কঠিন খাদ্যাভ্যাস নয়, স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনেই ওজন নিয়ন্ত্রণ
৩ নভেম্বর ২০১৯ ১০:০০
২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো ওজন কমানো শুরু করি। সে বছর ছয় মাসে ২৭ কেজি ওজন কমিয়ে পরিচিতিদের মধ্যে মোটামুটি হইচই ফেলে দিয়েছিলাম। তখন আমি পুষ্টিবিদ আয়েশা সিদ্দিকা আপুর পরামর্শ অনুযায়ী ব্যায়াম এবং খাদ্য তালিকা অনুসরণ করেছিলাম।
এরপর আমেরিকায় এসে পড়াশোনা, রিসার্চের চাপ এবং ব্যক্তিগত জীবনের কিছু দুর্ঘটনার কারণে আমি প্রচন্ড বিষণ্ণতা এবং মানসিক চাপে ভুগতে শুরু করি। মানসিক চাপের ফলে ইমোশনাল ইটিংয়ের (খেয়ে মন ভালো করা) সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষ করে মিষ্টি খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিলো বেশি। একটা পর্যায়ে আমি খাবারের মধ্যে আরাম খুঁজতে শুরু করি। অর্থাৎ, যখনই আমি কোনো কারণে মানসিক চাপে ভুগতাম, পাগলের মতো জাংক ফুড, মিষ্টি জাতীয় খাবার খেতাম। নিজের ব্রেইনকে আমি এমনভাবে কন্ডিশনড (conditioned) করে ফেলেছিলাম যে, আমার মনে হতো খাবার খেলেই সব মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাবো।
এদিকে সময়ের অভাবে এক্সারসাইজ করা হচ্ছিল না। মাঝেমধ্যে হঠাৎ করে ডায়েট শুরু করি, আবার ছেড়ে দিই। ফলে দেখা গেল, পাঁচ কেজি ওজন কমে তো আবার দশ কেজি ওজন বেড়ে যায়। ফলাফল, ওজন কমানোর ইচ্ছা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলি। আমি ভাবতাম, ‘আমি যাই করি না কেন, ওজন কমবে না’ এবং ফলাফল হিসেবে ওজন আবার ৯০ কেজিতে চলে যায়।
২০১৮ সালের আগস্ট মাসে মাস্টার্সের ডিফেন্সের পরপর প্রথমবারের মতো দৃঢ়ভাবে ওজন কমানোর চিন্তা মাথায় আসে। আবারও আয়েশা আপুর কাছ থেকে চার্ট নেই, জিমে ভর্তি হই। আমেরিকায়ও একজন ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ নেই।
ঠিক সেসময় আরেকটা অপ্রত্যাশিত আঘাতের সম্মুখীন হই। বিশেষ কারণে পিএইচডি এডমিশন আর ফান্ডিং ক্যানসেল করে আমাকে দেশে চলে আসতে হয়। দেশে এসে আবার ডিপ্রেসড হয়ে পড়ি এবং আবারও শুরু হয় স্ট্রেস ইটিং (মন খারাপ ভালো করতে খাওয়ার মধ্যে স্বান্তনা খোঁজা)।
ডিসেম্বর থেকে আবার ডায়েট শুরু করলেও মার্চ পর্যন্ত ওজন কমে মাত্র দুই কেজি। বুঝতেই পারছেন, ডায়েট এবং এক্সারসাইজ এবারও ঠিকমতো করা হয়নি। এপ্রিল থেকেই মূলত আমি আমার জীবন নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা শুরু করি। প্রথমেই একটা কাগজ আর কলম নিয়ে বসি এবং তালিকা বানিয়ে ফেলি যে আমি ঠিক কী কী কারণে ডিমোটিভেটেড ( আশা হারানো) হচ্ছি এবং কেন আমার ওজন কমছে না। আমি মূল সমস্যা যেটা ধরতে পারি সেটা হচ্ছে, আমার খাদ্য তালিকায় যে ধরনের খাবার আছে সেটা বানিয়ে খাওয়াটা আমার জন্য কষ্টকর বলেই আমার পক্ষে খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ আমি অনেক ব্যস্ত জীবন কাটাই।
আমি আট ঘন্টা চাকরি করি, জিআরই’র পড়াশোনা করি, বাসায় কাজের লোক না থাকায় বাসার অর্ধেক কাজ করি (বাকি অর্ধেক আমার স্পাউজ করে)। আমার একটা মেয়ে আছে যে স্কুলে পড়ে তাই তার কাজকর্ম, পড়ালেখাটাও আমিই দেখি। কাজেই প্রতি বেলা চৌদ্দরকম খাবার বানিয়ে খাওয়া আমার জীবনযাপনের সঙ্গে যাচ্ছিলো না। খাবার বানাতেই যদি এত সময় দেই, তাহলে কাজকর্ম, ব্যায়াম, পড়াশোনা ইত্যাদির জন্য এনার্জি থাকবে না।
আমার দ্বিতীয় সমস্যা হলো, ভীষণ কঠিন কোন খাদ্যতালিকা মেনে চললেই আমার উল্টাপাল্টা খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। কারণ, আমার কাছে মনে হয়, আমার লাইফ এমনিতেই কঠিন, আমি এটাকে আরো কঠিন করছি কেন? আর এ চিন্তা মাথায় আসলেই আমি মোটিভেশন হারিয়ে ফেলি। কাজেই আমি এবার আমার আমেরিকান ডায়েটিশিয়ানের কাছ থেকে শুনে আসা পদ্ধতি অনুযায়ী নিজের শরীর আর জীবনযাপন পদ্ধতি অনুযায়ী সহজ একটা খাদ্যতালিকা বানাবো বলে ঠিক করলাম। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন পদ্ধতি মেনে চলার জন্য নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করলাম।
প্রথমেই আমার বিএমআর (বয়স, উচ্চতা, শারীরিক গড়ন অনুযায়ী প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় খাদ্যশক্তি) বের করে আমার দৈনন্দিন কতোটুকু ক্যালরি প্রয়োজন সেটা ঠিক করলাম। পরে হেলদি এবং আনহেলদি খাবারের একটা তালিকা বানালাম। প্রতিজ্ঞা করলাম, অস্বাস্থ্যকর খাবার খাবো না। প্রথমেই দীর্ঘ সময়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ না করে ছোটো ছোটো লক্ষ্য নির্ধারণ করলাম।
অর্থাৎ, প্রথম সপ্তাহে আমি কার্বের (শর্করা জাতীয় খাবার) তালিকা থেকে ভাতের পরিমাণ অর্ধেক করলাম, পরের সপ্তায় কমালাম চিনি খাওয়া। এর পরের সপ্তাহ থেকে রেডমিট (গরু, খাসি, ভেড়া, শুকর ইত্যাদির মাংস) ছাড়লাম। পরের সপ্তাহ থেকে বাড়ালাম ফল, সবজি ইত্যাদি খাওয়ার পরিমাণ। এরপর দুধ চা খাওয়া কমিয়ে দিলাম। পরের সপ্তাহে একেবারে ছেড়েই দিলাম।
এভাবে একটু একটু করে স্বাস্থ্যকর খাবারের পরিমাণ বাড়ালাম, আর অস্বাস্থ্যকর খাবারের পরিমাণ কমাতে কমাতে একেবারেই বন্ধ করে দিলাম। আমি এখন নিয়মিত, ওটস্, রুটি, ফলমূল, সবজি, সালাদ, বাদাম, পনির, মাছ, মাংস আর ডিম খাই। সবই পরিমিত পরিমানে এবং ১২০০ ক্যালরি হিসাব করা (কোন খাবারে কতটুকু ক্যালরি তা ইন্টারনেটেই পাবেন)। আমি গত ছয় মাসে রেড মিট খেয়েছি শুধু দুই দিন। সপ্তাহে একদিন ভাত খাই। ভাজাভুজি, জাংক ফুড হঠাৎ হঠাৎ (মাসে এক বা দু’দিন) খাই এবং চিনি একেবারেই খাই না। ছয় মাসে চিনি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার খেয়েছি মাত্র চার বা পাঁচ দিন। এজন্য আমি কোনো ক্রেভিংও (কোনকিছু খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা) অনুভব করি না।
পাশাপাশি আমি নিয়মিত ব্যায়াম করি। দিনে অন্তত ৪০ মিনিট সাইকেল চালাই এবং ৩০ মিনিট পাওয়ার ওয়াক করি। নিতান্ত অসুস্থ না হলে এই রুটিন এর কোনো ব্যতিক্রম হয় না। সন্ধ্যা ৭টার পর আমি কোনো খাবার খাই না এবং রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করি।
আরেকটা কাজ আমি করি তা হল, দুইদিন পর পর ওজন নিই না। এমনকি আমার ওজন কতো কমলো এটা নিয়ে আমি মাথায়ই আনি না। কারণ, আমি জানি ওজন কতোটুকু কমলো সেটা আমি আমার জামাকাপড়ের সাইজ এবং মানুষের মুখের কথা শুনেই বুঝতে পারবো। দুই-তিন সপ্তাহ পর পর আমি ওজন নিই বিশেষ করে কখনো যদি মনে হয় যে আমি আমার হেলদি লাইফস্টাইল পুরোপুরি ফলো করতে পারছি না। কারণ সেক্ষেত্রে আমার ওজন নিয়ে দেখা লাগে যে আমার এক্সারসাইজ কতোটুকু বাড়াতে হবে বা ক্যালরি ইনটেক কতোটুকু কমাতে হবে।
মাঝে একবার ওজন স্টাক হয়ে গেছিল। তখন ওম্যাড (দিনে ২৩ ঘন্টায় একবার নিজের ইচ্ছামত খাবার খাওয়া) করে বেশ ভালো ফল পেয়েছি। তবে আমি কখনোই কোনো অস্বাস্থ্যকর খাদ্যতালিকা চেষ্টা করিনি। কিটো বা জিএম ডায়েট এগুলোও না।
শুরু দিকে ওজন কমানোর ক্ষেত্রে আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল প্রতিযোগিতার মনোভাব। আমাকে কতোটুকু সুন্দর লাগবে, অমুকের চেয়ে আমার এত কেজি ওজন বেশি কমাতে হবে, অমুক জামাটাতে আমার ঢুকতেই হবে এই মোটিভেশনের জন্য ওজন কমানোটা আমার প্রথমবারের ভুল ছিল। এবার আমি সেই ভুল সংশোধন করেছি। যে খাদ্যতালিকা অনুসরণ করতে পারবো না, সেরকম খাদ্যতালিকা না বানিয়ে আমি বরং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের দিকে মনোযোগ দিয়েছি। ওজন কতোটুকু কমলো বা কমলো না সেটা নিয়ে মানসিক চাপ না নিয়ে আমি বরং কতোটুকু সুস্থ আর কর্মক্ষম আছি সেটা নিয়ে ভেবেছি।
আমি জানি, যদি স্ট্রিক্ট চার্ট ফলো করতাম তবে ছয় মাসে হয়তো ৩০ কেজি কমাতে পারতাম। কিন্তু, আমি নিজের জীবনটা কঠিন করতে চাইনি। বরং দরকারমতো নিজের পছন্দের খাবার খেয়ে মাঝেমধ্যে নিজের খাদ্যতালিকা থেকে নিজেকেই ছুটি দিয়েছি। এখন স্বাস্থ্যকর খাবারই আমার বেশি ভালো লাগে। এখন আর আমি খাবারের মধ্যে আনন্দ খুঁজি না, বরং বিষণ্ণতায় বা মানসিক চাপে ভুগলে অন্যভাবে সেটা কমানোর উপায় খুঁজি। এটাই আমার ৬ মাসে ২২ কেজি ওজন কমানোর ইতিহাস। যদি কেউ বিন্দুমাত্রও উপকৃত হয়ে থাকেন, তবে নিজেকে ধন্য মনে করবো।
লেখক- ডেপুটি ডিরেক্টর, বাংলাদেশ ব্যাংক
স্বাস্থ্যকর খাদ্যতালিকা স্বাস্থ্যকর খাবার স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন