বদলে যাওয়া স্বাধীনতার মানে
২৬ মার্চ ২০২০ ১২:৫৩
‘স্বাধীনতার মানে বোঝে পাহাড়-সাগর-ঝর্না-নদী
স্বাধীনতার মানে বুঝেই বইছে বাতাস নিরবধি।’
কবি ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের এই দুই লাইনই যেন বলে দেয় অনেক কথা। স্বাধীনতা মানেই যেন অবাধ চলাচল, নির্বিরোধ জীবনযাপন। কেউ চায় না খাঁচায় বদ্ধ জীবন। সাগড়, পাহাড় আর ঝরনার মতো নিরবধি বয়ে চলতে চাই আমরা। উড়ে বেড়াত চাই মুক্ত পাখির মতো, স্বাধীন দেশের স্বাধীন আকাশে। বড় কষ্টের পর অর্জিত যে এই স্বাধীনতা। ২৬ মার্চ, আমাদের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস।
৪৯ বছর আগে আজকের এই রাতে জাতীর জীবনে নেমে এসেছিল ভয়ানক বিভীষিকাময় এক রাত। ঘুমন্ত বাঙালির ওপর মারণাস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাক হানাদার বাহিনী। কোনো বিচার-বিবেচনা ছাড়াই সামনে যাকেই পেয়েছে, গুলি করে মেরেছে।
সে রাতেই তারা আটক করে নিয়ে যায় বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এর আগে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত এই নেতা বাঙালির স্বাধীনতার চেতনাকে উসকে দেন। দেন সর্বাত্মক অসহযোগের ঘোষণা। যার যা আছে তাই নিয়ে যুদ্ধে নেমে পড়ার আহ্বান জানান। তবে গ্রেফতারের ঠিক আগে আগেই স্বাধীনতার ঘোষণাটি ছড়িয়ে দিয়ে যান। চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে যেটি প্রচারিত হয়।
আজ স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতাব্দী পূরণের এই পরম লগ্নে বাঙালি জাতির মেতে ওঠার কথা আনন্দ আর হাসি গানে। কিন্তু হায়! উদযাপন আর করতে পারছি কই আমরা। নভেল করোনাভাইরাস, তথা কোভিড-১৯ রোগের আক্রমণে স্থবির পুরো পৃথিবী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব বলছে, বিশ্বের ১৯৬টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাস। এখন পর্যন্ত আক্রান্ত শোয়া চার লাখের বেশি মানুষ। মৃতের সংখ্যা পেরিয়ে গেছে ২১ হাজার।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ভাইরাসের কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি, নেই কোনো ওষুধও। তাই এর থেকে কোনো নিস্তারও নেই। মানুষের শ্বাসনালীকে দুর্বল করে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া এই ভাইরাসকে ঠেকানো যাচ্ছে না কোনোভাবেই। আক্রান্তের শরীর থেকে নির্গত ড্রপলেট (কফ-থুতু-কাশির মাধ্যমে ছড়ানো) থেকে মানুষ থেকে মানুষে অতি দ্রুততার সঙ্গে ছড়াচ্ছে এটি। রোগ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা দুর্বল, আগে থেকেই ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগের মতো জটিল শারীরিক অবস্থার মানুষ যারা, তাদের জন্য প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে করোনাভাইরাস।
এমন অবস্থায় করোনা সংক্রমণের প্রথম দেশ চীন উদ্ভাবন করেছে একে ঠেকানোর এক অভিনব উপায়। তা আর কিছু নয়, সোস্যাল ডিসটেন্সিং— মানুষে মানুষে দূরত্ব গড়ে তোলা। আক্রান্ত ব্যক্তিকে আইসোলেট, মানে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে হবে। তার সঙ্গে অন্তত এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। আর আক্রান্তের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিরা নিজেদের দুই সপ্তাহের জন্য সেলফ কোয়ারেনটাইনে থাকবেন। মানে নিজেরাও অন্যদের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখবেন। এই সময়ে আসা যাবে না সুস্থ কোনো ব্যক্তির সংস্পর্শে। এর মধ্যে করোনাভাইরাসের উপসর্গগুলো দেখা না দিলে আবারও স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরতে পারবেন তিনি।
আবার যারা করোনাভাইরাস উপদ্রুত স্থান থেকে আসছেন, তাদের দুই সপ্তাহের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেনটাইনে রাখাকেই সমাধান মনে করা হচ্ছে। কখনো কখনো কোন এলাকায় কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর দেখা মিললে পুরো এলাকা লকডাউন করে রাখা হচ্ছে। অর্থাৎ সেখানে বাইরে থেকে কেউ যেতেও পারবে না, সেখান থেকে কেউ বেরও হতে পারবে না। ঠিক এই পদ্ধতি মেনেই বিভিন্ন প্রদেশে ছড়িয়ে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ার পরও একটা পর্যায়ে গিয়ে একে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় চীন।
কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ইউরোপের দেশ ইতালি থেকে ছড়াতে ছড়াতে সমগ্র ইউরোপ ও আমেরিকাতেও ছড়িয়ে পড়েছে মারাত্মক এই ভাইরাস। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা, লাফিয়ে লাফিয়ে ঊর্ধ্বগামী মৃত্যুহার। বাংলাদেশে এ মাসের ৮ তারিখে প্রথম কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর খবর পাওয়া যায়। দেশে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত ৩৯ জন। মৃত ৫। প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে আছেন ৪৭ জন, প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেনটাইনে আছেন ৪৭ জন। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে বাড়ি গেছেন সাত জন। এমন অবস্থায় জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) প্রথম থেকেই অনুরোধ করে আসছে, যতটা সম্ভব বাড়ির বাইরে না বের হতে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, বারবার হাত ধোয়া, কফ-থুতু ও ব্যবহৃত নোংরা টিস্যু যেখান সেখানে না ফেলা, ঠান্ডা লাগার লক্ষণ দেখা দিলে মাস্ক ব্যবহার করার মতো পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন তারা।
এর মধ্যে ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়। ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সারাদেশে সাধারণ ছুটিও ঘোষণা করে সরকার। বাইরে জনসমাগম ঠেকাতে প্রশাসনকে সহায়তা করতে বুধবার থেকে মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনী। এর মধ্যে আবার সড়ক, নৌ ও রেলপথেও গণপরিবহন বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আবার দেশের বিভিন্ন এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় লকডাউনও ঘোষণা করা হচ্ছে। সার্বিকভাবেই সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা, কেউ যেন প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না বের হন।
স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে জাতির গৌরবময় ইতিহাসের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি বলেন, বীরের জাতি বাঙালি নানা দুর্যোগ-সংকটে সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করেছে। ১৯৭১ সালে যেভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করে বিজয়ী হয়েছে, ঠিক তেমনি করোনাভাইরাস মোকাবিলাও একটি যুদ্ধ। তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন— এ যুদ্ধে আমাদের দায়িত্ব ঘরে থাকা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা।
আমরা জাতি হিসেবে স্বাধীনতা অর্জন করলেও অনেক ক্ষেত্রেই স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতাকে মিলিয়ে দেখার প্রবণতা অনেকের মধ্যেই দেখা যায়। করোনাভাইরাস ইস্যুতেই যেমন স্বাধীনতা বলতে চলাচলের স্বাধীনতার চর্চা কতটা ক্ষতিকর হতে পারে, তাও ভুলে যাই। বিদেশ ফেরতরা কোয়ারেনটাইনের শর্ত মানছেন না। অনেকেই নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা রাখার নির্দেশনা মানছি না। আমরা ভাবছি না, পরিবারের বাকি সদস্যরাও আমাদের মাধ্যমে আক্রান্ত হতে পারে। আজ তাই আসুন, স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে আমরা নতুন করে সচেতন হওয়ার শপথ নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি, অন্যদের মেনে চলতে উৎসাহ দেই। এই মুহূর্তে নিজেকে দুই সপ্তাহের জন্য গৃহবন্দি রাখি। স্বাধীনতা দিবসে এই গৃহবন্দিত্বই হতে পারে দেশপ্রেমের অনন্য নিদর্শন।
আইসোলেশন করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বদলে যাওয়া স্বাধীনতা লক ডাউন স্বাধীনতা দিবস স্বাধীনতার মানে