ফুড ক্রেভিংস: অকারণ ক্ষুধাকে বাগে আনবেন যেভাবে
১৯ ডিসেম্বর ২০১৯ ১০:০০
রাত দুপুরে হুট করে বার্গারে খাওয়ার ইচ্ছা হলো কিংবা অফিসের লাঞ্চে আজ বিরিয়ানি না খেলেই নয়— এমন ইচ্ছা আমাদের প্রায়ই জাগে। এটি কিন্তু স্বাভাবিক ক্ষুধা নয়। কীভাবে বুঝবেন? এমন ক্ষুধা পেলে ফ্রিজভর্তি সুস্বাদু ফল, খাবার টেবিলে সাজানো বা অফিসে টিফিন বক্স করে নেওয়া সবজি-রুটি বা ভাত-মাছের ঝোল কাঁদো কাঁদো চোখে তাকিয়েও আপনার সেই হঠাৎ জাগা তীব্র ক্ষুধা ভোলাতে পারে না। এভাবে হুট করে অকারণ তীব্র ক্ষুধা পাওয়াকেই বলা যায় ফুড ক্রেভিংস, যা আসলে স্বাভাবিক নয়। দিনে অন্তত কয়েকবার স্বাভাবিক শারীরিক নিয়মেই ক্ষুধা পায়। কিন্তু অস্বাভাবিক ক্ষুধা বা ক্রেভিংস সেই স্বাভাবিক নিয়মের মধ্যে পড়ে না।
যারা ওজন কমাতে চান তাদের জন্য ফুড ক্রেভিংস বা হুট করে তীব্র ক্ষুধা পাওয়ার চেয়ে বড় শত্রু আর নেই। এমন হলে সাধারণ ভাত-মাছ-ডাল নয়, খেতে ইচ্ছা করে অস্বাস্থ্যকর সব খাবার। এতে ওজন বেড়ে যাওয়া, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়াসহ দেখা দিতে পারে বিভিন্ন অসুখ। অস্বাস্থ্যকর খাবার মানেই অতিরিক্ত তেল, চিনি ও লবণযুক্ত খাবার (চিপস, চকলেট, কোমল পানীয়, প্যাকটজাত খাবার, বোতল বা প্যাকেটজাত ফলের রস ইত্যাদি), প্রসেসড ফুড, তেলে ভাজা খাবার ইত্যাদি। ফুড ক্রেভিংসে অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা থেকে মুক্তির কিছু টিপস দেখে নেওয়া যাক।
১. পানি খান ক্ষুধা কমান!
এখুনি চাই কাচ্চি, চিকেন ফ্রাই বা বার্গার! এমন হলে সাথে সাথে বড় এক গ্লাস পানি পান করুন। সাধারণত আমাদের শরীর প্রায়ই ক্ষুধা আর তৃষ্ণার অনুভূতি গুলিয়ে ফেলে! দেখা যায়, প্রায়ই তৃষ্ণাকে ক্ষুধার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে ভুলভাল সিগন্যাল পাঠায়। পানি পান করে কয়েক মিনিট অপেক্ষা করুন, ক্ষুধা কমলে বুঝবেন সেটা তৃষ্ণা ছিল। আর না কমলে আপনাকে আসলেই কিছু না কিছু সলিড খাবার খেতে হবে। সঙ্গে এটাও মনে রাখুন, পানি পানে কোনো ক্ষতি নেই। বরং এতে আপনার ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে আসার পাশাপাশি একসঙ্গে অনেকখানি খাবার খাওয়ার প্রবণতা দূর হয়। এতে ওজন নিয়ন্ত্রণ করাও সহজ হয়।
২. প্রোটিন, বেশি করে পাতে নিন!
