পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস ঠেকাবে ভাইরাস সংক্রমণ
৩০ জানুয়ারি ২০২০ ১২:০০
– হ্যালো আপা।
– জ্বী বলুন।
– আমার বাচ্চাটার দুইদিন ধরে খুব জ্বর আর মাথা ব্যথা। বুকে পিঠেও খুব ব্যথা। গতকাল শরীরে একটু লাল এলার্জির মতো দানা ছিল। আজ দেখছি না। কিছুই খাচ্ছে না ছেলে। আচ্ছা ডেঙ্গু নাতো? পরীক্ষা কি করাবো?
যেকোন ভাইরাল ফিভারেই এমন হতে পারে। ডেঙ্গুর প্রকোপও এখন কমে গেছে। আমার অভিজ্ঞতা বলে এটা সাধারণ ভাইরাস জ্বর। তবুও না দেখে বলাটা আসলেই মুশকিল। কি উত্তর দেব এই মাকে?
আবার, আরেক বাচ্চার প্রচন্ড ঠান্ডাকাশি জ্বর। চার পাঁচদিন হয়ে গেলেও ভালো হচ্ছে না। চিন্তিত বাবা-মা এসেছেন বাচ্চা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলো কিনা তা জানতে। তারা শুনেছেন বাংলাদেশে নাকি দু’একটা রোগী পাওয়া গেছে।
যেকোন ভাইরাস সংক্রমনের ধরণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা কমবেশি একই ধরণের। লক্ষণ বুঝে চিকিৎসা দেয়া। সঙ্গে পর্যাপ্ত পুষ্টি ও বিশ্রাম নিশ্চিত করাই একমাত্র চিকিৎসা। তারপরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগের জটিলতার কারণে অনেক শিশুর অকাল মৃত্যু ঘটে যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।
আজ তাই কিছু আলোচিত ভাইরাস নিয়ে আলোচনা করবো।
‘আসছে নতুন নতুন ভাইরাস
নিস্তার পেতে চাইলে
পরিবর্তন করুন অভ্যাস।‘
আশির দশকে আসা মরণঘাতী এইচআইভি ভাইরাস থেকে হালের নভেল করোনা ভাইরাস… প্রতিবছরই কোন না কোন নতুন ভাইরাস আমাদের মাঝে মরনাতঙ্ক ছড়াতে আসছে নতুন উদ্যোমে।
আমার এই লেখা এসব ভাইরাসের লক্ষণ, চিকিৎসা, মাস্ক পরার নিয়মাবলী নিয়ে নয়। একটু ধৈর্য্য ধরে পড়লে বুঝতে পারবেন এসব ভাইরাস কোন গজব বা অভিশাপ নয়। এরা আমাদের নিজের তৈরী করা ফাঁদ আর এইসব ফাঁদ থেকে উদ্ধার পেতে শুধু মাত্র আমাদের কিছু বাজে অভ্যাস পরিবর্তন করলেই হবে।
‘বাঙালি খেয়েই মরে’!
এই প্রবাদ আজ আর বাঙালির একার জন্য সত্য নয়। সারা বিশ্বেই মানুষের বিচিত্র খাদ্যাভ্যাসের ফলে নানারকম রোগে ভোগার ইতিহাস দেখা যায়। সেটা যেমন অতীতে ছিল তেমনি বর্তমানেও বিদ্যমান।
একটু লক্ষ্য করলেই এসব ভাইরাসের কিছু কমন বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। যেমন,
এইচআইভি (HIV)
উদাহরণস্বরূপ আফ্রিকা মহাদেশের ছোট্ট একটি দেশ ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর কথা বলা যায়। এই দেশের কিনশাশা শহরে এই রোগের সূচনা হয় বলে ধরে নেওয়া হয়।
- শিম্পাঞ্জি থেকে সূচনা
- বুশ মিট বা কাঁচা মাংস খাওয়া আফ্রিকানদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। মূলত এটাই এসব প্রাণী থেকে সংক্রমিত ভাইরাস (zoonotic diseases) মানবদেহে আসার কারণ।
- ১৯০০ সালের দিকে আবিস্কৃত এই ভাইরাস পরের আশি বছরের মধ্যে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পরে নেশা বা ড্রাগ নেওয়ার সিরিঞ্জ, অনিরাপদ রক্ত দান ও অনিরাপদ যৌনাচারের মাধ্যমে।
সার্স (SARS) ভাইরাস
- ২০০২ সালে সারাবিশ্বে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে যার সূচনা চীন থেকে।
- ভাইরাস সংক্রমণের উৎস বন্য খট্টাস বা ভোঁদড় জাতীয় প্রাণী (civet cats) থেকে।
- হাঁচি ও কাশির মাধ্যমে ছড়ায়।
নিপা (NIPA) ভাইরাস
কাঁচা খেজুর রস বা আধ খাওয়া ফল থেকে ছড়াতে পারে এই ভাইরাস। মানুষের স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে মৃত্যুও ঘটাতে পারে এটি।
- এর উৎপত্তি এশিয়া অঞ্চল থেকে।
- বাদুর বা পাখির লালা ও প্রশ্রাব থেকে এ রোগ ছড়ায়। আক্রান্ত ব্যক্তির ঘাম, লালা, প্রশ্রাবের মাধ্যমে এ রোগ মানুষের মধ্যে ছড়ায়।
- এশিয়ার বিভিন্ন দেশে খেজুরের রস দারুণ জনপ্রিয় একটি খাবার। অনেকেই এই রস কাঁচা অবস্থায় খান। গাছের বাকল কেটে তা থেকে রস সংগ্রহ করা হয়। এতে বাদুর বা অন্য পাখি মুখ দিতে পারে। যা থেকে মানুষের মধ্যে এই ভাইরাস ছড়ায়।
- অনেকসময় বিভিন্ন পশুপাখির আধখাওয়া ফল খেয়েও নিপা (NIPA) ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ইবোলা (Ebola)
এর কথা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। ২০১৪-২০১৬ সাল বাঙালিকে আতঙ্কে রাখা এই ভাইরাসও আফ্রিকায় ছড়ায় ১৯৭৬ সালের দিকে।
- এই ভাইরাসের উৎপত্তি বাদুড় (Fruit bat) আর শজারু (porcupines) থেকে। কাঁচা বা আধা সিদ্ধ পশু-পাখির মাংস খেলেও এতে আক্রান্ত হওয়ার ভয় থাকে।
- আক্রান্ত ব্যক্তির লালা, ঘাম, রক্ত এমনকি স্পর্শেও এ রোগ ছড়ায়। রোগ ভালো হওয়ার পরও বুকের দুধ ও শুক্রানুতে অনেকদিন যাবত এই রোগের জীবাণু রয়ে যায়।
এভিয়ান ফ্লু (H5N1)
- ২০০৬ সালে পুরো পোল্ট্রি ব্যবসায় ধস নামানো ভাইরাস এভিয়ান ফ্লু পাখি, মুরগী, ও হাঁস থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
- মুরগীর বর্জ্য থেকে সহজেই সংক্রমন হতে পারে।
- মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমন হওয়ার কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
ডেঙ্গু (Dengue)
- বাংলাদেশে সাম্প্রতিক আতঙ্ক সৃষ্টিকারী ডেঙ্গু জ্বরের ভাইরাসও কিন্তু এসেছে আফ্রিকা থেকে।
- বলা হয় এডিস মশা বিংশ শতাব্দীর উপহার হয়ে আক্রান্ত বানরের রক্ত থেকে মানুষের শরীরে এই জীবাণু বয়ে এনেছে
- আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত মশার মাধ্যমে অন্য মানুষে ছড়ায়।
করোনাভাইরাস (Corona CoV)
- হালের নভেল করোনাভাইরাস চীনে ব্যাপক মৃত্যুর কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।
- গরু ছাগলের ডায়রিয়া আর বিড়াল ও কুকুরের শ্বাসকষ্ট সৃষ্টিকারি এই ভাইরাস মানুষের হাঁচি কাশি, থুতু এমনকি স্পর্শ থেকেও ছড়ায়।
প্রয়োজন কিছু অভ্যাস বদলের
এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন কেন এসব প্রাণীবাহিত ভাইরাস মানুষের ঘাড়ে চেপেছে। এগুলো কোন গজব বা গুজব নয়। সবই ছড়ায় মানুষের কিছু বদভ্যাস থেকে। তাই শুধুমাত্র আপনাদের সচেতনতাই পারে এসব ভাইরাস থেকে রক্ষা করতে।
খ্যাদাভ্যাস
দৈনন্দিন খাদ্যতালিকা থেকে শাকসবজি বাদ দেয়া, রেস্টুরেন্টের আধা সেদ্ধ মাংস খাওয়া আমাদেরই রোগের ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।
পরিস্কার পরিছন্নতা
পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। যেখানে সেখানে থুতু, কফ ও সর্দি ফেলা যাবে না। আবার যেখানে সেখানে প্রকৃতির ডাকে সাড়া না দেয়া, হাচি ও কাশির সময় মুখ ঢেকে নেয়াই হবে নিজেকে এসব ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা করার ও বাতাসে জীবাণু ছড়ানো রোধের উপায়।
আশপাশের জংজাল, আবর্জনা, টবের পানি, ফ্রিজের নীচে পরিষ্কার ও শুষ্ক রাখার দায়িত্ব কিন্তু আপনারই।
অযথা অ্যান্টিবায়োটিক নয়
ভাইরাল ফ্লু বা ইনফেকশনে অ্যান্টিবায়োটিক কোন কাজে আসে না বরং শরীরে অবস্থানকারি উপকারি ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলে মানুষকে আরো দুর্বল ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ফলে অন্যান্য সুযোগসন্ধানী ব্যাকটেরিয়া শরীরকে আক্রমণ করার সুযোগ পায় ও মৃত্যু ঘটাতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন।
কাজেই বিভিন্ন ভাইরাস সংক্রমনের হাত থেকে রক্ষা পেতে অপরিচ্ছন্ন থাকার অভ্যাস ত্যাগ করুন, পুষ্টিকর খাবার খান, নিজেকে পরিবর্তন করুন, চারপাশ পরিস্কার রাখুন, খাবারের ভেজাল রোধ করুন। সমাজ আপনাআপনি বসবাসযোগ্য হয়ে উঠবে।
লেখক – আবাসিক মেডিকেল অফিসার। বহির্বিভাগ, ঢাকা শিশু হাসপাতাল।
অ্যান্টিবায়োটিক ইবোলা এইচআইভি ভাইরাস এভিয়ান ফ্লু করোনাভাইরাস ডেঙ্গু নিপা ভাইরাস ভাইরাস সংক্রমণ সার্স ভাইরাস