বায়ু দূষণে বাড়ছে ক্যানসারের ঝুঁকি
১২ ডিসেম্বর ২০১৯ ১০:০০
সম্প্রতি পুরো বাংলাদেশ, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার মাত্রাতিরিক্ত বায়ু দূষণ নিয়ে বিভিন্ন মহলে বেশ আলোচনা চলছে। দেখা যাচ্ছে, পুরো বছরজুড়ে কম-বেশি বায়ু দূষণ ঘটলেও, শীতে এবং শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে বায়ুদূষণের মাত্রা আশংকাজনক হারে বেড়ে যায়। বায়ু দূষণ তখনই ঘটে যখন, বাতাসের সঙ্গে নানারকম ক্ষতিকর উপাদান মিশে থাকে।
দূষিত বায়ুতে নানা মাত্রার ক্ষুদ্র আকারের পার্টিকেল থাকে। এদের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক বলে মনে করা হচ্ছে অতি ক্ষুদ্র পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫ এবং পার্টিকুলেট ম্যাটার ১০ কে। বাতাসে ধূলিকণার পাশাপাশি যোগ হচ্ছে জ্বালানীতেলের বর্জ্য, সীসা, তামাকের ধোঁয়াসহ অন্যান্য দূষিত উপকরণ। সাধারণত, যানবাহনের ইঞ্জিন ও জেনারেটরের জ্বালানী পোড়া ধোঁয়া, কলকারখানা ও কৃষিজাত ধোঁয়া, রান্নায় ব্যবহৃত জ্বালানী পোড়া ধোঁয়া, রাসায়নিক কারখানার ধোঁয়া ও যেকোন অগ্নিকান্ডের ধোঁয়া থেকে পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫ বাতাসে আসে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব দেশ দ্রুত শিল্পায়নের মাধ্যমে উন্নয়নের দিকে যায়, তাদের বায়ুদূষণের ঝুঁকি বহুগুনে বেড়ে যায়। সেই হিসেবে বিংশ শতাব্দীর ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো (নর্থ আমেরিকা ও ইউরোপের অনেক দেশ এবং জাপান) তাদের বিভিন্ন ইঞ্জিনের ধরণ ও জ্বালানীর ধরণ পরিবর্তনের মাধ্যমে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানী (যেমন, সৌরশক্তি) ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে বায়ুদূষণ অনেকখানি কমিয়ে এনেছে। কিন্তু বর্তমানে দ্রুত শিল্পায়নের কারণে মারাত্মক বায়ুদূষণের ঝুঁকিতে আছে ভারত ও চীন। এদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ছাড়াও ঝুঁকিতে আছে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। একিউআই (ওয়ার্ল্ড এয়ার কোয়ালিটি ইন্ডেক্স) অনুযায়ী এই দেশগুলোর বিভিন্ন শহরের বায়ু দূষণের মাত্রা প্রায় প্রতিদিনই ঝুকিপূর্ণ অবস্থানে থাকছে। এর ফলে বাড়ছে নানারকম রোগব্যাধির প্রকোপ।
বায়ু দূষণের ফলে শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগ ও হৃদরোগের ঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়ে যায় তা বেশ আগে থেকেই প্রমাণিত। সেই সঙ্গে বায়ু দূষণের কারণে বাড়ে ক্যানসারের ঝুঁকি। ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক ক্যান্সার রিসার্চ এজেন্সি (আইএআরসি) দূষিত বায়ুকে ক্যানসারের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, বায়ুদূষণের ফলে ফুসফুস ও মূত্রথলির ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এছাড়াও সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কোন জায়গার বাতাসে পিএম ২.৫ এর মাত্রা বেশি থাকলে ফুসফুস ক্যান্সার ছাড়াও লিভার ক্যান্সার, বৃহদন্ত্র ও মলাশয়ের ক্যান্সার, মূত্রথলির ক্যান্সার এবং কিডনীর ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। এছাড়া পিএম ১০ এর কারণেও ফুসফুস, অগ্ন্যাশয় ও শ্বাসযন্ত্রের ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর হার বাড়ে।
বাতাসে এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ক্ষতিকর পদার্থের পরিমান যত বাড়ে, ক্যানসার, ফুসফুসের বিভিন্ন রোগ এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকিও তত বাড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত নিরাপদ পিএম ২.৫ এর মাত্রা হচ্ছে ১০ মাইক্রোগ্রাম/কিউবিক মিলিমিটার। এই মাত্রা বিভিন্ন দেশ তাদের পরিস্থিতি ভেদে ১২ থেকে ২০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত নির্ধারণ করে নিয়েছে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশের বাতাসের পিএম ২.৫ এর মাত্রা সারাবছরে গড়ে ৯০ মাইক্রোগ্রাম থাকে, এবং একিউআই (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) ১৬৮ থাকে, যা খুবই অস্বাস্থ্যকর একটি পরিস্থিতি! শুধু তাই নয়, বছরের বিভিন্ন সময়ে তা মারাত্মক ক্ষতিকর মাত্রায় (৩০০+) পৌঁছে যায়!
সুতরাং একথা সুস্পষ্ট যে, আমরা বাংলাদেশীরা যারা রাজধানী ঢাকা ও বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের বায়ুতে নিঃশ্বাস নিচ্ছি, তারা সবাই কিছু না কিছু বায়ু দূষণজনিত ঝুঁকিতে আছি। কিন্তু অতিরিক্ত দূষিত বায়ুর মধ্যে যে যত বেশি সময় থাকছে, তার ঝুঁকির পরিমান তত বেড়ে যাচ্ছে। এ কারণে, যারা অতিরিক্ত বায়ু দূষণপূর্ণ এলাকায় বসবাস করছেন, তারা বায়ুদূষণের ফলে ফুসফুস ও হৃদরোগের পাশাপাশি ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষাকৃত বেশি ঝুঁকিতে আছেন। আরও ঝুঁকিতে আছেন তারা, যাদের পেশাগত কারণে দিনের একটা লম্বা সময় এই দূষিত বায়ুতে শ্বাস নিতে হয়, যেমন- ট্রাফিক পুলিশ, গণপরিবহনসহ বিভিন্ন যানবাহনের চালক, রাস্তার হকার/ফেরীওয়ালাসহ অনেকে।
বায়ুদূষণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে কাপড়ের তৈরি মাস্ক বা সার্জিক্যাল মাস্ক কিছুটা উপকার করলেও তা পিএম ২.৫ এর বিরুদ্ধে খুব বেশি কার্যকর নয়। এধরণের মাস্ক গড়ে ১৫ থেকে ৫৭ শতাংশ পর্যন্ত সুরক্ষা দেয়। এদিকে যিনি কাপড়ের মাস্ক পরছেন তিনি নিজেকে নিরাপদ মনে করে অধিক বায়ূ দূষণপূর্ণ এলাকায় নির্দ্বিধায় চলাচল করে নিজেকে আরো ঝুঁকিতে ফেলে দিতে পারেন।
অপরদিকে ফিল্টারযুক্ত কার্যকর মাস্ক এন ৯৫ (পিএম ২.৫ এর বিরুদ্ধে ৯৫% সুরক্ষা দেয়) বা এন ৯৯ (পিএম ২.৫ এর বিরুদ্ধে ৯৯% সুরক্ষা দেয়) সঠিক পদ্ধতিতে ব্যবহার না করলে সেটা কোন সুরক্ষাই দিতে পারেনা।
এদিকে যতক্ষণ বেঁচে আছি, ততক্ষণই শ্বাস নিচ্ছি আমরা। তাই অল্প সময়ের জন্য মাস্ক পরে খুব বেশি সুরক্ষা আসলে পাওয়া যাবেনা, যদি না সার্বিকভাবে বায়ুমন্ডলের পিএম ২.৫ সহ অন্যান্য দূষণের মাত্রা কমানো না যায়। তাই ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সবস্তরে সচেতনতা ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। আসুন নিজের আবাসভূমিকে নিরাপদ করতে সকলেই সচেতন ও সোচ্চার হই।