারিকেন আকৃতির, টিউবলাইট না জ্বালালে কিছুটা হলদে আভা আসে। এতে পুরনো দিনের একটা আবহ আসে। সেই সঙ্গে আন্তরিক ঘরোয়া ভাব ফুটে ওঠে।
বসার ঘরের একপাশে নকশাকাটা রঙিন ওয়াল পেইন্টিং। লেবু হলুদ রঙের দেওয়াল ঘেঁষেই কৃত্রিম বাঁশের ঝাড়- ঘরে ঢুকতেই একটা সতেজ ভাব ঝাপটা মারে চোখে আ মনে রেখে যায় শান্তির ছাপ। অন্য দিকের দেওয়া ঝোলানো ফটো ফ্রেমে পারিবারিক ছবির কোলাজ।
নিজের স্বপ্নের বাড়ি কেমন হবে জানতে চাইলে তুলি বলেন, আমার ঘরে থাকতে হবে নানা রঙের আলোর খেলা আর প্রচুর গাছ। থাকবে নিজেদের স্মৃতি, দেশীয় শিল্প ও ঐতিহ্যের ছোঁয়া আর প্রচুর বই। নানা জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার স্মৃতি ধরে রাখার জন্যও থাকবে ছোট্ট একটা কোন।
আসি মায়ের বাড়িতে সঙ্গীতার নিজস্ব ঘরে। প্রথমেই চোখে পড়বে মেঝেতে পাতা বিছানা আর মাথার কাছে লাল ইটের ওয়াল পেপার। আর বিছানা ঘিরে প্রচুর বই। তুলি বলেন, বইয়ের সংগ্রহের বেশিরভাগই ইতিহাস, রহস্য আর রোমাঞ্চ ঘিরে। তাই দেয়ালে ভাংগা ইটের দ্যোতনা। বিছানার চাদর আর পর্দার রঙে রয়েছে সামঞ্জস্য। লাল দেওয়ালের বিপরীতে সাদা আর কালোর মিশেল।
এখানে রয়েছে চিকিৎসাসংক্রান্ত বই, গল্পের বই, ম্যাগাজিন। তুলি বলেন, শুধু বাড়ি নয় গাড়িতেও বই রাখেন তিনি। বই তাকে দেয় প্রশান্তি। মন খারাপের মুহুর্তে এক বাটি চানাচুর আর একটা বই নিয়ে ঘন্টা তিনেক সময় তাকে ভুলিয়ে দেবে সব। বই পাগল তুলির মান ভাঙাতে হিমাদ্রীও স্ত্রীকে বই কিনতেই নিয়ে যান।
এভাবেই বই তাদের জীবনে ভালোবাসায় ঘিরে রয়েছে। ঘরে ছোটখাটো অনেক বিষয়ে স্মৃতি আর মায়ার মেলবন্ধন করেছেন তিনি। ড্রেসিং টেবিলে ক্যাকটাসের সাথে বেড়া হিসেবে আছে তুলির শখের খোপার কাঁটা। ল্যাপটপ রাখার টেবিলের কাপড়টা তুলি আর তার জীবনসঙ্গী হিমাদ্রী শেখর রায়ের প্রেমের দিনগুলোতে পরা একটা রঙিন ওড়না।
বিছানার কাছেই টায়ার রঙ করে হিমাদ্রীর একটা টি-শার্ট জড়িয়ে ফোম বানিয়ে বসার টুল বানিয়েছেন তুলি। দেয়ালে পুরনো একটা ভাঙা চেয়ারের ব্যাক রেস্টে ঝোলানো বিভিন্ন দেশে ঘুরতে যেয়ে আনা ও বন্ধুদের থেকে উপহার পাওয়া সুভ্যেনির চাবির রিং। এভাবেই স্মৃতি আর ভালোবাসা ধরে রাখার অন্যন্য উপায়ে নিজের ঘরটা সাজিয়েছেন সঙ্গীতা তুলি।
চিকিৎসক তুলির কাছে ঘর শুধু পরিপাটি রাখাই সব নয়, দুই শিশু সন্তানের মা হিসেবে তিনি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে রাখেন সবার উপরে। তিনি মনে করেন, পরিপাটি ও সুন্দর করে রাখলে ঘরে ফেরার টান অনুভব করে মানুষ। তাই তাদের ঘরে আলো-বাতাস আর খোলামেলা পরিচ্ছন্ন আবহ।
ছবি: আব্দুল্লাহ আল মামুন এরিন