মধুর আমার মায়ের হাসি
১০ মে ২০২০ ১৭:৩৯
বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক বন্ধু, যার কঠিন সংগ্রাম করে বেড়ে ওঠার গল্প আমি জানতাম। বাবার প্যারালাইসিস, মায়ের হাড়ভাঙা খাটুনি, ছোট ভাই-বোনদের পড়াশুনা এমন নানা বিষয় নিয়ে সবসময়ই উদ্বিগ্ন থাকতে হতো ওকে। কিন্তু মায়ের কথা বলতে গেলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতো। সন্তান আর সংসার আগলে রাখার জন্য কী করেনি ওর মা! একদিন গল্প করতে গিয়ে হঠাৎ বন্ধুটি বললো, ‘জানিস, আমার মা কোনদিন পেট ভরে খেতে পায় না রে। লুকিয়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে যায়। দিনশেষে যা পায় তা আমাদের মুখে তুলে দেয়।’
একথা শোনার পর সেদিন আর কোনো কথা বলতে পারিনি। এই হলো আমাদের ‘মা’। পাতার পর পাতা লিখে গেলেও মা শব্দকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আমাদের কারও নেই। সন্তান মাত্রই জানে তার জীবনে মায়ের স্থান কত বিশাল।
পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ ও মধুর আশ্রয় স্থান এই মায়ের কাছে মনের সবকিছু উন্মোচন করা যায়। জীবনের সবচেয়ে গোপন কথাটি নিঃসঙ্কোচে কেবল তাকেই বলা যায়। নিজের রোগ-শোক, ব্যথা, গ্লানি, ব্যর্থতা, দৈন্যতা অকপটেই যার কাছে বলে ফেলা যায় তিনিই তো আমাদের মা। তাই তো, সবচেয়ে অসহায় ও বিপদের দিনে মানুষ তার মায়ের আঁচল খোঁজে।
অনেকেই বলেন, ‘মাকে ভালোবাসতে আবার কোনো দিবস লাগে নাকি? মা তো মা-ই।’ সত্যিই তো তাই। যিনি আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছেন তাকে ভালোবাসতে বা শ্রদ্ধা জানাতে কোনো দিবসের দরকার হয় না। তারপরও সকল মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় ‘মা দিবস’।
মা দিবসের প্রবক্তা বলা হয় আনা জার্ভিসকে। এই নারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর অঞ্চলে বাস করতেন। তার মা অ্যান মেরি রিভস জার্ভিস ছিলেন ভীষণ পরোপকারী। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন সারা জীবন। অনাথ শিশুদের দিতেন আশ্রয়। ১৯০৫ সালে আনা জার্ভিসের মা মারা যান। মাকে হারিয়ে আনা জার্ভিসের কেবল মনে হতে লাগলো সব মায়েদের সম্মান দেওয়া উচিত। প্রতিটি মা তার নিজের এবং পরের সন্তানদের জন্য যা করেন, সেই বিরাট মূল্য স্বীকৃত হওয়া দরকার। এরপর আনা জার্ভিস প্রচার-প্রচারণা শুরু করলেন। কাজটি বেশ কঠিন হলেও টানা সাত বছর তিনি এই প্রচারণা চালিয়ে গেলেন। অবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পায় মা দিবস।
আমাদের দেশে মে মাসের দ্বিতীয় রোববার পালিত হয় মা দিবস। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন তারিখে দিনটি পালন করা হয়। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় রোববার নরওয়ে, মার্চের চতুর্থ রোববার আয়ারল্যান্ড, নাইজেরিয়া ও যুক্তরাজ্যে মা দিবস পালন করে।
তবে দিবস কেবল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র, পৃথিবীর সকল মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার দিন। আমি মনে করি, মায়ের প্রতি সত্যিকার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা তখনই দেখানো যায় যখন মায়ের দায়িত্ব নেন সন্তানরা। তারা মায়ের ভালোলাগা, মন্দলাগা অনুভব করেন। মায়ের ভেতরের কথাটি বুঝতে পারেন। দায়িত্বের আরেক নামই তো ভালোবাসা।
