যেভাবে প্রথম বাঙালি হিসেবে জয় করলাম থানচির আইয়াং ত্লং পাহাড়
১৫ জানুয়ারি ২০২০ ১০:০০
মানুষ চিরকাল বৈচিত্রের প্রত্যাশী। প্রকৃতি এবং এর বৈচিত্রের একটা অদ্ভুত সম্মোহনী শক্তি আছে। বৈচিত্রের এই হাতছানিতে যুগ যুগ ধরে মানুষ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে অভিযান চালিয়েছে।
নতুন বছর ২০২০ এর শুরুতে বন্ধু, প্রকৃতি বিশারদ ডা. অরুনাভ চৌধুরীর উৎসাহে জয় করলাম বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক স্বীকৃত সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কেওক্রাডং। ফিরে আসার পর বন্ধুর কাছে থেকে অদ্ভুত এক তথ্য পেলাম। কেওক্রাডং বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ নয়! এর চেয়েও উঁচু পর্বত নাকি দেশে আছে! আর তা হচ্ছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে থাকা চারটি শৃঙ্গ। তারা হচ্ছে সাকা হাফং (৩৪৭১ ফুট), জো-ত্লং (৩৩৪৫ ফুট), দুম্লং (৩,৩১০ ফুট) এবং যোগী হাফং (৩২২২ ফুট)।
ছেলেবেলা থেকেই ভ্রমণ এবং অভিযান আমার রক্তে মিশে আছে। তাই দীর্ঘ দেড় যুগের প্রবাস জীবনে ভ্রমণ করেছি প্রায় ৩৯ টি দেশ। পাশাপাশি নিজের দেশে চলেছে একের পর এক অভিযান। তারই অংশ হিসেবে সম্প্রতি সাকা হাফং থেকে শুরু করে একে একে চারটি পাহাড়ে অভিযান শেষ করলাম।
বাংলাদেশের ৩০০০ ফুটেরও বড় এই শৃঙ্গগুলোর বেশিরভাগেরই অবস্থান বান্দরবন জেলার থানচি এবং রুমা এলাকায়। গত বছরের ২৬ অক্টোবর বাংলাদেশের ৪র্থ সর্বোচ্চ শৃঙ্গ যোগী হাফংয়ের ৪র্থ চূড়ায় আরোহণের পর প্রায় ৪ ঘণ্টার মতো আমি সেখানে ছিলাম। সেসময় আমার পথপ্রদর্শকরা আমাকে একটার পর একটা পাহাড় দেখাচ্ছিল। ওই দূরে সাকা হাফং (যেটা আমি ৬ মাস আগে জয় করেছি), ওইটা জো-ত্লং (২য় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ) এবং জো-ত্লং ও যোগী হাফংয়ের ২য় চূড়ার মাঝে অস্পষ্টভাবে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটা চূড়া।
আমার পথপ্রদর্শকদের কাছে ওই চূড়া সম্পর্কে জানতে চাইলে ওরা আমায় বলল তারা ওই চূড়া কিংবা পাহাড়টা সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। পথ দুর্গম হওয়ার কারণে ওই চূড়ায় কেউই ওঠেনা। শুধুমাত্র তাদের পাড়া (দালিয়ান পাড়া এবং মুরং পাড়া) থেকে শিকারিরা ওই পাহাড়ের অর্ধেক পর্যন্ত উঠে বাঁদর, সজারু আর ধনেশ পাখি শিকার করার জন্য।
যদিও প্রচণ্ড সন্দেহ হচ্ছিল এবং যোগী হাফংয়ের ৪র্থ শৃঙ্গ থেকে ওই অজানা পাহাড়টিকে দেখে আমার কেন যেন আরও উঁচু মনে হচ্ছিল। সামিট শেষ করে দালিয়ান পাড়ায় ফিরে এসে পাড়ার হেডম্যান (চেয়ারম্যান) “লাল রাম বম দাদা” কে জিজ্ঞেস করতে উনি বলেন, ওদিকটায় শুধু শিকারিরা যায়। পথ খুবই দুর্গম। বম ভাষায় ওই পাহাড়ের নাম “আইয়াং ত্লং’’। তিনি আরও বলেন, ‘গ্রামের কেউ ওই রাস্তা পুরোটা চেনেননা। আমার জানামতে আমাদের পাড়ার কেউই ওই পাহাড়ের চূড়ায় কোনদিন যায়নি। আর বাঙালিদের মধ্যে তো কারও যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।’
তার কাছেই শুনি একজন ৭২ বছরের বৃদ্ধ আছেন, যিনি প্রায় ৩০ বছর আগে “আইয়াং ত্লং“ এর চূড়ায় উঠেছিলেন যিনি অস্পষ্টভাবে রাস্তা চেনেন। আর যারা শিকার করতে যায়, তারা অন্তত অর্ধেক রাস্তা চেনে। তিনি উনি তাদের পুরো রাস্তাটা চিনিয়ে দিতে পারেন। তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমার পরের অভিযান পরিচালনা করব ওই অচেনা চূড়ায়।
সেই উদ্দেশ্যে গত ১১ই নভেম্বর, থানচির রেমাক্রি খাল পার হয়ে পৌঁছলাম দালিয়ান পাড়ায়। ভোরের আলো ফোটেনি তখনো । ভোর চারটা বাজে আমার সঙ্গি দুই শিকারি পথপ্রদর্শক লাল্লিয়ান বম, লাল ঠাকুম বম যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়ে প্রস্তুত। সঙ্গে প্রস্তুত শিকারি কুকুর হেরমিন। দালিয়ান পাড়া থেকে প্রায় ১২ কি.মি. পথ সহজেই অতিক্রম করে ১ ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম Y জংশনে। এখানে Y জংশন সম্পর্কে একটু বলে রাখা ভাল। এই জায়গাটার মধ্যে একটা বিশাল Y আকৃতির গাছ দাঁড়িয়ে। এই গাছের বাম দিকের রাস্তাটা চলে গেছে ৪র্থ সর্বোচ্চ শৃঙ্গ যোগী হাফংয়ের দিকে আর ডান দিকেরটা বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জো-ত্লং এর দিকে। অভিযাত্রীরা এই গাছটিকে অনুসরক চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করে। আমরা কোন দিকেই না গিয়ে সোজা সামনের দিকে এগিয়ে চললাম।
প্রায় ১২০০ ফুটের মত একটা পাহাড় অতিক্রম করে শুরু হল ঝিরিপথ। গতকাল বৃষ্টি হওয়ার কারণে ঝিরির পাথরগুলো অসম্ভব পিচ্ছিল হয়ে ছিল। ৬৭ কি.মি. ঝিরিপথের অনেকটাই পার হলাম। এই পথে দেখলাম প্রায় ১২ টার সব নাম না জানা অনেকগুলো ঝরনা। এই ঝিরিপথ পাড়ি দিতে গিয়ে আমাদের ৮০০ থেকে ৯০০ ফুট উঁচু প্রায় ৭ টা পিচ্ছিল খাঁড়াই পার হতে হয়েছে। মানে এই পিচ্ছিল জায়গাগুলো দিয়ে অনেক উঁচু থেকে ঝরনার জল, ঝিরিতে এসে পড়ে, যেখানে শুধু বাঁশ এবং দড়ির উপর ভর দিয়ে উপরে উঠতে হয়। খাড়াইতে পা পড়লেই স্লিপ কেটে নীচে পড়ে হাত-পা ভাঙ্গার সম্ভাবনা কিংবা জায়গামত পড়লে নিশ্চিত মৃত্যু।
ঝিরিপথ যখন শেষ, তখন সূর্য প্রায় ডুবো ডুবো। সূর্য অস্ত গেলে, পথপ্রদর্শকরা জানিয়ে দিল তারা এই পর্যন্তই রাস্তা চেনে এবং পাড়ার মুরুব্বির কথা অনুযায়ী, ঝিরিপথ যেখানে শেষ হবে, তার কিছুদুর হাতের বামে গেলেই “আইয়াং ত্লং” পাহাড় শুরু। প্রচণ্ড দুর্গম পথ, তাই সকাল ছাড়া হবে না, রাতটা এই ঝিরির শেষে এই বড় পাথরটার উপরে কাটাতে হবে। কাটা হল কলাপাতা, জ্বালানো হল আগুন। খাওয়া হল সঙ্গে নিয়ে আসা বিনি চালের ভাত আর আলু ভর্তা। আমরা দুপুরের খাবার খেলাম সন্ধ্যায়। প্রচণ্ড ক্লান্তিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি তার খেয়াল নেই।
সকালে শিকারিদের চিৎকারে ঘুম ভাঙলো। দাদা, ওঠেন। এগোতে হবে। পাড়ার মুরুব্বির নির্দেশনা অনুযায়ী এগোতে থাকলাম। পাহাড়ের গায়ে প্রচণ্ড জংলী সব গাছ-গাছালি, আমাদের সঙ্গী দুই শিকারির হাত যেন থামছেই না। দা দিয়ে জঙ্গল পরিস্কার করতে করতে, প্রায় অর্ধেক ওঠার পর, শুরু হল বাঁশ বাগান। আর এগোনো সম্ভব না। আমাদের দুই শিকারি পথপ্রদর্শকের তখন ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ার অবস্থা। বলল, ‘চলেন ফিরে যাই, আমরা আর পারছি না।’
‘পারব না’ শব্দটা আমার অভিধানে কখনোই ছিল না। আমি বললাম, ‘তোমরা ফিরে যাও। আমি একাই উঠবো।’ আমার একগুঁয়ে মনোভাবের কারণে আমার সঙ্গী পথপ্রদর্শকরা আমার সঙ্গেই থেকে যায়। বাঁশ বন পরিস্কার করতে করতে উঠতে থাকলাম আমরা। এক পর্যায়ে পথপ্রদর্শক লাল ঠাকুম বম এর চিৎকার, “দাদা, আমরা পৌঁছে গেছি চূড়ায়” – কিন্তু, এটা যে “আইয়াং ত্লং“ এর চূড়া তা বুঝবো কীভাবে? পাড়ার সেই মুরুব্বির কথা অনুযায়ী এর পশ্চিমে দেখা যাবে যোগী হাফং এর ২য় চূড়া এবং পূর্বে দেখা যাবে জো-ত্লং এর চূড়া। আমি নির্দেশ দেওয়ার আগেই, আমার শিকারিরা জঙ্গল সাফ করে বললো, পূর্ব আর পশ্চিমে তাকিয়ে দেখেন। আমি তাকালাম।
আরে তাইতো! সবই মিলে যাচ্ছে। আমার চোখে তখন গড়িয়ে পড়ছে আনন্দের অশ্রু। এবার আসল কাজের পালা। G.P.S দিয়ে দুবার করে পাহাড়ের উচ্চতা পরিমাপ করলাম- ৩২৯৮ ফুট। Coordinates: 21°40′23.78″N and latitude is 92°36′16.01″E, Data recorded by Garmin eTrex 30X GPS । তারপর পাহাড়ের চূড়ার উড়িয়ে দিলাম লাল সবুজের পতাকা।
১৩ ই নভেম্বর ২০১৯ বেলা ১ টা ৪১ মিনিটে, আমি প্রথম বাঙালি, পা রাখলাম বাংলাদেশের একটি সম্পূর্ণ অনাবিষ্কৃত, অপরিচিত একটি চূড়ায়। লিখলাম সামিট নোট।
এবার ফেরার পালা। পরদিন হেডম্যান দাদা আমার নামে প্রত্যায়নপত্র দিলেন যে “প্রথম বাঙালি হিসেবে আমিই “আইয়াং ত্লং“ জয় করেছি। নিকটস্থ বিজিবি ক্যাম্পে রিপোর্ট করা হল। তারাও আমার এই সামিট রেকর্ড বুকে লিখে রাখল।
এই অভিযান সফল করতে যার কাছে আমি কৃতজ্ঞ: দালিয়ান পাড়ার সেই বৃদ্ধ বম যিনি প্রথম বম হিসেবে “আইয়াং ত্লং” এর সন্ধান পান। তার নাম ভান রউসাং বম।
চট্টগ্রাম থেকে “আইয়াং ত্লং’ এ যাওয়ার রাস্তা: চট্টগ্রাম-বান্দরবান-থানচি-রেমাক্রি-দালিয়ান পাড়া বেস ক্যাম্প-Y জংশন- আইয়াং ত্লং।
লেখক- প্রকৌশলী ও অভিযাত্রী