প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, স্নেহ, ভিটামিন, শর্করা— সবধরনের খাবারই নিয়মিত খেতে হবে। এদের মধ্যে অতিরিক্ত শর্করা ও কার্বোহাইড্রেট শরীরের জন্য ক্ষতিকর। কার্বোহাইড্রেট গ্রহণের পরিমাণ কমাতে ও ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেশি করে প্রোটিন খান। এর কারণ, প্রোটিন খেলে বেশ একটা ভরপেট অনুভূতি আসে আর এটা পেটকে দীর্ঘক্ষণ সন্তুষ্ট রাখে। বিভিন্ন পরীক্ষাতে দেখা গেছে, সকালের নাস্তায় উচ্চমাত্রার প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার খেলে সারাদিন ঘন ঘন ক্ষুধা লাগে কম। আবার প্রোটিন রাত বিরেতে স্ন্যাকস খাওয়ার ইচ্ছাও নিয়ন্ত্রণে রাখে।
৩. ক্ষুধা পেয়েছে? পালাও…
যখনই জাংক ফুড খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা জাগবে, তখনই কিছুক্ষণ থেকে হেঁটে আসুন। ক্ষুধা থেকে ভাগতে দুয়েকটা ব্যায়াম বা গোসল করাও কাজে দেবে। কোনো কোনো গবেষণা দেখাচ্ছে, চিউয়িংগাম খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা দমন করে। মোট কথা, ক্ষুধা পেলে মনকে বিক্ষিপ্ত করতে অন্য কোনো কাজে মনোযোগ দিন। ছবি আঁকুন, গাছের পরিচর্যা করুন, নাচুন, হাঁটুন, দৌড়ান, ঘুরুন-ফিরুন, ব্যায়াম বা সাঁতার কেটে মনের মনোযোগ ক্ষুধা থেকে সরান।
৪. খাবারেও চাই রুটিন
ঘড়ির কাটা ধরে জীবনযাপন রক্ষা করতে পারে অতিরিক্ত ক্ষুধা ও অনিয়ন্ত্রিত খাওয়া থেকে। ঠিক ছাত্রজীবনের মত সারাদিনের বা সারা সপ্তাহের কোন বেলায় কী খাবেন, তার রুটিন করে ফেলুন। এভাবে পরিকল্পনামাফিক খাবার খেলে হুটহাট ক্ষুধা পাওয়ার প্রবণতা কমে যাবে। আর আপনি হবেন আরও স্বাস্থ্যবান ও ফিট।
৫. ক্ষুধা পেলে খান!
শরীরের স্বাভাবিক চাহিদা অনুযায়ী ক্ষুধা লাগা আর ক্রেভিংস বা অস্বাভাবিক ক্ষুধা কিন্তু এক না। তাই হুটহাট কোনো কিছু খাবার তীব্র ইচ্ছা থেকে বাঁচতে যখনই ক্ষুধা পায়, স্বাস্থ্যকর কোনো খাবার খান। মনে রাখবেন, দীর্ঘসময় না খেয়ে থাকলে বা ঠিকসময়ে ক্ষুধা নিবৃত্ত না করলে ক্রেভিংসের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই যখনই ক্ষুধা পাবে, তখনই হেলদি স্ন্যাকস যেমন— কাটা ফল বা ফল ও সবজি দিয়ে বানানো স্মুদি খান। এতে করে ‘উত্তরা বসে পুরনো ঢাকার চাপ খেতেই হবে’ ধরনের ইচ্ছা দমন হবে।
৬. স্ট্রেস দমান, ক্ষুধা কমান!
স্ট্রেস বা মানসিক চাপ থেকে প্রচণ্ড ক্ষুধা পেতে পারে। বিশেষত, নারীদের ক্ষেত্রে এটা নিয়মিত খাবার খাওয়ার অভ্যাস নষ্ট করে। দেখা যায়, মানসিক চাপে ভুগছেন এমন নারী স্বাভাবিক মানসিক অবস্থার নারীদের তুলনায় বেশি ক্যালরি গ্রহণ করেন। তাছাড়া, স্ট্রেস বা মানসিক চাপ কিন্তু করটিসল যা ওজন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে, সেখানকার রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। এতে পেটের চারপাশে চর্বি জমার সম্ভাবনা দেখা দেয়। তাই হুটহাট তীব্র ক্ষুধা পাওয়া কমাতে মানসিক চাপ কমাতে হবে। প্রয়োজনে মানসিক চিকিৎসকের সাহায্য নিন।
৭. কাঁচা পালং শাক খান
না, আপনাকে এতকিছু রেখে ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে কাঁচা পালং শাক কচকচ করে চিবোতে বলা হচ্ছে না। প্রতিদিন অল্প করে পালংয়ের রস খান। সবচেয়ে ভালো হয় যদি আপনার ফল কিংবা সবজির স্মুদিতে বা সালাদে কাঁচা পালং পাতা যোগ করতে পারেন। বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গেছে, পালং শাক চর্বি হজমের প্রক্রিয়ায় ধীরগতি আনে এবং ক্ষুধা বাড়ায় এমন হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। বাজার থেকে কেনা পালং শাকে কীটনাশক বা অন্য রাসায়নিক থাকতে পারে। তাই সরাসরি কাঁচা পালং শাক না ব্যবহার করে ফুটন্ত গরম পানি দিয়ে ধুয়ে নিন।
৮. মনযোগ দিয়ে খান!
