(পর্ব-১২) বাবা থাকবে, পলাশ হয়ে !
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১২:০৪
ছেলেবেলা থেকে হারিয়ে যাওয়া বাবাকে খুুঁজতে খুঁজতে এক সময় বয়স হবার সাথে সাথে জোর করে মেনে নিতে হয়েছিল যে, সে আর ফিরে আসবে না।
সে সময়গুলোতে আমাকে বুঝ দেয়া হয়েছিল, সাভারের স্মৃতিসৌধ আমার বাবার কবর। সেই বিশালতা আমাকে মুগ্ধ করতো। বিস্মিত করতো। গর্বিত করতো। বুদ্ধি হবার পর জানতে পেরেছি এই স্মৃতিসৌধ শুধু বাবা নয়, একাত্তরে তিরিশ লাখ শহীদের জন্য উৎসর্গীত। সেখানে বাবার কবর নেই। তখন প্রশ্ন করতাম, তাহলে বাবা কোথায়! পুরো বাংলাদেশ জুড়েই কি বাবার কবর!
গত দশ বছর ধরে অনেক ভাবনা ভেবেছি, কোথায় গেলে শুধুমাত্র বাবাকে পাওয়া যাবে। তাঁর সাথে কথা বলা যাবে। জানতে পারবো সত্যি সত্যি সে আর আসবে না। মৃত মানুষের কবর না হলে তাঁকে মৃত ভাবা যায় কি!
পাঁচ বছর আগে ‘সবুজ পাতা’ নামে একটি সংগঠনের সাথে যোগাযোগ হলে আমি আমার মনের চাওয়াটা জানিয়েছিলাম। আমার চাওয়া ছিল বাবাকে গাছ হিসেবে দেখতে চাই। অনেক চিন্তার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আরেফিন স্যারের কাছে ভয়ে ভয়ে বলতে গিয়েছিলাম, শহীদ মিনারের এক কোণায় একটা জায়গা খালি আছে। সেখানে বাবার নামে একটা গাছ বুনতে চাই। তিনি আমাকে পূর্ণ সমর্থন এবং স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।
তখন ভাবতে বসেছিলাম কোন গাছ বাবা হলে ভালো হয়। বহুদিন তাঁকে দেখা যাবে আমাদের মাঝে, তেমন একটা গাছ। প্রথম শর্তেই তাই দীর্ঘজীবী গাছদের তালিকা করেছিলাম। তার মাঝে সবচেয়ে পছন্দের গাছ পেয়ে গিয়েছিলাম – পলাশ। শহীদ মিনারের ধার ধরে বড় বড় পলাশ গাছের সাথে তাল মিলিয়ে একদম শেষ জায়গায়টায়, রাস্তার ধার ঘেসে তার বাসস্থান তৈরি করেছিলাম।
২০১৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী আমরা বাবা গাছকে বুনতে পেরেছিলাম। শুকনো লকলকে দূর্বল একটি মাত্র পলাশ গাছের চারা পেয়েছিলাম তখন। আমার সাথে থাকা ছাত্র এবং সাংবাদিকরা কথা দিয়েছিল, ওদিক দিয়ে যাওয়া হলেই জল দিয়ে আসবে তাঁরা। এবং কথা রেখেছিল সবাই। তারপরও প্রথম বছর তার জন্য খুব খারাপ সময় কেটেছিল। সব পাতা ঝরে গিয়েছিল। জল দিতে গেলে মন খারাপ করে বসে থাকতাম। কোন অভিমানে সে এমন করছে বুঝতে পারতাম না।
তার পরের বছর আমি বাবা গাছের বাসস্থানকে লোহার শিক দিয়ে ঘেরাও করে দিয়ে এসেছিলাম। যেন কেউ কোন ক্ষতি না করতে পারে। তখন সে একটু খানি বড় হয়েছিল, দুই তিনটা পাতা ছেড়েছিল। সাহস করে তার বাসস্থানে একটা পরিচয়পত্র ঝাঁলাই করে দিয়েছিলাম সেই লোহার বেড়ায়। আমার এই কাজে সাহায্য করেছিল সুজন নামে এক ছোট ভাই। সবচেয়ে মজার কান্ড হচ্ছে সেখানকার টোকাই আর চায়ের দোকানের মানুষগুলোও বাবা গাছের যত্ন নিতো। আমি গেলেই ছুটে আসতো আমার সাথে দেখা করতে। একটা লোহার শিকও এদিক ওদিক হয়নি। ওরা পাহারা দিয়ে রাখতো তাই। জল দিতো প্রতিদিন। এরপর আর তাকে তেমন কোন বিশেষ ভাবে যত্ন নিতে হয়নি। অদ্ভুত এক প্রাকৃতিক নিয়মে সে বড় হয়ে উঠছে।
পলাশ বাংলাদেশের আবহায়ওয়াতে প্রাকৃতিক উপায়েই বেঁচে থাকে, বুঝতে দেরি হয়েছিল আমার। এখন সে ডাল পালা ছেড়েছে। আমার চেয়ে লম্বা হয়েছে কয়েক গুণ। তার নিচে গিয়ে দাঁড়ালে মনে হয় বাবা ছায়া দিচ্ছে আমাকে। বড় হয়ে পলাশ ফুল ফুটবার অপেক্ষা, তাঁর ফিরে আসবার অপেক্ষার থেকে আমাকে অনেক বেশি আন্দোলিত করে আজকাল।
আমি সবসময় বলে থাকি, একশো বছর বাঁচতে চাই। সত্যি বলতে পলাশ ফুল হয়ে ফুটে থাকা বাবাকে দেখবার আকাঙ্ক্ষায় সে কথা বলে থাকি আমি। পলাশ দীর্ঘজীবী গাছ। তাদের জীবনকাল তিন থেকে চারশো বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। তাই তাদের পরিপক্কতা ধীরে ঘটে। শহীদ মিনারে পলাশ ফুলে ফুলে ঢাকা সবগুলো গাছই চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সী।
বাবা গাছটা যখন পরিপক্ক হবে তখন তাকে দেখবার জন্য বাঁচতে চাই। কাঁধে গামছা বাধা হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে ঝাঁকড়া চুলের বাবরি নেড়ে, সাদা পাঞ্জাবী পায়জামা আর খালি পায়ে দাঁড়ানো। খালি গলায় শহীদ মিনারের লাল বেদীতে দাঁড়িয়ে বাবা গান করছে। একুশে ফেব্রুয়ারীতে রক্ত রাঙা পলাশ হয়ে বাবা আবারও তাঁর অপার্থিব সৃষ্টি, সেই ঐশ্বরিক সুরের একুশের গানে সবার সাথে গলা মিলাচ্ছে।
আমি চলে যাওয়ার পর শত শত বছর পার হয়ে যাবে। বাবা থাকবে, পলাশ হয়ে। বাবা গাছের সময় শেষ হয়ে গেলে আবারও সেখানে অন্য কোন এক নগর চাষী আরেকটা পলাশ গাছ বুনে দিবে। সে গাছে বাবা ফুল হয়ে ফুটবে আবারও। এভাবেই শত শত বছর ধরে বাবার বাসস্থান স্থায়ী করে দিয়ে যেতে চাই আমি বাংলাদেশের মাটিতে।
ভালোবাসার মানুষের মৃত্যুদিন থাকতে নেই। জীবনের শেষ নেই। মৃত্যু শুধুমাত্র এক জীবন থেকে অন্য জীবনে যাওয়ার পথ। বাবা পলাশ হয়ে আরেক জীবন পেয়ে জীবনকে উপভোগ করছে। চাষী পরিচয়ে বাবাকে এভাবে পাওয়াটা আমার জীবনের সর্বোচ্চ চাওয়াকে সার্থক করে তোলে। চাষী পরিবার, সুখী পরিবার।
সারাবাংলা/এসএস