ঝিনাইদহের ‘ঢোল সমুদ্র’: যে দীঘিতে জল আনতে হারিয়ে যান রানি
২৩ জুলাই ২০২০ ১১:০০
রাজ্যজুড়ে প্রবল জলকষ্ট দেখা দিল একবার। খাল-বিল, বাওড় সব শুকিয়ে সারা। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন জনহিতৈষী রাজা। কীভাবে রক্ষা করবেন প্রিয় প্রজাদের। সিদ্ধান্ত নেন বিরাট আর গভীর এক দীঘি খননের। নিয়োগ দেওয়া হয় শত শত শ্রমিক। চলে রাত-দিন এক করে খোঁড়াখুঁড়ি। কয়েকদিনের পরিশ্রমের পর সুগভীর আর চারদিকে প্রশস্ত এক দীঘি খনন করা হয়। কিন্তু গভীর হলেও পানি ওঠে না সেই দীঘি থেকে। হতাশ হয়ে যান রাজা। বেড়ে যায় দুশ্চিন্তা। তবে কি জলকষ্ট থেকে রক্ষা করতে পারবেন না প্রজাদের। এমন সময়ে স্বপ্ন দেখেন, রানি যদি পুকুরের তলদেশে নেমে পূজা দেন, তবেই উঠবে জল।
স্বপ্নের কথা জেনে পরদিন সকাল হতেই পূজার সামগ্রি নিয়ে দীঘির পাড়ে যান রানি। প্রজাকল্যানের জন্য এতটুকু করতে পারবেন না! নেমে গেলেন দীঘির তলদেশে। উপাচার সাজিয়ে বসে পড়েন ইস্ট দেবতার পূজায়। পূজা শুরু হতেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে দীঘিতে জল উঠতে শুরু করে। তবে পূজা শেষ না করে রানি ওঠেননি। পূজা শেষ হতেই উঠতে শুরু করেন। কিন্তু সহসাই প্রবল বেগে জল আসতে থাকে।
এদিকে দীঘিতে জল দেখে পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রজারা বাদ্যি-বাজনা নিয়ে মেতে ওঠে আনন্দে। কেউ লক্ষ্যই করেনি, রানি উপরে উঠতে পেরেছিলেন কিনা। সবার অলক্ষ্যে তীব্র স্রোতে জলের গভীরে হারিয়ে যান রানি। দুঃসংবাদ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই দীঘির পাড়ে উপস্থিত হন রাজা। রানিকে খোঁজার জন্য দীঘিতে লোক নামান। কিন্তু না, খুঁজে পাওয়া যায়নি তাকে। জলের কষ্ট লাঘব হলেও রাজ্যে নেমে আসে শোকের ছায়া। রূপকথাকেও হার মানানো এই লোককথা যে দীঘিকে ঘিরে তার নাম, ‘ঢোল সমুদ্র’। দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জেলা ঝিনাইদহে অবস্থিত এই দীঘি। আর যে রাজার কথা বলা হচ্ছে তিনি ঝিনাইদহের তৎকালীন জমিদার রাজা মুকুট রায়।
মুকুট রায় ছিলেন প্রতিপত্তিশালী জমিদার। ঝিনাইদহ ছিল তার রাজ্যের রাজধানী। খাঁন জাহান আলী (রাঃ) এর মত জলাশয় প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী এবং যত্নবান ছিলেন তিনি। রাস্তা নির্মাণ ও জলাশয় খনন করাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছেন৷ তারই ধারাবাহিকতায় এবং রাজ্যের জলকষ্ট লাঘবের জন্য তিনি ঝিনাইদহের ঐতিহ্যবাহী পাগলা কানাই ইউনিয়নে খনন করেন ঢোল সমুদ্র দীঘি। ঢোল সমুদ্র দীঘিটি শতাব্দী পরিক্রমায় পানীয় জলের অফুরন্ত আঁধার হিসেবে এবং একজন পরাক্রমশালী রাজার রাজকীয় স্থাপনাসমূহের একটি স্মৃতি হিসেবে আজও টিকে আছে ঝিনাইদহের বুকে।
ইতিহাস ও ঐতিহ্য ভরপুর ঝিনাইদহ জেলা। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতির দিক থেকে অন্যান্য জেলার থেকে অনেক এগিয়ে আছে ঝিনাইদহ জেলা। ইতিহাস-ঐতিহ্যের অফুরন্ত ভান্ডার এই ঝিনাইদহ। ধান, গম, আম, পাট, আখ, খেজুরের গুড়, কলা-পান ইত্যাদির জন্য সুনাম আছে এই জেলার। বিভিন্ন মৌসু্মে হরেক রকম ফসলের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য তো আছেই। সেই সঙ্গে রয়েছে মনোমুগ্ধকর প্রকৃতি এবং প্রাণজুড়ানো আবহাওয়া। এছাড়াও এই জেলায় রয়েছে প্রাচীন বিভিন্ন স্থাপনা, মসজিদ, মন্দির ও অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থান।
স্থাপনার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ঝিনাইদহের ঢোল সমুদ্র দীঘি। প্রায় ৫২ বিঘা জমির উপর অবস্থিত এই দীঘি ঝিনাইদহের সর্ববৃহৎ দীঘি। সুন্দর এবং মনোরোম পরিবেশ এই দীঘির মূল আকর্ষণ। বহুবছর আগে থেকেই এই দীঘি ঝিনাইদহে বিনোদনের একটি অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিভিন্ন উৎসবে যেমন পহেলা বৈশাখ, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, ঈদ ও বিভিন্ন পূজায় অনেক মানুষ ভিড় জমায় এই দীঘির পাড়ে। আবার অনেকেই দল বেঁধে এই দীঘির পাড়ে পিকনিক করতে আসে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা সময় কাটায় এই দীঘির পাড়ে। দীঘির চারিদিক ছোট ছোট টিলা রয়েছে। টিলার উপর থেকে উপভোগ করা যায় নজর কাড়া প্রাকৃতিক দৃশ্য। যেকোন প্রকৃতিপ্রেমীর হৃদয় মুহুর্তেই কেড়ে অনাবিল সেই সৌন্দর্য।
যেভাবে যাবেন ঢোল সমুদ্র
ঢোল সমুদ্র দীঘি ঝিনাইদহ শহর থেকে ৪ কিঃমি পশ্চিমে অবস্থিত। খুব সহজেই ঝিনাইদহ শহর থেকে ভ্যান রিক্সা, ইজিবাইক বা ব্যক্তিগতযোগে এই ঐতিহ্যবাহী ঢোল সমুদ্র দীঘি যাওয়া যায়।