পৃথিবীটা যতটা মানুষের, ঠিক ততটাই আর সকল প্রাণীরও
১০ জুন ২০২০ ২৩:৫৫
দৃশ্যপট-১
নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বাজিতপুর গ্রামে বটতলা বাজারের পাশে তিনটা শিমুল গাছের ডালে দুইশর বেশি শামুকখোল পাখি ৩ মাস ধরে বাসা বেঁধে আশ্রয় নিয়েছিল। সারাদিন চারপাশের বিলে খাবারের সন্ধানে ঘুরত, রাতে গাছে এসে আশ্রয় নিত। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের বাতাসের তীব্রতায় আজ ভোরে পাখিগুলো মাটিতে পড়ে যায়। পাখিগুলো নীচে পড়ে যাওয়ার পর কিছু মানুষ এই প্রবল ঝড়ের মধ্যেও পাখিগুলোকে ধরে নিয়ে গেছে। তারপর কেটেকুটে চুলায় রান্না বসিয়ে দিয়েছে। সারাদেশে প্রবল দুর্যোগের মধ্যে তাদের গ্রামে আশ্রয় নেওয়া কিছু অতিথি প্রচণ্ড ঝড়ে অসহায় হয়ে পড়ার সুযোগে তারা অতিথি সৎকার করেছে তাদের কেটেকুটে রান্না করে মজা করে খেয়ে ফেলে। আব্দুল কাদের নামে এক পাখিপ্রেমী তরুণ এতদিন গ্রামবাসীকে বুঝিয়ে পাখিগুলোকে রক্ষা করে আসছিলেন। কিন্তু ঝড়ের সময় সবাই যখন নিজেদের জানমাল বাঁচাতে ব্যস্ত, তখন আর পাখিগুলোকে রক্ষা করা গেল না। আব্দুল কাদের দৌড়ে এসে গাছের নীচে পাখিদের আর পাননি। পরে দেখেন ইতিমধ্যে কেটেকুটে পাখির মাংস রান্নায় চড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
দৃশ্যপট-২
শাকিল খান তানজিদ নামে এক তরুণ শখের বশে কবুতর পালতেন। গতকাল রাতে কেউ মাদি কবুতরগুলো গলা কেটে জবাই করে নিয়ে গেছে। সঙ্গে চার জোড়া বাচ্চাও শেষ করেছে। তিন জোড়া ডিম নষ্ট করে গেছে। প্রচণ্ড শোকে বাকরুদ্ধ হয়ে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবিটা পোস্ট করে লিখেছেন, বুকে ছুরি মারলেও এতটা কষ্ট তিনি পেতেন না।
দৃশ্যপট-৩
চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে কাথরিয়া ইউনিয়নের বাগমারা গ্রামের খালের পাশে একটি মেছোবাঘ চলে এসেছিল। রীতিমত গ্রামের সকলে একজোট হয়ে ধাওয়া করে পিটিয়ে মেরেই ক্ষান্ত হয়নি, নিরীহ মেছোবাঘটির মৃতদেহ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল গাছের ডালে। এরপর কাঁধে তুলে পুরো গ্রাম চক্কর দিয়ে উল্লাস করেছে গ্রামবাসী কিছু তরুণ। ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে প্রচার করেছে বাঘটা মেরে তাদের বীরত্বের গল্প।
দৃশ্যপট-৪
বরগুনার তালতলী উপজেলার কামরুজ্জামান ফারুক নামে এক তরুণ আশ্রয় নেওয়া একটা মা মাছরাঙ্গা পাখিকে তার বাসা থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। বেশ কয়েকবার তাড়িয়ে দেওয়ার পরেও মা পাখিটি বারবার ফিরে এসেছিল, কারণ তার বাসায় বেশ কিছু ডিম ছিল। বিরক্ত হয়ে ফারুক মাছরাঙ্গা পাখিটির বাসায় তার ভাষায় ‘রেড’ দিয়েছেন। মা পাখিটির মাথা ছিঁড়ে আলাদা করে তার অনাগত সন্তানের (ডিম) পাশে রেখে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে জানিয়েছেন মানুষ হিসেবে অর্জন করা আরও একটি প্রবল বীরত্বের গল্প।
উপরের চারটা ঘটনা আমাদের দেশে গত কয়েক সপ্তাহে ঘটে যাওয়া প্রাণীদের উপর বর্বরতা ও নির্যাতনের সামান্য কয়েকটি নমুনা। এর বাইরে প্রতিমুহূর্তেই ঘটছে নানা অত্যাচার-নির্যাতনের ঘটনা। বন্যপ্রাণী পিটিয়ে মেরে উল্লাস করা থেকে শুরু করে বন্য ও অতিথি পাখি ধরে কেটেকুটে রান্না করে খেয়ে ফেলার এই ঘটনাগুলো আসলে একেবারেই সাধারণ। কয়েক দিন আগে ভারতের কেরালায় এক মা হাতিকে আনারসে ফায়ারক্র্যাকার ভরে খাইয়ে অবর্ণনীয় যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু উপহার দেওয়ার ঘটনা টাটকা। মুশকিল হচ্ছে ভিনদেশী পাশবিকতার নানা ঘটনা নিয়ে আমরা যতটা উচ্চকণ্ঠ, স্বদেশে পশু-পাখি নির্বিশেষে যে কোনও প্রাণীর প্রতি নির্মমতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সচেতনতা তৈরিতে ঠিক ততটাই নীরব।
অবশ্য এর পেছনে কারণটা আরও গভীর। ছোটবেলা থেকেই আমরা পরিবার ও চারপাশের সমাজ থেকে যতটা না পশু-পাখির সঙ্গে সহাবস্থানের শিক্ষা পাই, তারচেয়েও অনেক বেশি নির্মমতা ও অমানবিক আচরণ দেখি। গ্রামাঞ্চলে সাপ দেখামাত্রই মেরে ফেলা নিয়ম। অথচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মারা পড়ে নির্বিষ সাপের প্রজাতি। এই কয়েক বছর আগেও দেদারসে অতিথি পাখি শিকার ছিল উৎসবের মত। লোকালয়ে চলে আসা মেছোবাঘ, বনবিড়াল, শেয়াল ইত্যাদি নানা প্রাণী পিটিয়ে মেরে ফেলা এখনো খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। যশোরের কেশবপুরে হনুমানের লেজ কেটে দেওয়া বা কয়েক সপ্তাহ আগে বিষ মেশানো খাবার খাইয়ে এক দল বানরকে মেরে ফেলার ঘটনা ঘটেছে আমাদের দেশে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব প্রাণীহত্যার যে অজুহাত দেওয়া হয় সেটা হচ্ছে তারা লোকালয়ে এসে হাঁস-মুরগী ধরে নিয়ে যায়, ফসল বা ফলমূল নষ্ট করে, বাড়ি-ঘরে হামলা করে ইত্যাদি। কিন্তু যে কারণটা আড়ালে চলে যায় তা হচ্ছে, প্রাণীগুলো লোকালয়ে চলে আসছে, আমরা তাদের আবাসস্থল নষ্ট করেছি, বনজঙ্গল উজাড় করে, নদনদী ভরাট করে এবং পাহাড় কেটে তাদের বসবাসের পরিবেশ এবং খাবারের উৎস ধ্বংস করেছি। ফলে তারা খাবারের সন্ধানে আশ্রয়ের খোঁজে চলে আসছে লোকালয়ে। অনেকক্ষেত্রে সরল বিশ্বাসে ভাবছে যে আমরা তাদের খাবার দেব, আশ্রয় দেব, অথচ আমরা তার বদলে সম্ভাব্য অমানবিক উপায়ে অত্যাচার করছি তাদের। মেরে ফেলছি অবলীলায়।
শহরাঞ্চলে পথের কুকুর-বেড়ালের উপর অকারণে অত্যাচার ও নির্মমতা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খাবারের খুঁজে আসা বা ঘুরে বেড়ানো কুকুর বা বেড়ালের গায়ে বিনা কারণে ভাতের গরম মাড় ফেলা, ইট ছুঁড়ে রক্তাক্ত করা, লাঠি দিয়ে পেটানো, হাত-পা ভেঙ্গে দেওয়া ইত্যাদি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কয়েক মাস আগে তো এক তরুণী একটা বিড়ালকে কয়েক টুকরো করে সেটার ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়াও আপলোডের মত ঘটনাও ঘটিয়েছেন। গত বছর ঢাকার এক আবাসিক এলাকার এক সিকিউরিটি গার্ড মা কুকুর এবং তার কয়েকটি বাচ্চাকে মেরে মাটিতে পুঁতে রেখেছিলেন। পরবর্তীতে এই ঘটনা প্রকাশ্যে এলে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। মা কুকুর এবং বাচ্চাগুলোর কোনও দোষ ছিল না। এসব বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা চোখে দেখা যায় না, অথচ কী অবলীলায় মানুষ এই কাজগুলো করে যাচ্ছে দিনের পর দিন কোন বিকারবোধ ছাড়াই।
