করোনাকালে শিশুদের দিনকাল।। পর্ব ২।। শিশু বিকাশে প্যারেন্টিং
৭ মে ২০২০ ১০:০০
শিশুর পরিপূর্ণ আচরণ বিকাশে প্রধান সহায়ক বাবা মায়ের ইতিবাচক মনোভাব ও তাদের যথাযথ আচরণের মিলিত প্রভাব। শিশুর প্রথম পরিবেশ তার ঘর। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের চাইতে বাবা-মায়ের সংশ্রব তাদের প্রভাবিত করে বেশি। শিশুর ভালোর জন্য অনেকসময় কঠিনভাবে ‘না’ করাই মঙ্গল। সে ক্ষেত্রে এই ‘না’ বিষয়টি ইতিবাচক। তাই বাবা-মায়ের ইতিবাচক সংশ্রব শিশুর আচরণ বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ছোট্ট শিশুর আচরণ বিকাশ
শিশু যত ছোটই হোক না কেন, তার সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলতে হবে। স্পর্শ করে, কথা বলে, আদর করে কথা বলুন। আপনি এখন কি করতে চাচ্ছেন তা তাকে মৃদু স্বরে বলুন। করতে করতে বলতে থাকুন যা এখন আপনি করছেন। বেশি কান্না, জেদের সময় নিরব থাকুন। পর্যবেক্ষণ করুন কী তার প্রয়োজন। থেমে গেলে, স্পর্শ করে চুমু দিন। কথা বলুন মৃদু ভাষায়, থেমে যাওয়ার জন্য প্রশংসা করুন, ভাল বলুন। দোল দিন। জড়িয়ে ধরে আদর করুন।
শিশুর খাবারের অভ্যাস
- মায়ের দুধ খাওয়ার সময় থেকেই একইভাবে তার সঙ্গে যোগাযোগ সমৃদ্ধ করবেন। শান্ত হয়ে বসে তাকে জানান এখন সে দুধ খেতে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে নিপল তার ঠোঁটে স্পর্শ করুন। কথা বলুন- খাওয়াতে শুরু করুন। তাকে স্পর্শ করুন শরীরে, মাথায় আদর করুন। এরপর কি হবে তাকে জানিয়ে রাখুন। যেমন, ঘুম থেকে উঠে যা যা হবে সে সম্মন্ধে তাকে বলুন।
- শিশু বসতে শিখলেই তাকে চেয়ারে বালিশ দিয়ে বা হাই চেয়ারে বা খাবার টেবিলে বসাতে শুরু করুন। মাঝেমধ্যে আপনার কোলে বসিয়ে ও আপনার থালার খাবার ধরতে দিন, নাড়তে দিন, খেতে দিন অল্প স্বল্প। খাবার বাইরে পড়ে গেলে বিরক্ত হবেন না। (বেশিরভাগ শিশুরা জানে না যে, বড়রাও খাবার খায়। তাদের খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হয়, রাতেও তাই, তাই অনুকরণের সুযোগ তারা পায় না)। এতে তাদের খাবার খাওয়ায় প্রকৃত শিক্ষাটি হয় না। খাবারে তাদের অনীহা তৈরি হয়। বড়দের কোন কোন খাবারে অনীহা থাকে, শিশুর সামনে তা কখনো প্রকাশ করবেন না। তাকে সব কিছু খেতে উৎসাহিত করবেন। নিজেরাও খেয়ে দেখাবেন, এমনকি সেদ্ধ করল্লাও দেখবেন সে খেতে আনন্দ পাচ্ছে বড়দের দেখাদেখি।
এভাবে শুরু করলে শিশুর খাবারের অনীহা কখনো হবে না বা খাবার মুখে ভার বিলম্বিত করবে না।
প্রাক স্কুল-স্কুলগামী শিশু
এদের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে মনে রাখার বিষয় এদের মানসিক বিকাশের শুরু থেকেই যেন ভালো অরিয়েন্টেশন বা দিক নির্দেশনা পায়।
- তাদের ছোট ছোট সক্ষমতা, দুর্বলতাগুলি লক্ষ্য করবেন, কিন্তু সামনে না বলে বিভিন্ন উপায়ে তা ওভারকাম করতে তাকে সাহায্য করবেন। ত্রুটিগুলি এড়িয়ে না গিয়ে তাকে শিশুবান্ধব মনোভাব নিয়ে তার মতো করে বুঝিয়ে বলবেন। যেমন, কোন শিশু স্কুল থেকে চক নিয়ে এসেছে এটা তার প্রয়োজন তাই। তাকে বুঝাতে হবে ‘এটা আমাদের নয়, তোমাকে আজ কিনে দেওয়া হবে। তুমি কাল ক্লাসে চকের বাক্স রেখে দিয়ে আসবে, এগুলো স্কুলের বোর্ডে টিচারের লেখার জন্য। আমরা খুব খুশি হবো তোমার এই সাহসী কাজের জন্য।’
আরও পড়ুন, করোনাকালে শিশুদের দিনকাল।।১ম পর্ব।।রুটিনমাফিক জীবন
শিশু যদি ভয় পায়
গল্প, কল্পনা, সৃজনশীলতা শিশুদের জন্য উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। তাই কখনো তারা অন্ধকার, কীটপতঙ্গ, ছায়া, কাল্পনিক ভূতের ভয় পায়। বিষয়টি গুরুত্ব পাবে আপনার কাছে, কিন্তু শিশুকে ‘বেশি বেশি ঢং এতে আবার ভয় পাবার কি আছে?’ এভাবে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ব্যবহার করবেন না। জানতে চাইতে হবে কবে, কীভাবে তার ভয়টি শুরু হয়েছিল। কে ভয় দেখিয়েছিল ইত্যাদি এক্সপ্লোর করবেন আপনি আর শিশু খেলার ছলে। সকলকে বলার প্রয়োজন নেই। আপনি বন্ধুসুলভভাবে বিষয়টি খুঁজে দেখুন ওকে নিয়ে। ডিসেন্সাটাইজ করার বিষয়টি ধীরে ধীরে হবে। তাড়াহুড়া করবেন না।
প্রাক বয়ঃসন্ধির শিশুর সঙ্গে আচরণ
শিশুর কৈশোর কাল। হঠাৎ করেই এসময় ছেলেমেয়েরা মনে হয় বড় হয়ে যায়। তাদের মধ্যে এসময় একটু স্বাবলম্বিতা, কিছু দায়িত্ব গ্রহণের ইচ্ছে হতে দেখা যায়। সামাজিক মেলামেশাতেও আগ্রহ থাকে। তবে কিছু অপ্রাসঙ্গিক ও অযাচিত অভিজ্ঞতা তার বিকাশে এনে দিতে পারে ভুল তথ্য। যা সে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে পারে নীরবে। কিশোর-কিশোরীদের তাই এসময় মানসিক বিকাশের যত্ন বিশেষভাবে প্রয়োজন। খোলামেলা বন্ধুসুলভ অভিভাবক কাছে থাকা প্রয়োজন। যে তাকে অপ্রসঙ্গ থেকে নিরাপদ থাকার কৌশল জানিয়ে দেবেন। এক্ষেত্রে স্কুল কারিকুলাম ও দক্ষ শিক্ষকের ভূমিকাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বয়ঃসন্ধির শিশুর সঙ্গে আচরণ
- বয়সটিকে প্রাপ্ত বয়সের শুরু বলা যায়। তাদের মধ্যে শারীরিক পরিবর্তনের সাথে মানসিক বিকাশ ঘটতে থাকে, আসতে থাকে নানা পরিবর্তন। ছেলেদের পরিবর্তনগুলোর জন্য বাবাকে বিশেষভাবে ভূমিকা রাখতে হবে। পাশাপাশি মেয়েদের জন্য সহমর্মী মা বা বড় বোন বিশেষভাবে ভূমিকা নিতে পারেন। এতে তাদের মনের ভার গুলি আর বোঝা হয়ে থাকবে না। স্বাভাবিক বিকাশের তথ্যগুলি বিজ্ঞানসম্মতভাবে গ্রহণ করতে পারলে সব দিক থেকেই ভালো হবে।
- লেখাপড়ায় প্রবল চাপ, খেলাধুলায় বাধা, সময়ের স্বল্পতায় এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিজ চর্চার খুবই সমস্যা দেখা দেয়। অভিভাবকদেরও প্রবল ব্যস্ততা থাকে। এই বয়সের সন্তানদের মধ্যে স্বাধীনতা ও নিয়ন্ত্রণের দ্বন্দ্ব থাকে অভিভাবকদের সঙ্গে। বন্ধুভাবাপন্ন মনোভাব দিয়ে তাদের একগুঁয়েমি ভারগুলিকে ধৈর্য দিয়ে ধীরে ধীরে বুঝিয়ে তুলতে সুযোগ দিতে হবে। কঠোর হওয়া যাবে না। পরিণত আবেগ বিকাশ হতে সময় ও বয়সের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা বাবা-মারা অপেক্ষা করবো তাদের পাশে থেকে সহায়ক বন্ধুর মতো।
ড. মনোয়ারা পারভীন – কনসালট্যান্ট সাইকোলজিস্ট, সাইকো সোশ্যাল কাউন্সিলর, সাবেক জেষ্ঠ্য মনোবিদ, ঢাকা শিশু হাসপাতাল