যে খাবারই খান, মনোযোগ দিয়ে খান। এতে করে খাবারের সঙ্গে একটা মানসিক যোগাযোগ স্থাপন হবে। নিয়মিত ধ্যান করলে যেমন মানসিক শক্তি বাড়ে, তেমনি মনোযোগ দিয়ে খাবার খেলে খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে একটা আত্মিক যোগাযোগ তৈরি হয়। এতে করে যেকোনো খাবার খেলেই কন্টেন্ডেড বা ভরপেটের অনুভূতি তৈরি হবে। তাই হুট করে কিছু খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা দমন করতে প্রতিদিন যে খাবার খাচ্ছেন, সেটাই মন দিয়ে খেতে চেষ্টা করুন।
৯.পর্যাপ্ত ঘুমান!
লোকে বলে, ঘুম নাকি সর্বরোগের ওষুধ! এতে করে শরীর ও মস্তিষ্ক পর্যাপ্ত বিশ্রাম পায়। তাই যেকোনো শারীরিক ও মানসিক অসুখ সারতে চিকিৎসকেরা সময়মতো ঘুমের উপদেশ দেন। খাবারের ক্রেভিংস কমাতেও ঘুমের বিকল্প ওষুধ নেই! কারণ, পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব মানসিক অস্থিরতা বাড়ায়, যা স্বাভাবিক ক্ষুধা লাগা কমালেও ক্রেভিংস বাড়াতে ভূমিকা রাখে। এ কারণেই বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা যায়, ঘুম কম হয় বা ইনসমনিয়ায় ভুগছেন, এমন ব্যক্তিদের অবেসিটি বা অতিরিক্ত ওজন বাড়ার প্রবণতা দেখা দেয়। তাই, হুটহাট কিছু খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা দমন করতে রাতের বেলা পর্যাপ্ত ঘুমান।
১০. প্রতিবেলা, ঠিকঠাক খানা!
সকাল, দুপুর আর রাত— এই তিন বেলা ঠিকঠাক খাবার না খেলে আমাদের শরীর প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় না। ফলে, সময়ে অসময়ে হাবিজাবি অর্থাৎ জাংকফুড খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা জাগে। তাই, প্রতিবেলার খাবারে সব ধরনের খাদ্য উপাদান নিশ্চিত করতে হবে। এতে শরীরে পুষ্টি ঘাটতি হবে না ও হুটহাট এটা-সেটা খাওয়ার তীব্র ইচ্ছাও দমন হবে। আর তিন বেলা খাবারের মধ্যে যদি ক্ষুধা লাগে, তাহলে ভাজাপোড়া বা প্যাকেটজাত খাবার না খেয়ে অল্প পরিমাণ তাজা ফল, বাদাম, বা সালাদ খান।
১১. ক্ষুধা পেটে বাজার করা নয়
দেখা গেল মাসের বাজার সারতে বা কাঁচা বাজার করতে বেরিয়েছেন। রাস্তার পাশে মিষ্টি বা ভাজাপোড়ার দোকান দেখে লোভ সামলাতে পারলেন না। এভাবে অনেকসময় নিজের অজান্তেই খাবার দেখলে লোভ সামলানো মুশকিল হয়ে যায় আমাদের জন্য। এর থেকে মুক্তি পেতে বাজারে গেলে ভরপেট স্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে বের হন।
দেখা যায় এখন বড় বড় শপিং মলই শুধু নয়, মুভি থিয়েটার, পার্ক বা যেকোনো বিনোদন কেন্দ্রে চারপাশেই লোভনীয় সব খাবারের দোকান। এসব জায়গায় গেলেও ক্ষতিকর খাবার খাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখা মুশকিল হয়ে যায়। তাই প্রচুর ফাস্ট ফুড ও অস্বাস্থ্যকর খাবারের দোকান আছে— এমন জায়গায় যাওয়ার আগে বাসা থেকে স্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে যান বা বাটিতে করে কাটা ফল, বাদাম বা সালাদ নিয়েই বাসা থেকে বের হোন।