সড়ক পথে মায়াবী ভূটান (শেষ পর্ব)
২ মার্চ ২০১৮ ১৭:১৪
হৃদয় দেবনাথ ।।
থিম্পু
যত সকাল সকাল বের হবেন, থিম্পু দেখার জন্য তত বেশি সময় পাবেন হাতে। তাই সকাল ৭ টার মধ্যে উঠে প্রস্তুত হয়ে ৮ টার মধ্যে বেরিয়ে পড়ুন। থিম্পুতে কোনো রেস্টুরেন্টই সকাল সাড়ে ৯টা-১০টার আগে খোলে না। আর নাস্তা তৈরি হতে হতে সাড়ে ১০টা। তাই কেউ আরও সকালে নাস্তা করতে চাইলে আগে থেকে শুকনো খাবার সংগ্রহে রাখতে পারেন।
যাই হোক ট্যাক্সি নিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরো থিম্পুর আশপাশে ঘুরে দেখতে পারেন। থিম্পুতে সাইট সিইংয়ের জন্য উল্লেখযোগ্য ও দর্শনীয় স্থানগুল হল বুদ্ধ দর্দেনমা স্ট্যাচু, সীমতখা ডিজং, ন্যাশনাল তাকিন সংরক্ষিত চিড়িয়াখানা, কিংস মেমোরিয়াল চড়টেন, তাসিছ ডিজং, পার্লামেন্ট হাউজ, রাজপ্রাসাদ, লোকাল মার্কেট, ন্যাশনাল স্কুল অব আর্টস, ন্যাশনাল লাইব্রেরি, বিবিএস টাওয়ার ইত্যাদি ছাড়াও আরও অসংখ্য জায়গা
পুনাখা
ভূটান গেলে ঘুরে দেখতে পারেন পুনাখা। মনে রাখা ভালো পুনাখা, হাভেলি, বুম্থাং এই জায়গাগুলোতে যেতে থিম্পু ইমিগ্রেশন অফিস থেকে আলাদা করে অনুমতি নিতে হয়। সরকারি ছুটির দিনে ইমিগ্রেশন অফিস বন্ধ থাকে। এমন হলে আপনি চলে যেতে পারেন পারোতে। মনে করে দেওয়া ভালো থিম্পু থেকে পারোর রাস্তা অসম্ভব রকমের সুন্দর। তাই নিশ্চিত বলতে পারি সেই অসাধারণ সৌন্দর্য থেকে আপনি এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরাতে পারবেন না।
পারো পৌঁছার পর হোটেল ঠিকঠাক করে ফ্রেশ হয়েই বেরিয়ে যেতে পারেন টাইগার নেস্টে ওঠার উদ্দেশ্যে। পারো শহর থেকে টাইগার নেস্টের ট্যাক্সি স্ট্যান্ড বা পার্কিং প্লেসে যেতে সময় লাগবে প্রায় ৩০ থেকে ৪৫ মিনিটের মতো। আর ট্যাক্সি স্ট্যান্ড কাম পার্কিং প্লেস থেকে টাইগার নেস্টে পায়ে হেঁটে উঠতে সময় লাগবে প্রায় আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। যাওয়াটা কষ্টকর হলেও, পৌঁছানোর পরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে আপনার মনের যা অনুভূতি হবে তা লিখে বা বলে বোঝানো সম্ভব না।
তবে পায়ে হেঁটে পাহাড়ে ওঠা কষ্টকর মনে হলে তাদের জন্য ঘোড়ার ব্যবস্থা আছে। টাইগার নেস্টের বেজক্যাম্প পর্যন্ত ঘোড়ায় যাওয়া যাবে। খরচ পড়বে জনপ্রতি ৬০০ রুপি/ভুটানিজ গুল্ট্রুম। তারপর বিকেলটা কাটাতে পারেন অসম্ভব সুন্দর আর কাচের মতো স্বচ্ছ পানির পারো নদীর ধারে। রাতটা চাইলে পারোতেই কাটিয়ে দিতে পারেন। পরদিন সকাল সকাল বের হয়ে পারোর আরও যেসব চমৎকার জায়গাগুলো আছে তা দেখতে পারেন। যেমন- কিচু মনাস্টেরি, এয়ারপোর্ট ভিউ পয়েন্ট, ন্যাশনাল মিউজিয়াম/তা-ডিজং, পারো ডিজং, চেলে-লা-পাস ইত্যাদি।
পারো দেখা শেষ হলে বিকেলের মধ্যে থিম্পুতে ফিরে যেতে চেষ্টা করুণ। এরপর পুনাখা যাওয়ার জন্য ইমিগ্রেশন অফিস থেকে অনুমতি নিয়ে রাখতে পারেন। রাতটা থিম্পুতেই কাটাতে পারেন। পরদিন ভোর থাকতে ঘুম থেকে উঠে রওনা দিতে পারেন পুনাখার উদ্দেশ্যে। নাস্তা পথেই সেরে নিতে পারেন। দুপুরের মধ্যে পৌঁছে যেতে পারেন পুনাখাতে। আর যাওয়ার পথে নানা জায়গায় থেমে থেমে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করার পাশাপাশি স্মৃতি ধরে রাখতে পারেন ক্যামেরায়। এরপর চাইলে বিকেলে থিম্পুতে ফিরে সেখানেই রাত কাটাতে পারেন।
পুনাখার চমৎকার যে জায়গাগুলো দেখলে আপনার মন ভরে যাবে তা হল দোচু-লা-পাস, পুনাখা ডিজহং, আর্চারি গ্রাউন্ড ইত্যাদি।
এরপর যেতে পারেন ফুন্টশোলিং দেখতে। দুপুর বারোটার দিকে রওনা দিলে বিকেল চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে ফুন্টশোলিং পৌঁছে যেতে পারেন। বিকেল আর পুরো সন্ধ্যাটা ফুন্টশোলিংয়ে ঘুরেই কাটিয়ে দিতে পারেন। কেউ চাইলে রাতে ইন্ডিয়ান অংশে গিয়েকোন মুসলিম রেস্টুরেন্টে মজাদার গরুর মাংস দিয়ে জম্পেশ ডিনার করতে পারেন। চাইলে রাতেও থাকতে পারেন এখানে।
রাতটা ফুন্টশোলিং এ কাটিয়ে ভোর থাকতে ঘুম থেকে উঠে ফুন্টশোলিং ইমিগ্রেশন অফিস থেকে ডিপার্চার বা এক্সিট সিল নিতে হবে। তবে সকাল ছয়টা বা সাতটার দিকে গেলে প্রথমেই আপনাকে ৯টার পর আসতে বলতে পারে। সেক্ষেত্রে একবার ভালো করে অনুরোধ করতেই পাঁচ মিনিটের মধ্যে আপনাকে ডিপার্চার বা এক্সিট সিল দিয়ে দেবে। এখানে কাজ সেরে জয়গাঁও ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন অফিসে যেতে হবে আটটার মধ্যে। ওখানে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ হলে দুইভাবে বাংলাদেশে ফিরে আসতে পারেন।
এক. জয়গাঁও থেকে হাসিমারা হয়ে ময়নাগুরি থেকে চ্যাংড়াবান্ধা এবং তারপর বুড়িমারী। ঠিক যাওয়ার সময় বাংলাদেশ থাকে যেভাবে গিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই আগে থেকে শিলিগুড়িতে শ্যামলী বাস কাউন্টারের সঙ্গে ফোন করে নিশ্চিত করতে হবে যে আপনি বুড়িমারী থেকে বাসে উঠবেন।
দুই. জয়গাঁও থেকে অটোতে করে আপনি চলে যান হাসিমারা রেলস্টেশনের উদ্দেশে। এখান থেকে শিলিগুড়ি যেতে কেউ ট্রেনের বিকল্প হিসেবে বাসেও যেতে পারেন। সেজন্য আপনাকে জয়গাঁও থেকে সরাসরি বাসে উঠতে হবে। তবে এখানে খরচ বেশি পড়বে। হাসিমারা থেকে ট্রেন ১০টা ২০ মিনিটে আর ভাড়া জনপ্রতি ৬০ রুপি করে। টিকিটে কোনো বগি নির্দিষ্ট করা থাকে না। তাই চাইলেই একটা স্লিপার বগিতে উঠে পড়তে পারেন। ট্রেনে গেলে শিলিগুড়ি পৌঁছবেন দুপুর ২টার দিকে। চাইলে বিকেল ও সন্ধ্যায় এখান থেকে কিছু শপিংও করতে পারেন। রাতটাও চাইলে শিলিগুড়িতে কাটাতে পারেন।
কারও কাছে যদি ভারতীয় ট্রানজিট ভিসায় ভারতে অবস্থানকালের জন্য কিছুটা বেশি সময় পান, তাহলে এই সুযোগে দার্জিলিং থেকেও ঘুরে আসতে পারেন। শিলিগুড়ির মানুষ বেশ আন্তরিক। তারা বাংলাদেশ ক্রিকেটের বেশ খোঁজখবর রাখে। সাকিব, মুস্তাফিজুর রহমানের তারা খুব ভক্ত।
শিলিগুড়ি মালদাগুড়ি (শ্যামলী বাস কাউন্টার) থেকে বাস ছাড়ে দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে (দিনের একমাত্র বাস যা রবিবার বন্ধ থাকে)। চ্যাংড়াবান্ধা ইমিগ্রেশনে আসতে আসতে ৪টা বেজে যেতে পারে। তেমন কোনো ঝামেলা ছাড়াই চ্যাংড়াবান্ধা-বুড়িমারী সীমান্ত পার হলে দেখবেন বুড়িমারী ইমিগ্রেশন অফিসের পাশেই অপেক্ষারত শ্যামলী পরিবহণের বাস। সেখানে থেকে এসি বা নন এসি বাসে ঢাকায় ফিরতে পারেন। কল্যাণপুর বাস স্ট্যান্ড পৌঁছাতে পৌঁছাতে পরদিন সকাল ৭টা।
মনে রাখা ভালো যেভাবেই ফেরেন না কেন, ফিরে আসার বাসটিকিট শিলিগুড়িতে শ্যামলী বাস কাউন্টারে ফোন করে নিশ্চিত করতে হবে।
খরচ
জনপ্রতি আপনার খরচ পড়বে ১৫-১৬ হাজার টাকা (শপিং ছাড়া)। উপরোক্ত জায়গা ছাড়াও হাভেলি ও বুম্থাং ঘুরলে খরচ কিছুটা বাড়বে। আর সবকিছুতে ট্যাক্সি বাদ দিয়ে পাবলিক বাসে ঘুরলে খরচ আরও কম পড়বে। কিন্তু তাতে সময় কিছুটা বেশি লাগবে।
কিছু সতর্কতা
এক. ভারতীয় ভিসাসহ পাসপোর্টের ফটোকপির কয়েক কপি, নিজের ন্যাশনাল আইডি কার্ডের কয়েকটি ফটকপি, আর কয়েকটি পাসপোর্ট সাইজের ছবি রাখবেন নিজের কাছে।
দুই. ভুটানে সরকারি ছুটি অনেক বেশি, তাই সরকারি ছুটির লিস্ট দেখে ভ্রমণ প্লান করলে ভালো।
তিন. ভুটানে কোথাও কোনো মসজিদ ও মুসলিম রেস্টুরেন্ট আপনার চোখে পড়বে না। তবে ভুটানিজ ভাত, ডাল, সবজি খুবই মজার। তারপরও আপনার প্রয়োজন মনে হলে, বাংলাদেশ থেকেই কিছু, আচার, চাটনি, বিস্কুট নিয়ে যেতে পারেন।
চার. ভুটান শতভাগ ধূমপানমুক্ত দেশ। কিন্তু বার সবার জন্যই খোলা। কোথাও কোনো সিগারেট কিনতে পাবেন না, ধূমপানের অভ্যাস থাকলে সিগারেট সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। যাওয়ার পরে যেকোন বারে, হোটেলে অথবা পাহাড়ে ধূমপান করতে পারবেন। কিন্তু ধরা পড়লে কোনো কথা নেই, নগদ মোটা অঙ্কের জরিমানা দিতে হবে।
পাঁচ. প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র বাংলাদেশ থেকেই নিয়ে গেলে ভালো হয়।
গত পর্বের লিংক
সড়ক পথে মায়াবী ভূটান (পর্ব-১)
লেখক- ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, সারাবাংলা
সারাবাংলা/আরএফ