Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দ্য লাস্ট প্যারাডাইজ অন আর্থ ।। ৩য় পর্ব: সুপ্রভাত বালি


২৬ অক্টোবর ২০১৯ ১০:৩০

পরের দিন ভোর হলো বালির সূর্যের হাসিতে। রুমের পর্দা সরিয়ে সূর্যকে স্বাগত জানালাম অদ্ভুত এক ভালোলাগা নিয়ে। ফজরের নামায পড়ে তখনও হাত-পা গুটিয়ে ঘুমিয়ে থাকা ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে আমরাও ঘুমিয়ে নিলাম আরও খানিকটা। দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি যেন পিছু ছাড়ছিলো না।

সুপ্রভাত বালি

ট্যুরের প্রথমদিন হোটেলে সকালের খাবার শেষে প্রায় বেলা ১১ টার দিকে বের হলাম আমরা। তবে বালির পথেঘাটে ঘুরে বেড়ানোর আগে আপনাদেরকে বালি সম্পর্কে কিছু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি।

বালির আবহাওয়া মোটামুটি আমাদের দেশের মতোই। আগস্ট থেকে ওদের ড্রাই সিজন শুরু হয়! রাস্তার দুপাশে কারুকার্যমণ্ডিত মন্দির। মন্দিরগুলো নজর কাড়া। লাল ইট দিয়ে তৈরি মন্দিরগুলো সব প্রায় একই প্যাটার্নের হলেও দেখতে প্রতিটাকেই আলাদা মনে হয়। কোনটা অনেক পুরোনো কোনটা আবার নতুন। বালিতে প্রতিটি বাড়ি এবং দোকানের সামনে হাতির শুড়ের মতো বাঁকানো লম্বা বাঁশ চোখে পড়বে। বাঁশের মধ্যে রঙ-বেরঙের কাপড় প্যাঁচানো। অনেকটা আমাদের দেশের লাল সালুর মতো। সম্ভবত এই বাঁশ ওদের মঙ্গলের প্রতীক!

ইন্দোনেশিয়ার মোট ৩৪ টি প্রদেশের মধ্যে বালি একটি। এর রাজধানীর নাম দেন পাসার। ইন্দোনেশিয়া মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হলেও বালি হিন্দু অধ্যুষিত। এখানে মোট জনসংখ্যার ৮৩.৫% হিন্দু। বাকীদের মধ্যে কিছু মুসলিমসহ অন্য ধর্মের।

ইন্দোনেশিয়ায় আনুমানিক ১৭ হাজার সাতশ দ্বীপ রয়েছে। কোনটার নামকরণ করা হয়েছে, কোনটা একেবারেই অজানা। আবার কোনটায় জনবসতি রয়েছে, কোনটা একেবারেই নির্জন!
বেশ কয়েকটি সুপরিচিত দ্বীপের নাম হলো – সুমাত্রা, জাভা, বালি, লম্বুক, বোর্নিও,পাপুয়া, বান্দা, সুন্দা ইত্যাদি। এরমধ্যে আবার ‘সিরাজাম ও লিজিটান’ নামের দুটি দ্বীপের মালিকানা নিয়ে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে রয়েছে বিরোধ।

বিজ্ঞাপন

সুপ্রভাত বালি

বালির আশেপাশে ছোট ছোট অনেক দ্বীপ রয়েছে। চারপাশে অথৈ সাগরের নীল পানি, বড় বড় পাহাড়ের গায়ে আছড়ে পড়া ঢেউ, সমুদ্রে কোরালের প্রাচুর্য, জীবন্ত আগ্নেয়গিরি- সব মিলিয়ে বালির রয়েছে নিজস্ব সৌন্দর্য।

আমরা অনেকেই জানি, সমুদ্রের নিচে জীব বৈচিত্রের ভারসাম্য রক্ষায় প্রবাল প্রাচীরের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাপুয়া নিউগিনি, ফিলিপাইন ও তিমুরের ভৌগলিক সীমার অংশ নিয়ে ‘কোরাল ট্রায়াঙ্গেল’ গঠিত। আর ইন্দোনেশিয়া অংশে, বালি, ‘সমুদ্র কোরাল ট্রায়াঙ্গেলের’ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানে পাঁচশয়ের বেশি প্রবাল প্রাচীর বা কোরাল রিফ রয়েছে। তুলনা করতে গেলে এটি পুরো ক্যারিবিয়ানের প্রায় ৭ গুণ। অর্থাৎ সমুদ্রের বৃহত্তম জীববৈচিত্রের অংশটি বালি সাগরের বুকে বিছানো রয়েছে।

প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ পর্যটক আসেন বালির সৌন্দর্য উপভোগ করতে। বালি তাই পরিচিতি পেয়েছে অনন্য-‘দ্যা লাস্ট প্যারাডাইজ অন আর্থ’ নামে। ইন্দোনেশিয়ার পর্যটন শিল্প থেকে আয়কৃত অংশের ৮০% আসে এই বালি থেকে।

দ্য লাস্ট প্যারাডাইজ অন আর্থ ।। ২য় পর্ব: বালি যাত্রা

সকাল সাড়ে দশটা থেকেই গাড়ি নিয়ে ড্রাইভারসমেত ট্যুর গাইড হোটেল লবিতে অপেক্ষা করছিলো আমাদের জন্য। ট্যুর গাইড তাদের ট্রাডিশনাল পোশাক পরে এসেছেন। উপরে রঙচঙে প্রিন্টের ফতুয়া, নিচে প্যান্টের উপর লুঙ্গি সদৃশ কাপড় প্যাঁচানো, মাথায় টুপি। অনেকটা নেপালি টুপির মতো দেখতে।

গাড়িতে উঠে চললাম আমরা ইস্ট বালির দিকে। আমাদের আজকের ডেস্টিনেশন – কফি প্ল্যান্টেশন, মাউন্ট বাতুর আগ্নেয়গিরি, তানাহ লট টেম্পল ও ওবুদ রাইস ট্যারেস!

বিজ্ঞাপন

কফি প্ল্যান্টেশন
কিন্তামানি মাউন্ট বাতুরে যাওয়ার পথে গাইড আমাদের নিয়ে গেল একটা অর্গ্যানিক ফার্মে। কফি প্ল্যান্টেশন দেখানোর জন্য। জায়গাটার নাম ‘গায়ানির-মানুকায়া’ এবং ফার্মটার নাম ‘ক্যান্টিক এগ্রিকালচার’!

ছোট ছোট পাথর বিছানো রাস্তা ধরে আমরা ফার্মের ভেতরে ঢুকলাম। রাস্তার দু’পাশে বিভিন্ন জাতের গাছ।

ভেবেছিলাম যেখানে কফি চাষ হয় সেখানে বুঝি কফি গাছই থাকবে। ধারণা পাল্টে গেল যখন কফি গাছ চোখে পড়ার আগে  আমের মতো লম্বাটে এক ধরনের কাঁচা-পাকা ফল চোখে পড়ল। গাইড জানালো ফলটির নাম, কোকো। কোকো থেকে চকলেট তৈরি করা হয়! যে কোকো পাউডার দিয়ে কেক বানাই, সেটাও সেই ফল থেকেই বানানো হয়। জীবনে প্রথম দেখলাম এই কোকো ফল।

পাকা কোকোয়া ফল
সামনে এগোলে কিছু দূর পর পর কফি গাছ চোখে পড়ে। উচ্চতায় ৬ থেকে ৭ ফিটের বেশি হবে না চিকন কাণ্ডে থোকায় থোকায় কাঁচা পাকা কফি ফল ধরে আছে।

হেঁটে চলা পথের মাঝে মাঝে খাঁচা দেখে থমকে দাঁড়ালাম। খাটাশ সদৃশ একটি প্রাণী চোখে পড়ল। গাইড জানালেন, এরাই সেই বিখ্যাত লুয়াক যারা অত্যন্ত দামি কফি তৈরিতে ভূমিকা রাখে। লুয়াকের ইংরেজী নাম সিভেট ক্যাট। বাংলা নাম, গন্ধগোকুল। বৈজ্ঞানিক নাম, Paradoxurus hermaphroditus.

লুয়াক সাহেব ঘুমে মগ্ন। তিনি দিনে ঘুমান। রাতে হাঁটেন। পাকা, রসালো ও সেরা জাতের ফলগুলো খেতে দেয়া হয় তাদের। লুয়াক এই ফল হজম করতে পারে না। প্রায় ৮ থেকে ১২ ঘন্টা পরে এটিকে মল আকারে বাইরে বের করে দেয়। লুয়াকের এই মল ধুয়ে, পরিষ্কার করে, শুকিয়ে, খোসা ছাড়িয়ে ও অন্যান্য আরো প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে তৈরি হয় পৃথিবীবিখ্যাত ‘কপি লুয়াক’ (স্থানীয় নাম) বা লুয়াক কফি।বিশ্বের দামী কফিগুলোর মধ্যে এটি একটি। এক কাপ লুয়াক কফির দাম সেখানে বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৩০০।

পাহাড়ের উপর তৈরি করা হয়েছে কফি প্রজেক্টটি। পাশেই প্রদর্শনী ও বিক্রয়কেন্দ্র। পাহাড়ের ঢালে আজব এক ধরনের হলুদ ফল দেখে আমি দ্রুত সিঁড়ির ধাপ পেরোলাম। আমার আগ্রহ দেখে গাইড পেছন থেকে জানাল- এই ফলটির নাম  ‘মিকি মাউস’। মিকি মাউসের মতো দেখতে বলেই এই নামকরণ। বাচ্চারা খুব আগ্রহ নিয়ে মিকিমাউসের সাথে ফটোসেশন করলো।

সুপ্রভাত বালি

মিকি মাউস ফল

এদিকে, প্রজেক্টের ভেতরে দুজন বয়স্ক মহিলা কফি বীন প্রসেসড করছিলেন। একজন সাদা বীজ চুলোয় ভাঁজছেন আর অন্যজন হামান দিস্তায় পিষে সেটিকে গুঁড়ো করে ছাঁকছেন। কফির সুঘ্রাণ মস্তিস্কে কেমন যেন আলোড়ন তৈরি করছিল। মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল কফির নেশা। কিছুক্ষনের মধ্যেই বিনামূল্যে টেস্ট করার জন্য প্রায় ১৩-১৪ ধরনের চা আর কফি হাজির করা হল আমাদের সামনে।

লুয়াক কফি, বালি কফি, জিনসেং কফি, কোকোনাট কফি, জিনজার কফি, কোকোয়া, বালি কফি এন্ড কোকোয়া, ম্যাংগোস্টিন টি, রোজেল্লা টি, টারমারিক টি, লেমন গ্রাস টি ইত্যাদি। এদের মধ্যে ম্যাংগোস্টিন, রোজেল্লা, লেমনগ্রাস এবং টারমারিক চা খুবই ভালো লেগেছে আমার। রোজেল্লাকে আমাদের দেশে চুঁইঝাল বলে। লুয়াক কফি পান করবোনা করবোনা  করেও কৌতূহলবশত করেই ফেললাম। এটি তৈরির প্রক্রিয়া শুনে যতটা ওয়াক ওয়াক করেছি পান করার পর ততটা মন্দ লাগেনি। তবে দাম অনুযায়ী আহামরী কিছু মনে হয়নি।

সুপ্রভাত বালি

বিভিন্ন নামের চা ও কফি

আসার পথে আমরা লুয়াক কফি, জিনজার কফি, ম্যাংগোস্টিন টি, রোজেল্লা টি, টারমারিক টি, লেমন গ্রাস টি কিনে নিয়ে আসলাম। আমাদের বন্ধু পরিবার সম্ভবত সব ধরনের চা আর কফি নিয়ে এসেছে। কারণ তাদের বিল এবং ব্যাগ দুটোই বেশ ওজনদার মনে হলো।

চলবে…

দ্য লাস্ট প্যারাডাইজ অন আর্থ ।। ১ম পর্ব: ভ্রমণ প্রস্তুতি

কপি লুয়াক বালি দ্বীপ লুয়াক কফি

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর