বন্ধ্যাত্ব: চিকিৎসা বিষয়ক পরামর্শ
২৯ নভেম্বর ২০১৯ ১৪:৪৫
গত দুই পর্বে আলোচনা করেছি বন্ধ্যাত্ব কী এবং এর কারণ কী কী তা নিয়ে। আজ বলব এর চিকিৎসা সম্পর্কে।
বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসার জন্য প্রথমেই স্বামী-স্ত্রী দু’জনকে একসঙ্গে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। কারণ, প্রথম সাক্ষাতে দু’জনের কাছে থেকেই আমরা তাদের কিছু পূর্ব ইতিহাস নেই এবং শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকি (যদিও আমাদের দেশে পুরুষদের শারীরিক পরীক্ষা করা হয় না)। যেমন— নারী রোগী ও তার স্বামীর বয়স, স্ত্রীর ক্ষেত্রে মাসিক নিয়মিত হয় কি না এবং হলেও খুব ব্যথা হয় কি না, সহবাসের সময় ব্যথা হয় কি না, আগে কোনো বাচ্চা নষ্ট হওয়া অথবা বাচ্চা নষ্ট করার ইতিহাস আছে কি না, আগে পেটের কোনো অপারেশন হয়েছিল কি না (দু’জনেরই), ডায়াবেটিস/হাই প্রেশার অথবা জানা কোনো রোগ আছে কি না, নিয়মিত কোনো ওষুধ খাচ্ছেন কি না ইত্যাদি।
এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্নটা আমরা করে থাকি তা হলো— তারা সপ্তাহে কতবার এবং ঋতুচক্রের কোন সময়টাতে সহবাস করে থাকেন। অনেকেই জানেন না, ফার্টাইল পিরিয়ড বা উর্বরতাকাল কোনটি? মাসে কয়েকবারই সহবাসের পরও ফার্টাইল পিরিয়ডটাতেই হয়তো সেটা হচ্ছে না। কিংবা তাদের satisfactory coitus হচ্ছে না। যেদিন মাসিক হবে, সেদিনকে প্রথম দিন ধরে মাসিকের দশম থেকে ২০তম দিনকে আমরা ফার্টিলিটি পিরিয়ড বলি এবং সপ্তাহে অন্তত ২ থেকে ৩ বার শারীরিক মিলন ঘটতে হবে। এই দু’টো জিনিস বুঝে চললে অনেকেই স্বাভাবিকভাবে গর্ভধারণ করে থাকেন।
যাদের এসব মেনে চলার পরও গর্ভধারণ হচ্ছে না, তাদের বেলায় কী চিকিৎসা দেওয়া হয়, সেটা নিয়ে একটু বলি। প্রথমেই আমরা স্ত্রীর কিছু হরমোনাল টেস্ট, রুটিন ব্লাড টেস্ট এবং তলপেটের একটা আল্ট্রাসনোগ্রাম (TVS) করে থাকি। পুরুষদের ক্ষেত্রে Semen analysis বা বীর্য পরীক্ষা, ব্লাড সুগার ও পুরুষদের যে হরমোন আছে, সেটাও অনেক ক্ষেত্রে পরীক্ষা করে থাকি। যদি সব রিপোর্ট ইতিবাচক থাকলে আমরা বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা শুরু করি। আরও কোনো সমস্যা থাকলে আগে সেটার চিকিৎসা করে তারপর বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা শুরু করি। যেমন— কারও যদি অনিয়মিত মাসিক থাকে, তবে মাসিক আগে নিয়মিত করে নিয়ে তারপর Ovulation inducing drug শুরু করি। হয়তো স্বামীর বীর্যের পরিমাণ কম অথবা গতিশীলতা কম। যদি ব্লক থাকার কারণে বা অন্য কোনো কারণ এটা হয়ে থাকে, তবে সেটার ট্রিটমেন্ট আগে করে নেওয়া হয়।
অনেক নারীই আছেন যারা দিনের পর দিন গর্ভধারণের জন্য ওষুধ খাচ্ছেন, অথচ কোনো মাসেই পরীক্ষা (TVS) করে দেখছেন না তার ডিম্বাণু ঠিকমত তৈরি হচ্ছে কি না। অথচ এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি ডিম্বাণু ঠিকমতো তৈরি না হয়, তবে Gonadotropin নামক একটি ইনজেকশন দেওয়া হয়। যদি তাতেও ডিম্বাণু ভালো না আসে, তবে মাসিকের দ্বিতীয় দিনে AMH নামের হরমোন পরীক্ষা করতে দেওয়া হয়, যা ডিম্বাণু তৈরিতে সাহায্য করে।
সাধারণত, Ovulation inducing drug পাঁচ থেকে ছয় বার দেওয়া হয়। এর মধ্যে গর্ভধারণ না হলে Hystosalpingogram করে দেখে নিতে হয় টিউবে কোনো ব্লক আছে কি না। অনেক ক্ষেত্রে Diagnostic laparoscopy করে টিউব, ওভারি ও জরায়ুর অবস্থা দেখা হয় যে সেসবে কোনো সমস্যা আছে কি না। যদি সব ঠিক থাকে, তবে বন্ধ্যাত্বের জন্য পরবর্তী যে চিকিৎসা, IUI (Intra uterine insemination) করা হয়। এ পদ্ধতিতে স্বামীর শুক্রাণু নিয়ে স্ত্রীর জরায়ুতে সরাসরি দিয়ে দেওয়া হয়। IUI-ও বেশ কয়েকবার (পাঁচ থেকে ছয় বার) করা যায়।
যদি IUI করেও গর্ভধারণ না হয়, তখন IVF (in-vitro fertilization) করা হয়। সোজা বাংলায় যাকে আমরা টেস্টটিউব বেবি বলি। এর সফলতার হার এখন পর্যন্ত অনেক ভালো। আমাদের দেশে একটি ধারণা আছে, IVF হচ্ছে শেষ বয়সের চিকিৎসা। অত্যন্ত ভুল একটা ধারণা। আমরা আগেই জেনেছি, ৩৫ বছরের পরে মেয়েদের প্রজনন ক্ষমতা কমতে থাকে। কারণ, এই বয়সের পর নারীদের ডিম তৈরি কমে যায়। তাই ৩৫ এর পর আইভিএফ করলে সফলতার হার কমে যায়। তবে চল্লিশ বছরের কাছাকাছি এসেও অনেকে আইভিএফ চিকিৎসা নিতে আসেন।
এছাড়াও বন্ধ্যাতের চিকিৎসায় ICSI (intra cytoplasmic sperm injection) পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। এ পদ্ধতিতে একটি healthy শুক্রাণু নিয়ে একটা mature ডিম্বাণুতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। যাদের শুক্রাণুর পরিমাণ কম, শুক্রাণুর কোয়ালিটি ভালো না, কিংবা আগে IVF করে বাচ্চা ধারণে সক্ষম হরনি, তাদের ক্ষেত্রে ICSI প্রয়োগ করা হয়।
বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা পুরাটাই আসলে নির্ভর করে বন্ধ্যাত্বের কারণ, কতদিন চেষ্টা করেও বাচ্চা হয়নি তার ওপর। পেশেন্ট ও তার স্বামীর বয়সের ওপরও এটি অনেকটা নির্ভর করে। সবশেষে এটাই বলতে চাই, বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি, ব্যয় বহুল ও কষ্টকর। এ চিকিৎসক, সে চিকিৎসকের কাছে ঘুরে সময় নষ্ট না করে একজন নির্দিষ্ট চিকিৎসকের ওপর ভরসা রাখুন। আবার দেশের বাইরে গিয়ে নিজের দেশের চিকিৎসকের ওপর ভরসা রাখুন। এ বিষয়ে আমাদের দেশে অনেক ভালো ভালো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন।