রিতুর ‘মেঘদূত ক্রাফট’: পাটের তৈরি হরেক পণ্য
৩ জানুয়ারি ২০২০ ১০:০০
‘মানুষের ইচ্ছাশক্তিই নাকি আসল’- জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে কথাটি এতো প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে! তাই মানুষকে এই সত্য বার বার আওড়াতে হয় বৈকি। আজ বলছি রিতু রানিপী’র গল্প। যিনি প্রবল ধৈর্য আর ইচ্ছাশক্তি দিয়ে তৈরি করছেন অপূর্ব সব পণ্য। রিতু রানিপী জানান, তার বানানো সব পণ্যই পাটের তৈরি। এসবের মধ্যে আছে দেওয়াল ঘড়ি, ওয়াল হ্যাঙ্গিং, আয়না ও নানা ধরনের শোপিস। তার বানানো পাটের দেওয়াল ঘড়ির বেশ চাহিদা আছে।
রিতু রানিপীর হাতে বানানো পাটের দেওয়াল ঘড়ি শুধু অসাধারণ বললে ভুল হবে, এক কথায় মনোমুগ্ধকর। পাট দিয়ে নিজের হাতেই ঘড়ির ফ্রেম বানান তিনি। ফ্রেম তৈরি হলে, ওপরে কাঁচ বসান। চমৎকার এই ঘড়িগুলো বানাতে বেশ কিছুটা সময় লেগে যায়। অত্যন্ত ধৈর্য লাগে একাজে, জানালেন রিতু। পাটের তৈরি এই পণ্যগুলো একইসঙ্গে পরিবেশবান্ধব ও রয়েছে নান্দনিকতার ছাপ। তাই এই কাজটি বেছে নিয়েছেন বলে জানান তিনি।
রিতু বলেন, ‘পাটের ঘড়ির পুরো কাজ আমি করি। ঘড়ি তৈরির প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কেনার জন্য বিভিন্ন মার্কেটে ঘুরতে হয়। পুরো কাজ একা করি বলে অনেক সময় লাগে। সহযোগিতার জন্য বিভিন্ন সময় মানুষ খুঁজেছি। কিন্তু কেউ এগুলো করতে আগ্রহ দেখায় না। অনেক সময়সাধ্য ব্যাপার বলে ধৈর্য নিয়ে কাজটি করতে কেউ আগ্রহী হয় না। কিন্তু আমি হাল ছাড়ি না। একাই করে যাচ্ছি।’
পাট দিয়ে বিভিন্ন ধরনের জিনিস বানিয়ে ভীষণ আনন্দ পান রিতু। তিনি বলেন, ‘কাজটি কষ্টের হলেও আমি ভীষণ আনন্দ পাই এতে। অনেক কষ্টের পর যখন একটি ঘড়ির পুরো কাজ শেষ হয়, তখন ভীষণ ভালোলাগে। এই আনন্দ অনেকটা মাতৃত্বের মতো। মা তার সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন, অনেক কষ্ট করেন সেই কয়েকটি মাস। তারপর যখন প্রথম সন্তানের মুখ দেখেন তখন সব কষ্ট দূর হয়ে যায়। তেমনি দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের পর একটি পাটপণ্য বানিয়ে আমিও তৃপ্তি পাই।’
পাটের ঘড়ি তৈরির প্রতি আগ্রহ জন্মানোর কারণ জানতে চাইলে রিতু বলেন, ‘ঘড়ি এমন একটি জিনিস যা প্রত্যেকের বাসায় থাকে এবং খুবই প্রয়োজনীয়। সুন্দর একটি ঘড়ি দেখতেও যেমন ভালোলাগে, ঘরের সৌন্দর্যও বাড়ায়।’ একারণেই ঘড়ি বানানোর পরিকল্পনা মাথায় এসেছে বলে জানান তিনি।
হেন্ডিক্র্যাফটের প্রতি রিতুর আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই, জানান তিনি। বলেন, স্নাতকোত্তর করে কিছুদিন চাকরিও করেছেন। কিন্তু মনের মধ্যে ছোটবেলার সুপ্ত ইচ্ছা ছিলই। একটা সময় নিজে কিছু করতে চাইলেন। প্রথমেই মাথায় আসে হস্তশিল্পের কথা। পরিবেশের কথা বিবেচনা করে বেছে নেন সোনালি আঁশ পাট। প্রথমদিকে পুঁজির সমস্যা হলেও অল্প পুঁজি নিয়েই সাহস করে মাঠে নামলেন। দৃঢ় মনোবল নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। এখন তিনি অনলাইন শপ ‘মেঘদূত ক্রাফট’ এর স্বত্তাধিকারী।
শুধু পাটের তৈরি পণ্যই নয়, বাসার অব্যবহৃত জিনিসগুলো দিয়েও তিনি ‘নতুন কিছু’ তৈরি করেন। যেমন শ্যাম্পুর বোতল, ভাঙ্গা মগ কী অব্যবহৃত মাটির পাত্র। এই পণ্যগুলো আমরা অনায়াসেই ফেলে দিলেও রিতু সেগুলো তুলে নেন সযত্নে। পাটের সাহায্যে সূক্ষ্ম কারুকাজের মাধ্যমে সৃষ্টি করেন নতুন কিছু।
পেইন্টিংয়ের প্রতিও বেশ আগ্রহ তার। ‘ডটিং টুলস’ ব্যবহার করে তৈরি করেছেন ওয়াল হ্যাঙ্গিং। তার এই কাজও অনেকের কাছে প্রশংসিত হয়েছে। তবে চাহিদামতো ডটিং টুলস বাজারে না পাওয়ার কারণে ইচ্ছা থাকলেও আরও সুন্দরভাবে কাজটি করা সম্ভব হচ্ছে না, জানালেন রিতু।
নতুন নতুন ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে ভালোবাসেন রিতু। তাই বিভিন্ন সময় নমুনা হিসেবে তৈরি করেছেন নানারকম ব্যবহার্য জিনিস। যেমন হাতে বোনা পাটের ব্যাগ, ফ্লোর ম্যাট, ওয়াল ম্যাট ও শোপিস। এই জিনিসগুলো কিনতে হলে কিছুটা সময় নিয়েও অর্ডার করা যেতে পারে।
রিতুর তৈরি পাটের দেওয়াল ঘড়ি একেবারেই ভিন্ন ধাঁচের। এই ঘড়ি তৈরিতে খরচ একেবারেই কম না, জানালেন রিতু। তিনি বলেন, ঘড়ির ধরনভেদে দাম ১৫০০ থেকে ৪০০০ টাকা। দেশের বাইরে থেকেও ঘড়ির অর্ডার আসে। এছাড়া শোপিসগুলোর দাম ধরনভেদে ৩৫০ থেকে ১৫০০, পেইন্টিং ২৫০০ থেকে ৩০০০ এবং ওয়াল হ্যাঙ্গিং ৩০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত। গ্রাহকের চাহিদামতো অর্ডার পাঠিয়ে দেন।
শৌখিন ও শিল্পবোধসম্পন্ন মানুষ শুধু কিছু ‘পণ্য’ বানিয়ে ক্ষান্ত হয়না, তারা নিজেকেও আপন রঙে রাঙাতে ভালোবাসে। রিতু রানিপীও তাদের একজন। কঠোর পরিশ্রম করেন, দেশে-বিদেশে অর্ডার পাঠিয়ে দেন; আবার দিনশেষে বই পড়েন, গান শোনেন সর্বপরি নিজের জন্যও সময় রাখেন। মনের মতো করে ঘর সাজিয়ে রাখেন, গাছের পরিচর্যা করেন। প্রত্যেকটি সময় কাজে লাগিয়ে আপন জগতের সত্যিই ‘রাণী’ হয়েছেন তিনি।