লেখার শুরুতে সেই মাছরাঙ্গা পাখি হত্যার ঘটনার কথা খেয়াল আছে? ইতিমধ্যে বরগুনার সেই মা মাছরাঙ্গা পাখিটির হত্যাকারী কামরুজ্জামান ফারুকের বিরুদ্ধে মঙ্গলবার (৯ জুন) সন্ধ্যায় বন্যপ্রাণী সুরক্ষা আইনে তালতলী থানায় মামলা করেছেন পাখিপ্রেমিক সাগর কর্মকার। এ ঘটনায় ফারুকের নিজের দল ছাত্রদল থেকেও তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ বিষয়ে তালতলী থানার ওসি কামরুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘পাখি হত্যার বিষয় তদন্ত এবং তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে’। আমরা এই নৃশংস হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই যেন আর কেউ এই অমানবিক ঘটাবার সাহস না পায়।
ফেসবুকে আজ একটা ভিডিও দেখছিলাম যেখানে একটা হনুমান এক বাড়িতে এসেছে। বাড়ির কর্ত্রী যত্ন করে ভাত বেড়ে খাওয়াচ্ছেন হনুমানটিকে। ঘটনাটি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের সাঁইথিয়ায়, চন্দ দাস নামের এক ভদ্রলোক তার মায়ের হাতে এই হনুমানটির আপ্যায়নের মুহূর্তটা ভিডিও করে ফেসবুকে আপলোড করেছেন। এই আন্তরিকতা আর ভালোবাসামাখা পুরো ব্যাপারটা এতো সুন্দর যে মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখছিলাম ভিডিওটি। হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেল আমাদের যশোরের কেশবপুরে হনুমানের লেজ কেটে নেওয়ার ঘটনাটি। ক’দিন আগে বিষ প্রয়োগে এক পাল বানর মেরে ফেলার ঘটনাটিও।
ভাবতে গিয়ে মনে হলো সবচেয়ে ভালো হয় বোধহয় বন্যপ্রাণী বা আমাদের চারপাশের পশু-পাখিদের ওদের মত থাকতে দিলে। বন ধ্বংস করে ওদের আবাসস্থল আর বিচরণক্ষেত্র নষ্ট না করে আমরা যদি ওদের স্বাভাবিক খাদ্য প্রাপ্তি এবং প্রজননসহ জীবনধারণের মৌলিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারতাম, তবে হয়তো ক্ষুধার জ্বালায় ওদের লোকালয়ে খাবারের খুঁজে ছুটে আসতে হত না। আর আমাদের নৃশংসতার শিকারও হতে হত না।
চারপাশের পশু-পাখিদের বাঁচতে দিন। তাদের নিয়েই বাঁচুন। নৃশংসতা নয়, ভালোবাসুন। পথের কুকুর-বেড়ালগুলোর গায়ে গরম মাড় বা পানি না ঢেলে রাস্তার পাশে তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিন। গর্ভবতী হয়ে পড়লে ছোট ঘর বানিয়ে দিন যেন মা নিরাপদে প্রসব করতে পারে। এলাকার কুকুর-বেড়ালগুলোর খাওয়াবার দায়িত্ব নিন, একেক দিন একেক বাড়ি থেকে খাবারের ব্যবস্থা করুন যেন তাদের না খেয়ে থাকতে না হয়।
অসুখ হলে বা কোনভাবে আহত হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। বন্যপ্রাণীরা খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে চলে এলে তাদের উপর চড়াও না হয়ে বনবিভাগের স্থানীয় অফিসারদের খবর দিন যেন তারা প্রাণীটাকে নিরাপদে নিয়ে যেতে পারে। প্রাণীদের উপর যেমন কোনো অত্যাচার নির্যাতন করবেন না, তেমনি কাউকে করতে দেখলে তাৎক্ষনিক প্রতিবাদ করুন, মামলা করুন প্রাণী কল্যাণ ও বন্যপ্রাণী সুরক্ষা আইনে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে সক্রিয় ভূমিকা নিন যেন নির্যাতকের দল আরেকটি প্রাণীকে নির্যাতন করবার আগে দুই বার ভাবে। প্রাণীদের অধিকার রক্ষায় এবং তাদের নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করতে মানুষকে সচেতন করার কোন বিকল্প নেই। এই বাতাসে, পানিতে, মাটিতে সর্বত্র আপনার যতটুকু অধিকার, প্রত্যেকটা প্রাণীরও ঠিক ততটুকু অধিকার। কথাটা মনে রাখলেই আমরা টের পাবো প্রকৃতির সন্তানদের সঙ্গে ভালোবাসাময় সহাবস্থানে বেঁচে থাকার চেয়ে আনন্দময় আর অর্থপূর্ণ আর কিছু হতে পারে না।
লেখক: অ্যাক্টিভিস্ট