Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এলো ঈদ, এই করুণ করোনাকালে


২৫ মে ২০২০ ১০:০০

আলোয় ভেসে যাওয়া এই দিনগুলোতেও যেন বিষণ্ণতার মেঘ ঘিরে আছে আমাদের। ভয়ংকর কালো এই করুণ করোনাকাল। বাতাসে ভেসে আসা অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ যেন বয়ে নিয়ে আসে আগরবাতির গন্ধ। সারা পৃথিবী যখন মানুষের জন্য মৃত্যু অববাহিকা, সেই সময়েই এলো ঈদ। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। হাসি, আনন্দ আর উদযাপনের বার্তা নিয়ে আসে ঈদ। কিন্তু এবার? রোগশোক আর মৃত্যুর রঙে ধূসর এই পৃথিবীতে খুশির ঈদের যেন কোন রঙ নেই।

বিজ্ঞাপন

কথা হল কিছু পেশাজীবীর সঙ্গে। কেউ চিকিৎসক, কেউ সাংবাদিক, কেউ শিল্পী, কেউ ব্যাংকার আর কেউ উন্নয়নকর্মী। করোনাকালের এই ঈদের আগমনে কেমন বোধ করছেন তাঁরা। জীবন আর মৃত্যুর এই ধূসর উপত্যকায় এই মুহুর্তে জীবন নিয়ে তাদের অনুভুতিই বা কেমন।

দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্য বিটে কাজ করছেন জাকিয়া আহমেদ। এখন কর্মরত আছেন বাংলা ট্রিবিউনে। বলছিলেন, ‘ঈদ নিয়ে কোন ভাবনাই নাই। ভাবার মত পরিস্থিতিও নাই।’ কীভাবে থাকে? গত আড়াইটা মাস জুড়ে যে প্রতিদিন আক্রান্ত আর মৃত্যুর সংখ্যা গণনা করে চলেছেন। অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। তাই ঈদ নিয়ে কোন উচ্ছ্বাস বা উল্লাস কিছুই নাই। জাকিয়া শুধু চান, সবাই বেঁচে থাকুক। সুস্থ থাকুক তাঁর পরিবার পরিজন।

কথা হচ্ছিলো একজন চিকিৎসকের সঙ্গে। তিনি রাজধানীর একটি সরকারি হাসপাতালে করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত আছেন। তার পরিবারে দুজন করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। একজন তাঁর চিকিৎসক স্বামী এবং অন্যজন স্তন ক্যানসার আক্রান্ত তাঁর শাশুড়ি। কী ভয়ানক মানসিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে তিনি যাচ্ছেন তার কূলকিনারা করা আমদের পক্ষে হয়ত কোনভাবেই সম্ভব না। ডা. মেহেরুন্নিসা (ছদ্মনাম) বলছিলেন, ‘অনুভূতিগুলো ভীষণ কষ্টের, ভীষণ উদ্বেগের।’

স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চিকিৎসক হওয়ায় করোনার শুরু থেকেই বাড়িতে সবসময়ই বাড়তি সতর্কতা ছিলো। এদিকে তাঁর শাশুড়ি ক্যানসারের পাশাপাশি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হাঁপানির রোগী। তিনি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে থাকায় তার স্বামীই মায়ের চিকিৎসা করছিলেন। ডা. মেহেরুন্নিসা তাই আলাদা রুমে আইসোলেশনে থাকা শুরু করেন। একমাত্র ছেলেকেও কাছে টানার উপায় ছিল না। কিন্তু তবু শেষ রক্ষা হল না। বাড়িতে দুজন কোভিড-১৯ রোগী থাকায় তাদের আইসোলেশনে রাখার জন্য আইসোলেশন ভেঙে বাড়িয়ে আসতে বাধ্য হতে হয় তাঁকে। ছেলের সঙ্গে দূরত্ব রেখে একই রুমে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। আট সদস্যের পরিবারে যেন দুর্যোগ নেমে এসেছে। রোজা রেখেই দিনরাত তাঁর শাশুড়িকে বাঁচানোর যুদ্ধ। এদিকে একই ঘরে আইসোলেশনে থাকা তার স্বামী নিজের পরিচর্যা করলেও সারক্ষণ আতঙ্কে থাকেন মেহেরুন্নিসা। একবার ফোন না ধরলেই আতঙ্ক কাজ করে মনে। এরই মধ্যে পরিবারের রান্না সহকারীর ছেলেরও লক্ষণ দেখা দেওয়ায় তাকেও আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা দেওয়া শুরু হ। তিনজনের বারবার খবর নেওয়া, খাবার আর ওষুধ পাঠানো, নিজের হাতে শাশুড়ির স্যালাইন, ইঞ্জেকশন, অক্সিজেন- এভাবে সাতদিন যাওয়ার পর আর যেন পারছিলেন না। সর্বদা ভয়, হেরে যাচ্ছেন না তো!

বিজ্ঞাপন

একসময় শাশুড়িকে আইসিইউতে শিফট করতেই হলো। সেখানে এখন চলছে অন্য আরেক যুদ্ধ। তবে তাঁর শাশুড়ি এখনও সাহসের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছেন আজ চৌদ্দ দিন ধরে। প্রতিদিন উদ্বিগ্ন হয়ে ভাবেন, আজ কি একটু ভালো খবর আসবে? এরই মধ্যে অবিরাম আসছে পরিচিতজন, নিকটাত্মীয় আর প্রিয়জনের মৃত্যুর খবর। এতকিছুর মধ্যে ঈদ নিয়ে আলাদা করে ভাবার অবকাশ নাই চিকিৎসক মেহেরুন্নিসার। একনাত্র ছেলে এবারই প্রথম সবগুলো রোজা রেখেছে। কিন্তু তার জন্য বিশেষ ইফতার, সেহরি কী ঈদ ট্রিটের ব্যবস্থাও করতে পারবেন না। এই দুঃসময়ে সবাই বেঁচে আছেন, পরিবারের বাকিরা সুস্থ আছেন, নিয়মিত খাবার জুটছে এতেই স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।

এর মধ্যেই আত্মীয়, বন্ধু সকলেই সর্বোচ্চ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তার হাসপাতালের বস, সিনিয়র ও জুনিয়র কলিগ সকলেই নিয়মিত সবধরণের সহযোগিতা করে যাচ্ছেন- সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।

এই যে মানুষ করোনা সংক্রমণের ভয় উপেক্ষা করেই ভিড় করে গ্রামে যাচ্ছে ঈদ করতে, শপিংয়ের জন্য ভিড় করছেন এসব দেখে খুব হতাশ লাগে জাকিয়ার। মানুষ এতো অসাবধান, যেন জীবনের কোন মায়াই নাই। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে তিনি বুঝতে পারছেন এর ফলে কী ভয়ানক ভবিষ্যতের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমরা। কিন্তু কিছুই যেন করার নাই।

সারাবাংলা ডট নেটের শিল্প সম্পাদক আবু হাসানের বাড়ি চট্টগ্রাম।  বাড়িতে মা আছেন। সারাবছর না পারলেও প্রতিবছর ঈদে বাড়ি যাবেনই। তবে এবার করোনার জন্য যাচ্ছেন না। সেই মার্চের বিশ তারিখ থেকেই হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন। ঘরে বসেই করছেন অফিস। বছর ঘুরে আবারও এলো ঈদ। কেমন লাগছে? আবু হাসান বলছিলেন, ‘খুবই খারাপ। আমি ঢাকা এসেছি ২০০৪ সালে। ২০১৯ পর্যন্ত একবারও মা কে ছাড়া ঈদ করি নি। এবং আমার ঈদে বাড়ি যাবার অন্যতম কারণ বাবার করব জেয়ারত। সেটাও এ বছর হবে না’

নিজের ও পরিবারের সচেতনতার জন্য কিছ মানুষ যখন ব্যক্তিগত আবেগ ও অনুভুতিকে কবর দিয়ে নিজেদের আটকে রেখেছেন ঘরে। অন্যদিকে গণপরিবহণ বন্ধ থাকা সত্ত্বেও প্রতিদিনই দেখছি হাজার হাজার মানুষ ছুটছেন গ্রামের দিকে। গায়ে গা লাগিয়ে ট্রাকের পেছনে, ভ্যানে, ইজিবাইকে বা প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে ছুটছেন তাঁরা। ট্রলারে, নৌকায় ঝুঁকি নিয়ে পার হচ্ছেন পদ্মার মতো নদী। মারাও যাচ্ছেন অনেকে সড়ক দুর্ঘটনায়। ঈদ উদযাপনের এতটাই ‘মাহাত্ম্য’ যে করোনায় মৃত্যু, দুর্ঘটনায় মৃত্যু সব ফিকে হয়ে গেছে। ঢাকা থেকে বা পথিমধ্যে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা নিয়েই বাড়ি ছুটছেন অনেকেই।

তবে অনেকেই নিজেকে ধরে রেখেছেন। এমনই একজন উন্নয়নকর্মী জিমি আমির। বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক-বিডিওএসএনের প্রোজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত আছেন। এর আগে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত ছিলেন সাংবাদিকতায়। বাবা-মা আছেন বগুড়ার বাড়িতে আর একমাত্র ছোটবোন কক্সবাজারে কর্মরত। করোনার কারণে দীর্ঘদিন হল বাড়ি যান না জিমি। এর মধ্যেই এলো ঈদ। কেমন লাগছে তাঁর।

জিমি বলছিলেন, ‘২০০৮ সাল থেকে টেলিভিশনে কাজ করতে গিয়ে যেকন এক ঈদে বাধ্যতামূলক অফিস করেছি। তাই এক ঈদে বাড়িতে না থাকাটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে আমার এবং বাসার সবার। আর আমি না থাকলেও এতদিন ছোটবোন সেটা কাভার করতো। কিন্তু এবার তো সব এলোমেলো। ছোটবোন কক্সবাজার রয়ে গেছে। ঢাকায় করোনা সংক্রমণ বেশি হওয়ায় ওদেরকে আসতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে ওদের অফিস থেকে। আবার পাবলিক ট্রান্সপোর্টের মাধ্যমেও সংক্রমণ হওয়ার ভয় থেকে আমরাও আসতে না করেছি। তাই, জীবনে প্রথমবারের মতো অচেনা জায়গায় কাউকে ছাড়া ওকে ঈদ করতে হবে। এদিকে, ঢাকায় ওর হাজবেন্ড রয়ে গেছে। সেও যেতে পারেনি ঠিক একই কারণে। কারণ, কেউ কারো কাছে গেলেই পরীক্ষা, কোয়ারেন্টাইনে থাকার ঝক্কি তো রয়েছেই।’

এদিকে জিমি নিজে বছরে দুই বা তিনবার বাড়ি যান। তার বড় কারণ বাবা-মার সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন সময় কাটানো বা গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সেরে ফেলা। করোনার শুরুতে কথা ছিল তিনি বাড়ি না গেলে তার আম্মা ঢাকায় আসবে। কিন্তু ভয় থেকে সবই বাদ দিতে হয়েছে। তিনি বলছিলেন, ‘নিরিবিলি পছন্দ করা এই আমার এখন নিজেকেই অসহ্য লাগে। ঘরের চার দেয়াল যেন মাঝে মাঝে পিষে মারতে চায়। ছোটবোনটার জন্য আব্বা আজ কাঁদছিল, ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছি। আমি কান্না দেখাবো কাকে?’

এদিকে আবু হাসান ও জিমি আমিরের মতো অনেকেই যারা নিজের ও কাছের লোকদের করোনা সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে গৃহবন্দী আছেন, তাদের দীর্ঘশ্বাসে ঢাকার বাতাস এতটাই ভারী যে ধূসরতা যেন গভীর করে চেপে বসে। আর কয়টাদিন এভাবে নিয়ন্ত্রণে থাকলেও হয়তো আমরাও নিউজিল্যান্ডের মত করোনামুক্ত দেশ হতে পারতাম। কিন্তু সাধারণ মানুষের যেন হুঁশ নাই। আমরা যেন মেতেছি মরণের নেশায়। সরকার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ঠিক রাখতে সীমিত পরিসরে দোকানপাট খুলে দেওয়ায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছি ঈদের কেনাকাটায়। টেলিভিশনের পর্দায় অধিকাংশের মুখে শুনবেন, বাড়ির ছোটদের জন্য কিনতে এসেছি। আপনার শিশুকে যদি করোনার ভয়াবহতা না শেখাতে পারেন সেই ব্যর্থতা আপনার। এই ঈদটা কোনমতে বেঁচে গেলে আগামী ঈদে অনেক আনন্দ করা যাবে- এই শিক্ষাটা আপনাকেই দিতে হবে। মানুষের এসব আচরণের হতাশা জাগছে সচেতন মহলে।

জিমি আমিরের প্রশ্ন, ‘নিজেসহ অন্যদের কথা চিন্তা করে যারা এভাবে নিজেদের বঞ্চিত করলাম তাতে কি লাভ হল? কত মানুষ রয়ে গেল জানা, বোঝা বা সচেতনতার বাইরে। অথচ তাদের কারণেই সচেতন হয়েও দৈনন্দিন জরুরী কাজে বের হতে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছি আমরাই। আমাদের এসব স্যাক্রিফাইসের মূল্য কেউ দিতে পারবে?’

বাতাস ভারী হয়ে আসে এসব প্রশ্নে। উত্তর জানা নাই।

করোনাকালে ঈদ যথারীতি এসেছে ব্যাংকার মেহনাজ কামালের বাড়িতে। বলছিলেন ‘এমন ঈদ কখনও আসবে চিন্তাই করিনি। ঈদ মানে যে আনন্দ, খুশি তা এইবার অনূভুত হচ্ছে না। বাচ্চারা বাবার সঙ্গে ঈদের নামাজে যাবে না। ঈদের সময় আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা হবে না এটা ভাবতেই খারাপ লাগছে। কেউ যেহেতু আসবে না তাই এবার ঘরবাড়ি গোছানোর বা বাড়তি রান্নারও আয়োজন নাই। সবার মনের মধ্যে কেমন জানি এক শূন্যতা।’

মেহনাজ কামালের পরিবারের সদস্যরা বাড়তেই ঈদের নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এদিকে গত দুই মাস ধরে ঘরেই কাজ করছেন তিনি। এর একটা ভালো দিক নিয়ে বলছিলেন তার ছেলে বুঝতে পারছে মা অফিসে কি পরিমাণ কাজ করে এবং কতটা ব্যস্ত থাকে। তাকে ভালো রাখতে তার মা কতটা পরিশ্রম করে। মায়ের এই পরিশ্রম দেখে সে মায়ের প্রতি অনেকটা সহানুভূতিশীল হয়েছে। তবে করোনার এই সময়ে মাকে কাছে পেয়ে সে খুবই আনন্দিত।

এরকম ছোটখাটো দুঃখ বেদনা ঘিরেই এলো ঈদ। যার ঘরে অসুস্থ রোগী তিনি জানেন কতটা ভয়ানক অস্থিরতায় কাটছে দিন। যাকে প্রতিনিয়ত মৃতের সংখ্যা গুণতে হয়, তিনি জানেন অনুভূতিশূন্য হওয়ার চেষ্টা করা কতটা বিষাদের। কতটা চেষ্টা করছেন মানুষ নিজেকে ও পরিবারের সদস্যদের নিরাপদে রাখতে। সাংবাদিক জাকিয়া আহমেদ বলছিলেন, ‘বাইরে তাকালে স্থির আকাশ দেখে মন খারাপ হয়। সব শূণ্য মনে হয়। তবু চেষ্টা করি নিজেকে ভালো রাখতে।’

খুব দ্রুতই কেটে যাক এই শূন্যতা। সবাই ঘরে থাকি, নিরাপদে রাখি। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।

ঈদ ঈদ ২০২০ করোনাকাল করোনাকালে ঈদ ধূসর করোনাকাল

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

ইনজুরিতে মৌসুম শেষ রদ্রির
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১০:২৮

সম্পর্কিত খবর