বয়স যখন তিরিশ- একটু থামুন একটু ভাবুন
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৩:৩৪
রাজনীন ফারজানা।।
বিশের কোটা পেরিয়ে যখন তিরিশে পা দিতে চলেছেন তখন জীবনে এমন কিছু পরিবর্তন আসবে যা নিয়ে আপনাকে আগে থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। তিরিশে পা দিয়ে ও তিরিশের পরে কী কী পরিবর্তন আসবে তা জেনে নেই চলুন।
নিয়ন্ত্রণহীন বাড়তি ওজন
বিশের কোটায় ওজন বাড়া কমা যতটা সহজ থাকে ত্রিশে পা দিয়ে মেটাবলিজম কমে যাওয়ায় আপনার মাংসপেশীর স্থিতিশীলতা দিন দিন কমতে থাকে। এই ব্যাপারটা পুরুষের চাইতে নারীদের মাঝে বেশি দেখা দেয়। আর কেউ যদি সন্তান ধারণ করে তাহলে আগের ফিটনেস ফিরে পেতে আরও বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়।
কাজের জায়গায় মানসিক চাপের ফলেও এই বয়সে এসে ওজন কমার পরিবর্তে ওজন বাড়ার প্রবণতা দেখা যায়।
দাম্পত্য ও যৌনতা
অনেকসময় অনেক নারী ভাবেন যে তিরিশে এসে তাদের লিবিডো বা যৌনতার অনুভূতি হয়ত কমে যায় কিন্তু বিশেষজ্ঞরা উল্টোটা বলেন। কোন কোন গবেষক বলেন ২০ বছরের গোঁড়ার দিকে যেমন থাকে তার থেকে ২৭ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে এ ব্যপারে নারীদের আরও বেশি পরিপক্বতা আসে।
আর পুরুষের ক্ষেত্রে তিরিশের পরে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমতে থাকায় লিবিডো কমতে থাকে। এসব হরমোনগত পরিবর্তনের জন্যই মোটা হওয়া, চুল পড়ে যাওয়া, মুডের ওঠানামা ও ইরেকটাইল ডিসফাংশনের মত সমস্যা দেখা দেয়।
চুলে ধূসর আভা
তিরিশে এসে শুধু যে চুল পড়ার সমস্যা দেখা দেয় তাই নয়, মাথাসহ শরীরের নানা জায়গার চুল সাদা হতে শুরু করে।
উর্বরতা বা সন্তান জন্মদান ক্ষমতায় ভাটা
তিরিশের পরে সন্তান জন্মদান ক্ষমতা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমতে শুরু করে। মহিলাদের ক্ষেত্রে বত্রিশের পর থেকেই এটা কমতে থাকে। আর পয়ত্রিশের পরে অনেক নারীর ক্ষেত্রেই সন্তান ধারণে জটিলতা, গর্ভপাত আর গর্ভে সন্তানের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠায় সমস্যা দেখা দিতে পারে।
শুধুমাত্র মহিলাদের ক্ষেত্রেই নয়, পুরুষদের ক্ষেত্রেও তিরিশের পরে শুক্রাণুর গুণগত মান কমে যায় যা গর্ভধারণের ক্ষেত্রে জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতার সৃষ্টি করে। ২০ থেকে ৮০ বছর বয়সের মাঝে পুরুষের বীর্যে থাকা শুক্রাণুর ডিম্বানুর দিকে এগিয়ে গিয়ে ভ্রুণ এ রুপান্তর হওয়ার প্রবণতা কমতে থাকে।
পিরিয়ড বা মাসিকে সমস্যা
ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের মাত্রায় পরিবর্তন আসতে থাকায় নারীর মাসিকচক্রে কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে। স্বাভাবিকের তুলনায় মাসিকের সময়কাল কম বা বেশি হতে পারে, ব্লিডিং এর পরিমান কম বা বেশি হতে পারে আবার নির্দিষ্ট সময়ের আগে বা পরেও শুরু হতে পারে। কোন কোন নারীর ক্ষেত্রে তাদের তিরিশের কোটার শেষের দিকে মেনোপজ দেখা দিতে পারে। লেট থার্টিতে মেনোপজ দেখা দেওয়া স্বাভাবিক নয় সবসময়। তাই কারও এমন হলে অবশ্যই ডাক্তার দেখানো উচিৎ।
দুর্বল হতে থাকে ব্লাডার
তিরিশ বছর বয়সে ব্লাডারে দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। বিশেষত সন্তান জন্ম দিয়েছেন এমন নারীদের জন্য এই সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দেয়। সন্তান জন্ম দিলে মূত্রনালিতে থাকা স্নায়ু ও পেশীতে চাপ পড়ে যার ফলে এমনটা ঘটতে পারে। এমন হলে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ।
এসব ছাড়াও তিরিশের কোটার শুরুর দিকে নারী পুরুষ উভয়ই বেশ কিছু অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়। চেহারায় কোমলতা কমে গিয়ে কিছুটা শক্তপোক্ত ভাব আসতে পারে। আবার কেউ কেউ এমন মন্তব্যও করতে পারেন যে আপনি আর আগের মত হাসেন না। কেউ কেউ নিজের মাঝে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিও খুঁজে পেতে পারেন।
তিরিশ বছর এমন একটা বয়স যখন ব্যক্তিগত সম্পর্কের উপর আপনার পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা। চাকরিবাকরিতে একটা স্থিতিশীল অবস্থান থাকার পাশাপাশি ব্যাংকেও বেশ ভালো পরিমাণ টাকা থাকার কথা। আর এসবই একটা আনন্দদায়ক আর উপভোগ্য জীবনের ইঙ্গিত দেয়। আর ঠিক এ সময়েই নিয়তির নির্মম পরিহাসের মত আপনার সৌন্দর্য আপনাকে ধোঁকা দিতে শুরু করে। এক কথায় বলতে গেলে এ সময়ে অনেকেরই ত্বক, শারীরিক গঠন ও চেহারায় বদল আসে। তবে এই পরিবর্তনগুলো সবসময় সুখকর না যদি না আপনি বাড়তি যত্ন নিতে শুরু করেন।
এই বয়সে ত্বক ও চেহারায় যত সমস্যা
প্রথমবারের মত গভীর বলিরেখার দেখা মেলে তিরিশের পরে। আর চোখের চারপাশে ক্ষীন বাদামী দাগগুলো পূর্ণ প্রস্ফুটিত হয়ে চোখের কুঁচকে যাওয়া দৃশ্যমান হয়। কারও কারও ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধির ব্রণ আবার ফিরে আসে বা কারও ক্ষেত্রে প্রথমবারের মত ব্রণ দেখা দেয়। মূলত হরমোনঘটিত এই সমস্যাকে বলা হয় ‘এডাল্ট একনে’ বা ‘প্রাপ্তবয়স্কদের ব্রণ’। এ সময়ে রোদে পোড়া বা পরিবেশগত কারণে ত্বকে বিবর্ণতা ও নিষ্প্রাণ ভাব দেখা যায়। বিশের কোঠায় চুলে যে চমৎকার ঘন পনিটেইল ছিল তা পাতলা হতে শুরু হয় আর আয়নায় দাঁড়ালে বয়সের নানা চিহ্ন ফুটে ওঠে।
বিশেষত নারীদের ক্ষেত্রে এসব সমস্যার পিছনে বড় ভূমিকা পালন করে হরমোনগত পরিবর্তন যা তিরিশের আশেপাশেই শুরু হয়। যখন নারীর সন্তান জন্মদায়ক হরমোনগুলো ধীরে ধীরে ক্ষীণ হতে শুরু করে তখন চুলও পাতলা হতে শুরু করে আর ত্বক হতে থাকে ক্রমাগত নির্জীব। গ্রোথ হরমোন পড়তির দিকে থাকায় কোলাজেন উৎপাদন কমে যায় আর ত্বকে দেখা যায় নিষ্প্রভ ও আনত ভাব। আঠারো বছর বয়সে যে হরমোন লেভেল থাকে নয়শো তা তিরিশে এসে দাঁড়ায় দুইশো তে। পুরুষরা ত্বকের এ ধরণের সমস্যায় না ভুগলেও তাদের জন্য টাক পড়া ও টেস্টোস্টেরন হরমোন ও ডিএইচটি তে পরিবর্তন দেখা দেয়।
সবার জন্যই তিরিশ বছর বয়সে এসে হরমোনগত ভারসাম্যহীনতা দেখা দিলেও যারা নিয়মিত ট্যানিং বা রৌদ্রস্নান করে, নিয়মিত এলকোহল পানের অভ্যাস আছে, ধূমপান করে, নিয়মিত ব্যায়াম করেনা বা ঠিকমত পুষ্টিকর খাওয়াদাওয়া করে না তাদের ক্ষেত্রে এসব সমস্যা গুরুতর আকারে দেখা দেয়।
এতক্ষন তো জানলাম তিরিশ বছর বয়সে কী কী সমস্যা দেখা দেয়। এখন আসুন জেনে নেই এসব সমস্যা পাশ কাটিয়ে তিরিশ বছর বয়সে কিভাবে নিজেকে চমৎকার দেখাতে পারেন।
তিরিশ ও তার পরেও নিজেকে চমৎকার রাখতে নিচের এই আটটা ধাপ মেনে চলা দরকার।
সবার আগে ত্বক পরিষ্কার করুন
প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ও ঘুম থেকে উঠে অবশ্যই ত্বক পরিষ্কার করতে হবে। এতে করে ত্বকের নিজস্ব সংরক্ষণ ও পুনরজ্জীবিতকরণ প্রক্রিয়া সচল থাকবে। ত্বক পরিষ্কার করার রকমারি পণ্যের ছড়াছড়ি বাজারে। এসবের মধ্যে নিজের জন্য সঠিক পণ্যটি বেছে নিতে একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে ভুলবেন না।
এক্সফোলিয়েট করুন বা মরা ত্বক সরিয়ে ফেলুন
দিনের থেকে রাতে এক্সফোলিয়েট করা ভালো। রাতভর ত্বক রিনিউয়াল বা পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। তাই ঘুমাতে যাওয়ার আগে মরা কোষ পরিষ্কার করে ফেললে ত্বকের কার্যক্ষমতা আরও বাড়ে। খুব মৃদুভাবে এক্সফোলিয়েট করুন যেন শুধুমাত্র ত্বকের উপর থেকে মরা কোষই ঝরে যায়। কারও ত্বক তেলতেলে হলে ও ব্রণ থাকলে সপ্তাহে দুবারের বেশি এক্সফোলিয়েট না করাই ভালো।
সূর্যরশ্মি ও দূষণ থেকে ত্বককে রক্ষা করুন
দিনের বেলায় ত্বককে কোন একটা এন্টি অক্সিডেন্ট সেরাম বা ভিটামিন সি সেরাম আর সানস্ক্রিন ক্রিম দিতে ভুলবেন না। সেরামের আগে সান ব্লক দেবেন অবশ্যই। সানব্লক ভুললে চলবে না। কুয়ায়াশায় মোড়া শীত কি অঝোর শ্রাবণ, বছরের ৩৬৫ দিনই ইউভিএ বা ইউভিবি সমৃদ্ধ সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে। ইউভিএ রশ্মি ত্বকের বয়স বাড়াতে ভূমিকা রাখে।
ত্বককে যথেষ্ট জলের যোগান দিন
ত্বক যেন ডিহাইড্রেটেড না হয় সেটা নিশ্চিত করুন। গোসলে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় না কাটানোই ভালো আর কুসুম গরম পানি ব্যবহার করুন। গোসলের সাবান বা শাওয়ার জেলটি যেন ময়েশ্চারাইজারযুক্ত হয় তা খেয়াল রাখুন। এটা ত্বকের উপরি স্তরে একধরনের সুরক্ষার আবরণ হিসেবে কাজ করবে। কেউ চাইলে গোসলের পানিতে ৪ থেকে ৫ ফোটা এসেনশিয়াল অয়েল, আমন্ড অয়েল, ভিটামিন ই তেল এবং তিলের তেল নিয়ে দুই মগ পানিতে মিলিয়ে গোসলের পরে গায়ে দিন। এটা দারুণ একটা ময়েশ্চারাইজার হিসেবে কাজ করবে।
ময়েশ্চারাইজ করা বা জলীয়ভাব বজায় রাখা
প্রতিদিন গোসলের পরে ভেজা গায়ে ভালো মানের ময়েশ্চারাইজিং লোশন বা এপ্রিকট অয়েল বা অলিভ অয়েল লাগাতে পারেন। এটা ত্বকের শুষ্কতা দূর করে দারুণ স্বাস্থ্যজ্জ্বল দেখাবে।
পর্যাপ্ত পানি পান করুন
প্রচুর পরিমাণ পানি পান করতে ভুলে গেলে চলবে না একদমই। পানি ভেতর থেকেই শুষ্কতা দূর করতে ভূমিকা রাখে। পানিতে লেবুর রস যোগ করলে সেটা আরও বেশি কার্যকরী হবে। তাছাড়া দিনে ১৫ থেকে ২০ মিনিটের ব্যায়ামের পাশাপাশি উচ্চমাত্রার ফাইবার বা আঁশসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে।
স্ট্রেস বা চাপমুক্ত থাকুন
কথাটা বলা সহজ হলেও করা মোটেই সহজ না। কিন্তু তারপরেও প্রতিদিনের কাজ ও দায়িত্বগুলো কিছুটা গুছিয়ে ও পরিকল্পনা অনুযায়ী করলে তা আমাদের চাপমুক্ত থাকতে সাহায্য করে অনেকটাই। আর চাপমুক্ত থাকলে সেটা ত্বকেও প্রভাব ফেলে ও ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়।
ছবি- আশীষ সেনগুপ্ত
মডেল- অপর্ণা ঘোষ ও নিলয় আলমগীর
সারাবাংলা/আরএফ/এসএস