Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শিশুর অতি চঞ্চলতা: এডিএইচডির লক্ষণ নয় তো?


২৩ ডিসেম্বর ২০১৯ ১০:০০

‘আপা, বইলেন না, এই বাচ্চা নিয়ে যে কী পেরেশানিতে আছি! ঘরের সব কাঁচের জিনিস, ছুরি-কাঁচি, দামি জিনিস লুকিয়ে না হয় হাতের নাগালের বাইরে রাখি। তাও চেয়ারে উঠে নামিয়ে আনে। ঘরে যাও চড়-থাপ্পড় দিয়া সামলে রাখি, কারও বাসায় গেলে লজ্জায় পড়তে হয়। কী ধরবে, কী ভাঙবে— অস্থির করে ফেলে। পরিচিত কেউ সহজে এখন আর দাওয়াত দিতে চায় না, স্কুলের টিচাররা কমপ্লেইন করে। চিকিৎসার কথা বলেন? শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাকে দোষ দেয়, আমি নাকি বাচ্চা সামলাতে পারি না। এ বয়সে বাচ্চারা নাকি এমন করেই। আমি খারাপ, তাই বাচ্চারে পাগলের চিকিৎসা করাতে চাই। কত কষ্ট করে, মিথ্যা বলে যে হাসপাতালে নিয়ে আসছি …’

বিজ্ঞাপন

আমাদের চারপাশে এমন শিশুর সংখ্যা কম নয়। অনেকেই মনে করেন, একটা বয়সে শিশুরা চঞ্চল থাকবেই। কিন্তু মাত্রারিক্ত চঞ্চলতা যে শিশুর এক ধরনের আচরণগত সমস্যা, যেটিকে চিকিৎসার আওতায় না আনা গেলে ভবিষ্যতে বিপদ হতে পারে— তা বুঝতে চান না অনেকেই। বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিশুদের এমন অতিচঞ্চলতা বা হাইপার অ্যাক্টিভিটি অনেক ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক নয়। এ ধরনের প্রবণতা শিশুর বিকাশগত সমস্যা বা অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিজঅর্ডার (এডিএইচডি) নামের একটি রোগের একটি লক্ষণও হতে পারে। অনেক সময় এই আচরণকে স্বাভাবিক হিসেবে বিবেচনা করায় এটি সত্যি সত্যিই এডিএইচডি কি না, তা নির্ণয়ে দেরি হয়। ফলে, চিকিৎসায় ভালো হওয়ার সম্ভাবনাও কমতে থাকে।

বিজ্ঞাপন

এডিএইচডি কী? কেন হয়?
এডিএইচডি শিশুর মানসিক বিকাশগত একটি সমস্যা, যার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। ধরে নেওয়া হয় এটা জিনগত ও পরিবেশের প্রভাবে হয়। মা অথবা বাবার যে কারও একজনের এডিএইচডি থাকলে শিশুরও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ৫০ শতাংশ। এই রোগ সাধারণত মেয়েদের চেয়ে ছেলে শিশুদের বেশি হয় (৪:১)। এছাড়া মস্তিষ্কের রোগ, থাইরয়েড হরমোনের আধিক্য, গর্ভকালীন মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা, বিষাক্ত রাসায়নিক, কীটনাশক, লোহা ও সীসার সংস্পর্শে আসা, অপুষ্ট ও সময়ের আগে সন্তান হলেও পরবর্তী সময়ে এই রোগ হতে পারে।

সাধারণত, শিশুর চঞ্চলতাকে বয়সের সঙ্গে স্বভাবিক ধরে নেওয়ায় রোগ নির্ণয় করতে অনেকসময় দেরি হয়ে যায়। ৭ থেকে ১২ বছর বয়সের আগে অধিকাংশ বাবা-মা বুঝতেই পারেন না, সময়ে ঠিক হয়ে যাবে মনে করে।

কী দেখে বুঝবেন  শিশুর এডিএইচডি আছে?
এ রোগের তিনটি ধরন থাকে—

১. শুধুই অমনোযোগিতা;

২.অতিরিক্ত চঞ্চলতা ও অযাচিত আচরণ;

৩. ওপরের দু’টোই একসঙ্গে হওয়া, যা  বেশিরভাগ শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা যায়

লক্ষণ
১. নিজের মনমতো কাজ করা ও নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেওয়া

২. কোনো কাজ সুশৃঙ্খলভাবে না করা ও শেষ পর্যন্ত লেগে না থাকা। দ্রুত মনযোগ সরে যাওয়া

৩. কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে রেগে যাওয়া, জিদ করা বা বিষণ্ণ হয়ে যাওয়া

৪. এক জায়গায় স্থির হয়ে না বসা, সারাক্ষণই ছুটোছুটি করা

৫. চুপচাপ কোনো কাজ না করা, অযথাই চিৎকার করা, অপ্রয়োজনে ও অপ্রাসঙ্গিক কথা বলা। অন্যের কথার মাঝে কথা বলা ও তাদের কথায় কান না দেওয়া

৬. যেভাবে করতে বলা হয়, তা মেনে না নেয়া, গুছিয়ে কোনো কাজ না করতে পারা, প্রায়ই কাজে ভুল করা যেমন— হোমওয়ার্ক না করা, জিনিসপত্র হারানো

৭. কথা মনযোগ দিয়ে না শোনা, উদাস হয়ে যাওয়া, অবাস্তব কল্পনা করা, অন্যদের এড়িয়ে চলা বা মিশতে না পারা, হঠাৎ মারামুখি হওয়া

অটিজম আর এডিএইচডি কি একই রোগ?
না, দুটো একই রোগ না। অটিজমে অমনোযোগিতা, সঙ্গবিমুখ হওয়া, নির্দেশনা না মানার মতো কিছু লক্ষণ আছে এডিএইচডি’র মত। তবে এগুলো অটিজমের অংশ নয়।

রোগ নির্ণয়ের উপায়
মাত্রারিক্ত ও ধ্বংসাত্মক চঞ্চলতাকে অবহেলা বা প্রশ্রয় না দিয়ে তার মধ্যে রোগের কোনো লক্ষণ দেখা গেলে নিকটস্থ শিশু বিকাশ কেন্দ্র বা নিউরোলজির বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। বিভিন্ন আচরণগত, ল্যাবরেটরি পরীক্ষা ও বিকাশের ধাপগুলো যাচাই করেই তাকে এডিএইচডি রোগী বলা হবে, এর আগে নয়।

চিকিৎসা না করালে কী ক্ষতি?
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বড় হলে বাচ্চা ঠিক হয়ে যাবে— এমন আশা করে লাভ নেই। কারণ, ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে এ রোগ বড় হলেও থেকেই যায়। সময়মতো চিকিৎসা না করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। এ রোগে আক্রান্তরা পরিবার, সমাজ বা কর্মক্ষেত্র— কোথাওই খাপ খাওয়াতে পারে না।

শিশুর অতি চঞ্চলতা

চিকিৎসা
অতিরিক্ত চঞ্চলতা কমানোর জন্য ওষুধ দেওয়ার আগে কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ফল পাওয়া যেতে পারে। শিশুকে এসব প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা গেলে ধীরে ধীরে এডিএইচডি’র লক্ষণগুলো কমতে দেখা যেতে পারে, ধীরে ধীরে সবগুলো লক্ষণ থেকে মুক্ত হয়ে শিশু স্বাভাবিকও হয়ে যেতে পারে। এসব প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে—

১. শিশুর এনার্জিকে ভালো কাজে লাগানো, যেমন— সাঁতার কাটা, সাইক্লিং করা, কারাতে বা মার্শাল আর্ট শেখানো;

২. সহজ ভাষায় ও অল্প কথা শিশুতে কাজ বুঝিয়ে দেওয়া এবং শিশুর মেজাজের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে সহানুভূতি নিয়ে তাকে শেখানো;

৩. ছোট ছোট কাজের তালিকা করে দেওয়া, যেন সে অল্প সময়ে মনে করে সব কাজ করতে পারে। একইসঙ্গে কাজের জন্য সময় বেঁধে দেওয়া;

৪. তালিকা অনুযায়ী কাজ করলে শিশুর প্রশংসা করা ও প্রয়োজনে তার জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখা;

৫. ঘরে টিভি, ল্যাপটপ বা ট্যাবলেট কম্পিউটারের ব্যবহার কমিয়ে দিয়ে বাইরে খোলা মাঠে সবুজ প্রকৃতিতে খেলার সুযোগ করে দেওয়া;

৬. শিশু হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে গেলে মনযোগ সরিয়ে নেওয়া, জোরে জোরে শ্বাস নিতে বলা এবং সহানুভূতি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলা;

৭. স্কুলের শিক্ষক ও অভিভাবকদের সঙ্গে সমন্বয়  রাখা, যেন যেন ক্লাসেও শিশুটি মনোযোগ পায়। শিশুকে পড়া তৈরি করতে সাহায্য করা, প্রশংসা করা, কোনো কাজ ঠিকমতো করতে পারলে তাকে পুরস্কৃত করা— বাড়ির মতো স্কুলেও এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করা;

৮. শান্ত রাখার জন্য মাঝে মাঝে শিশুকে গান শুনতে দেওয়া, বিশ্রামে রাখা ও তার সঙ্গে সহজ ভাষায় গল্প করে তার মনযোগ ধরে রাখা।

খাবারের সঙ্গে এডিএইচডি’র সম্পর্ক
শিশুদের সাধারণত গম, ভুট্টা, চকলেট, টমেটো, আঙ্গুর, সিমজাতীয় খাবার দিতে নিরুৎসাহিত করা হয়। চিনি বা কোনো অ্যালার্জিক খাবারের সঙ্গে এডিএইচডি বাড়ার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে মা-বাবার কাছে যদি মনে হয় কোনো খাবারে শিশুর চঞ্চলতা বেড়ে যায়,  তাহলে সে খাবারটি দিয়ে পরীক্ষা করতে হবে সেটি অ্যালার্জির কারণে নাকি অতিচঞ্চলতার কারণে ঘটছে।

তবে অনেক গবেষণায় বলা হয়, ভিটামিন বি, সি, ডি-থ্রি, ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড ও ম্যাগনেশিয়াম জাতীয় ভিটামিন ও খনিজ জাতীয় খাবার এই চিকিৎসায় ভালো কাজ দেয়।

আমাদের দেশে কি চিকিৎসা আছে?
উন্নত দেশে এসব শিশুদের জন্য আলাদা স্কুল, হসপিটাল, চিকিৎসক এমনকি পরিচর্যাকারী, শিক্ষকদের সমন্বয়ে গ্রুপ তৈরি করে চিকিৎসা করা হয়। এসব শিশুদের আলাদা ভাতাও দেওয়া হয়।

আমাদের দেশে গুটিকয়েক স্কুল ও ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু প্রতিষ্ঠান এ সমস্যায় সেবা দিয়ে থাকে। তবে প্রতিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু বিকাশ কেন্দ্র আছে, যেখানে অভিজ্ঞ চাইল্ড নিউরোলজিস্ট এসব শিশুর চিকিৎসা ও থেরাপি দিয়ে থাকেন। এছাড়া এসব শিশুদের অভিভাবকদেরও কাউন্সেলিং করা হয় প্যারেন্টিং নিয়ে। কিভাবে এসব শিশুর সঙ্গে কথা বলতে হবে, তাদের মেজাজ কিভাবে সামলাতে হবে— এ বিষয়গুলোও মা-বাবাকে শেখানো হয়। সাধারণত শিশুর ওপর রাগ করলে বা তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। শিশুকে তখন নিয়ন্ত্রণ করা আরও কঠিন হয়ে পড়ে। তাই শিশুর তীব্র জেদের মুখেও কিভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, সে বিষয়গুলোও মা-বাবাকে শেখানো হয়। স্কুলশিক্ষকদেরও চাপ না দিয়ে এসব শিশুকে পড়ানোর উপায় নিয়ে জানানো হয়। অনেক সময় থেরাপিতে উন্নতি না হলে শিশুদের জন্য মুখে খাওয়ার ওষুধ দিতে হয়। তাতেও অনেক শিশু ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসে।

উপসংহারে বলব, শিশুর মাত্রারিক্ত ধ্বংসাত্মক চঞ্চলতাকে স্বাভাবিক বলে এড়িয়ে যাবেন না। বরং একে প্রশ্রয় না দিয়ে একটু সচেতন হলেই কিন্তু বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। শিশুর ভবিষ্যৎও সুরক্ষিত থাকবে।

লেখক: আবাসিক মেডিকেল অফিসার, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, শ্যামলী

ADHD এডিএইচডি শিশুর অতি চঞ্চলতা

বিজ্ঞাপন

মাদকের টাকার জন্য মা'কে খুন
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৫৭

আরো

সম্পর্কিত খবর