পর্ব-১৩ আমার অপরাজিতারা
৯ মার্চ ২০১৮ ১২:৪৬
সফল নারীদের যখন ‘অপরাজিতা’ নামে উপাধি দেওয়া হয় তখন শুনতে ভাল লাগে, তবে মানতে নয়। মনে প্রশ্ন জাগে, নারীরা কি তাহলে পরাজিত হয়েই জন্ম নেয়! তাই শুধুমাত্র তার জীবন পথযাত্রায় সফলতা আসলেই সে ‘অপরাজিতা’ উপাধি পাবে? এ কেমন কথা!
আমি নারী দিবসে বিশ্বাসী নই। নিজেকে মানুষ হিসেবে প্রমাণ করতে পারাটাই একজনের একমাত্র নিজস্ব সফলতা বলে বিশ্বাস করি। যদিও ৮ ই মার্চ বিশ্বব্যাপী ‘নারী দিবস’ পালন করা হয়, তারপরও আমি আজকে অপরাজিতা ফুল নিয়ে কথা বলবো। নারীকে নিয়ে নয়।
আমার ছাদবাগানে দুই রঙের অপরাজিতা ফুলের গাছ আছে। নীল আর সাদা। নীল অপরাজিতা গাছ খুব সহজেই বেঁচে থাকে। সাবলম্বী নয় বলে কাঁধ খুঁজে নেয় নিজে নিজেই। সঠিক মাত্রায় যত্ন পেলে একটি কান্ডের প্রতিটি লতাই ফুল ফোঁটাতে থাকে সারা বছর। যদিও মাঝে মধ্যে লতাগুলোকে ছেটে দিলে ঝাড়ের বাড়ন্ত ভাবটা বেশি আসে।
একজনার বাগান থেকে একটা নীল অপরাজিতা ফল এনেছিলাম। অনেকটা শিমের মতন দেখতে। শুকনো হলে তবেই চারা করা যায়। সাধারণ একটা টবে ছিটিয়ে দিয়েছিলাম, সে ফলের ভেতরে থাকা তিনটি বীজ। মাথা উঠিয়ে আমার পানে তাকাতে সময় নেয়নি তারা। একজনকে বাসস্থান করে দিয়েছিলাম একটা পুরোনো টায়ারে। ঝুলিয়ে দিয়েছিলাম ছাদের দুটো পাইপের মাঝে। দিব্বি জীবন যাপন করছে সে গত কয়েক বছর ধরে। হাত পা ছড়িয়ে, আনন্দে। বাড়তি চাহিদা কখনই নেই তার। আর বাদ বাকী দুটো চারাকে একটা বালতিতে বাসস্থান করে দিয়েছিলাম। ছাদের দেয়াল ঘেঁষে। এরপর আর নীল অপরাজিতা ফুলের অভাব হয়নি আমার ছাদবাগানে। বর্ষা বা শরতে বেশী ফুল ফুঁটতে দেখি। আর সময়গুলোতে ঝিমিয়ে ফুল দেয় তারা। কিন্তু একেবারে থেমে থাকে না।
চাষী হলেও এক সময় জানতামই না যে, নীল ছাড়াও অপরাজিতার আরও অনেক রঙ আছে। একদিন প্রকৃতি প্রেমিক প্রভাষ আমীনের পোস্টে সাদা অপরাজিতার ফুল দেখে মাথা ঘুরে গিয়েছিল। সাথে সাথে তাকে চারা লাগবে জানালে সে বলেছিলেন, মুন্নী সাহা বান্দরবন থেকে বীজ নিয়ে এসেছিল। এটার বীজ হলেই আমাকে দেবেন। সত্যি সত্যি একদিন প্যাকেটে করে পৌছে দিয়েছিলেন কয়েকটা বীজ, সাদা অপরাজিতার।
আনন্দে আত্মহারা আমি বালতিতে রাখা দুটো নীল অপরাজিতার পাশে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম তাদের। দেড় দুইমাস পার হয়ে গেলেও তাদের দেখা না মেলায়, হাল না ছাড়লে মন খারাপ হচ্ছিল। সাধারণত নীল অপরাজিতা ফুলের বীজ নিজ থেকেই চারা হয়ে বের হয়। মাটি পেলেই, খুব সহজে। একদিন দুটো নতুন চারা সেই বালতিতে দেখা মাত্র পাতার হালকা সবুজ রঙে চিনে নিয়েছিলাম তারা সাদা অপরাজিতা। কারণ, নীল অপরাজিতার পাতা গাঢ় সবুজ হয়ে থাকে। খুব ধীর লয়ে বড় হয়েছে দুজন।
এ বছরের শরতে প্রথম একটা সাদা অপরাজিতা ফুল আমাকে দেখা দিয়েছে। এখন প্রতিদিন ফুঁটছে একটা দুটো করে। নীল আর সাদা রঙের জন্য একই জাতের গাছের মাঝে এতটা পার্থক্য হবে, ভাবিনি কখনও।
অপরাজিতা কখনও পরাজিত হয়ে জন্ম নেয় না। খুব সহজে মিলেমিশে থাকে সবার মাঝে। চারা তৈরীর জন্য বিশেষ যত্নও নিতে হয় না। প্রতিদিন জল আর মাঝে মাঝে শুকনো ডাল ছেটে দিলেই হলো। বাড়তে থাকে তারা মাথা উঁচূ করে। তবে চারা অপরাজিতার কাঁধ লাগে, খানিকটা সময়ের জন্য। তারপর নিজের মতন করে নিজেকে গুছিয়ে নেয়। ছড়িয়ে যায় চারিদিকে। সহজে হাল ছাড়ে না এই গাছ। একদম মৃতপ্রায় গাছেরাও জল নিয়মিত পেলে সবুজ পাতায় ফুল ফোঁটায়। শীত, গ্রীষ্ম বা বর্ষা যে কোন ঋতুতে, তারা তাদের মতন করে ফুল ফুঁটিয়ে থাকে। কখনও কম, কখনও বেশী।
যে কোন রঙেরই হোক না কেন, অপরাজিতা ফুলের জীবন যাপন, স্বভাব, বেড়ে ওঠা বা বেঁচে থাকাসহ সব মিলিয়ে যদি নারীকে তুলনা করে অপরাজিতা বলা হয় তাহলেই আমি শুধু নারীর জন্য ‘অপরাজিতা’ উপাধিটা মেনে নেব। নয়তো চাষীর কাছে অপরাজিতা শুধু ফুল হয়েই থাকবে সারা জীবন।
আমার কথা বিশ্বাস না হলে একবার নিজেই চেষ্টা করে দেখুন। ভালোবেসে একটা অপরাজিতা চারা দত্তক নিয়ে নিন। ছাদবাগানে বা বারান্দার গ্রীলে সবুজ পাতার ফাঁকে নীল বা সাদা অপরাজিতা ফুল আপনাকে কখনও ছেড়ে যাবে না। চাষী পরিবার, সুখী পরিবার।
সারাবাংলা/আরএফ