দেশের মাটিতে বিশ্বমায়ের আঁচল গাঁথা থাকলেও আমরা কজন এর মূল্য বুঝি? রাস্তায় চলতে গেলে হরহামেশায় কানে আসে, একজন আরেকজনের মাকে গালি দিচ্ছে। যিনি সত্যিই তার মাকে ভালোবাসেন তিনি কি অন্যের মাকে এভাবে গালি দিতে পারেন? মা তো কখনো নিজের সন্তান আর পরের সন্তানে পার্থক্য করেন না। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, আমার বন্ধুদের ঠিক ‘সন্তানের’ মতো ভালোবাসে আমার মা। তাদের খোঁজ-খবর নেয়। শুধু আমার মা কেন, সব মা-ই এমন। পরের সন্তানের জন্যও তাদের মন আর্দ্র হয়ে ওঠে।
এ প্রসঙ্গে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের কথা অনেকেরই মনে পড়ে যেতে পারে। জাহানারা ইমাম যুদ্ধে হারিয়েছিলেন স্বামী ও সন্তানকে, কিন্তু হারাননি মাতৃত্ববোধ। তিনি কেবল রুমির মা ছিলেন না। ছিলেন অনেক মুক্তিযোদ্ধার আশ্রয়দাতা। মানুষের প্রতি এই নৈর্ব্যত্তিক ভালোবাসার কারণেই তিনি হয়ে ওঠেন ‘শহীদ জননী জাহানারা ইমাম’।
সন্তানের জীবনে বটগাছের মতোই ছায়া হয়ে থাকেন বাবা-মা। তবে বাবা অনেকসময় সন্তানের না বলা কথাটি বুঝতে পারেন না। সেই জায়গায় কিন্তু মায়েরা বিজয়ী। দশ মাস গর্ভে ধারণ করা সন্তানের চোখের দিকে তাকালেই মা বুঝে ফেলেন তার মনের কথা। এজন্য মায়ের কাছে কোনোকিছু লুকানোর চেষ্টা শুধু কঠিন না, অসম্ভবও বটে!
অথচ এই মায়ের প্রতি অবিচার হয় নানাভাবেই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হয় আমাদের মাকে। সামাজিক, পারিবারিক কী অর্থনৈতিক সবক্ষেত্রে বঞ্চিত হয় নারীরাই। সংসারে সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেও উপযুক্ত সম্মান না পাওয়া, কর্মক্ষেত্রে বেতন বা মজুরি বৈষম্য, সামাজিকভাবে অপমানিত হওয়া, স্বামী দ্বারা নির্যাতনের শিকার এমন অসংখ্য অমানবিক ঘটনার শিকার হয় নারীরা। এই নারীরা কারও না কারও মা। নারীর প্রতি যথার্থ সম্মান না থাকলে পৃথিবীর সকল মাকেই অসম্মান করা হয়।
আজ সকাল থেকে বারবার মনে পড়ছে শহীদ আজাদের মা সাফিয়া বেগমের কথা। ক্র্যাক প্লাটুনের একজন গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন আজাদ। যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাকিস্তানীদের হাতে ধরা পড়ে যান তিনি। সাফিয়া বেগম ছুটে যান ছেলেকে দেখতে। ছেলের ওপর অমানবিক নির্যাতন দেখে মুষড়ে পড়েন। আজাদ তখন বলেছিল, ‘মা, দুদিন হলো ভাত খাইনি।’ সাফিয়া বেগম পরদিনই ছেলের জন্য ভাত নিয়ে ক্যাম্পে যান। কিন্তু ততক্ষণে পাকিস্তানীরা আজাদকে মেরে ফেলে। তারপর সাফিয়া বেগম যে ক’বছর বেঁচে ছিলেন আর কখনো ভাত খাননি। অ্যাজমা থাকা সত্ত্বেও মাটিতে মাদুর পেতে ঘুমাতেন। কারণ আজাদ পাকিস্তানীদের ক্যাম্পে মাদুরে ঘুমাতো।
সন্তানের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেন যে মা, তাকে ভালোবাসা কী এতই কঠিন? পৃথিবীর সব মা ভালো থাকুক। সকল মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা।