Wednesday 11 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ন্যাচারোপ্যাথি চিকিৎসায় সায়েটিকা পুরোপুরি ভালো হয়


৩১ অক্টোবর ২০২০ ১৬:৫৬

সালমা রশিদ, ইজিচেয়ারে বসে আছেন আর চোখ মুখ কুঁচকে ডান উরুর পাশ দিয়ে হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন। খেয়াল করলাম ওনার কোমরের পিছনে হট ওয়াটার ব্যাগ রাখা আছে। হাঁটু থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত একটা দড়ি জাতীয় রশি দিয়ে পেঁচানো। উনি কোকাচ্ছেন। সালমা রশিদ সম্পর্কে আমার খালাম্মা। গত বছর যখন ছুটিতে দেশে আসি তখনই জানলাম, উনি কোমর আর পায়ের ব্যথায় নড়াচড়া করতে পারছেন না। মোটামুটি শয্যাশায়ী তবে বিছানায় শুয়ে থেকেও ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন। ডাক্তার ব্যথার ঔষধ দিয়েছেন, খেলে কিছুক্ষণ ব্যথা কমে থাকে, তবে আবার বাড়ে। ডাক্তার Spine MRI করার জন্য বলেছেন। ৫৫ বছরের খালাম্মা আমার, সংসার সামলান, দেশ বিদেশ ঘোরেন, খুবই কর্মঠ। ওনার এই অবস্থা শুনেই উনাকে দেখতে যাই।

জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় ব্যথা হচ্ছে, কবে থেকে ব্যথা হচ্ছে, কি করলে ব্যথা বেড়ে যাচ্ছে ইত্যাদি। উনি বললেন, প্রায় মাস খানেক আগে কোমর ব্যথা শুরু হয়, নামাজে রুকু সিজদা দিতে কষ্ট হচ্ছিল তাই চেয়ারে বসে নামাজ পড়তে শুরু করেন। আস্তে আস্তে কয়েকদিনের মধ্যে ব্যথার সাথে ডান দিকে কোমরের পাশে জ্বালাপোড়া শুরু হয়। আর ব্যথা কোমর থেকে ডান উরুর পিছন দিক দিয়ে ডান পায়ের পাতা পর্যন্ত ছড়িয়েছে। জ্বালা জ্বালা অনুভূতিও উরু পর্যন্ত হচ্ছে। ডান পা কোমর থেকে ভারী হয়ে আছে। এক সপ্তাহ থেকে আর হাঁটতে পারছেন না, হাটলেই খোঁচা খোঁচা তীব্র ব্যথা। আর না হাঁটলেও বসা, শোয়া যে অবস্থায়ই থাকছেন জ্বলুনি আর অসহনীয় ব্যথা হচ্ছে। ডান কাত হয়ে শুতে পারেন না, ডান পাশ অবশ হয়ে যায়। বাম দিকে কাত হতে গেলেও অসহ্য ব্যথা, বালিশে পা রেখে, কোল বালিশের সাপোর্ট নিয়ে শুতে হয়। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠতে গিয়ে দেখেন ডান পা উপরে তুলতে পারছেন না, পা উঠাতে গেলে কোমর থেকে পায়ে অসহ্য ব্যথা হচ্ছিল, অনেকক্ষণ ধরে সময় নিয়ে দু’জনের সাহায্য নিয়ে গাড়িতে উঠতে পেরেছেন। আর এখন নড়াচড়া করাই অসম্ভব হয়ে উঠেছে। দু’ সপ্তাহ থেকে পায়খানা নিয়মিত হচ্ছে না।

খালাম্মার কথা শুনে, তখনই ওনার কয়েকটা ফিজিক্যাল এক্সামিনেশন করি। যার মধ্যে অন্যতম হলো Straight Leg Raising (SLRT) Test আর Slump Test. যা ভেবেছিলাম তাই। উনার সায়েটিকা নার্ভ এর সমস্যা হয়েছে। চিকিৎসা পরিভাষায় এই সমস্যা বা অসুখটাকে বলে সায়েটিকা (Sciatica)। সায়েটিকা নার্ভ শরীরের সবচেয়ে বড় নার্ভ। এই নার্ভ কোমর থেকে শুরু হয়ে দুই ভাগে ভাগ হয়ে পিছন দিক দিয়ে দুই হিপ হয়ে দুই উরু, দুই হাঁটু আর পা থেকে সোজা নীচে পায়ের পাতা পর্যন্ত গিয়ে থেমেছে।

কেন হয় সায়েটিকা ব্যথা
আমাদের মেরুদন্ডের হাঁড়ের ফাঁক দিয়ে দিয়ে নার্ভ জোড়ায় জোড়ায় বের হয়ে শরীরের দুই পাশের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোর সাথে সংযুক্ত হয়েছে। এই নার্ভগুলো শরীরের সংবেদন (অনুভূতি) আর সঞ্চালন (নড়াচড়া) এর তথ্য আদানপ্রদান করে শরীরকে সচল রাখতে সাহায্য করে। মেরুদন্ডের প্রতি দুইটি হাঁড়ের মাঝে জেলির মতো নরম একটা পদার্থ থাকে যাকে ডিস্ক বলে। মেরুদন্ডে অতিরিক্ত চাপ পড়লে এই ডিস্ক স্থানচ্যুত হয়ে নার্ভের উপর এসে পড়লে নার্ভে চাপ পড়ে নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার মেরুদন্ডের হাঁড় ক্ষয় হয়ে সরু হয়ে গিয়েও নার্ভে চাপ পড়ে নার্ভের ক্ষতি হয়ে নার্ভের অসুখসহ অন্যান্য শারীরিক জটিলতা শুরু হয়। নার্ভের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি নার্ভ হলো সায়েটিকা নার্ভ।

অতিরিক্ত ভারি কোন জিনিস তুললে, দীর্ঘ সময় বসে বা শুয়ে থাকলে, অনেক সময় ধরে গাড়ি চালালে, এমনকি ভিটামিন বি১২ এর ঘাটতি থেকেও সায়েটিকা নার্ভের ক্ষতি হয়ে সায়েটিকার ব্যথা শুরু হয়। এসব কারণের মধ্যে সালমা রশিদের বাস্তবতায় যেটা থেকে উনি সায়েটিকায় আক্রান্ত হয়েছেন তা সহজেই বোঝা যায়। তবু উনাকে জিজ্ঞেস করি যে, ব্যথা যখন ছিলো না, তখন কাজের সময় তিনি কি ভারী কোন জিনিস উঠানামা করেছিলেন। হ্যাঁ, পরিবারের সঙ্গে ইন্ডিয়ায় গিয়েছিলেন সেখান থেকে নেপাল, ভুটান হয়ে দেশে এসেছেন, সঙ্গে জিনিসপত্র ভর্তি ভারি ভারি কয়েকটি লাগেজ উঠানামা করেছেন। এর প্রায় ৩-৪ দিন পর থেকেই কোমর ব্যথা শুরু হয়ে ধীরে ধীরে ব্যথা বাড়তে বাড়তে আজকে এই অবস্থা।

যেভাবে ১৭ দিনে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলেন সালমা রশিদ

১ম দিন
– উনাকে চেয়ার থেকে বিছানায় শোয়াই এবং কোমরে ২০ মিনিট ধরে অলটারনেটিভ হট এন্ড কোল্ড প্যাক দেই।
– মেরিডিয়ান চ্যানেলের কয়েকটি পয়েন্টে থেরাপি করি।
– এরপর ১০ মিনিট Epsom salt হট ফুট বাথ করাই।
এক ঘন্টার ন্যাচারোপ্যাথী ট্রিটমেন্ট শেষ হলে উনি নিজে নিজে বিছানায় শোয়া থেকে উঠে বসেন এবং ধীরে ধীরে হাঁটেন। ব্যথা কমে যায় ৬০ শতাংশ। রাতে ব্যথা কিছুটা বাড়ে, ৭০ শতাংশ ব্যথার অনুভূতি হয়।

২য় দিন
– ভোরে আমি খালাম্মার জন্য Garlic Oil (ব্যথা সারাবার জন্য খুবই উপকারি) তৈরি করি এবং এই তেল দিয়ে কোমর এবং পুরো ডান পা মাসাজ করি।
– এরপর সায়েটিকা সারাতে পরীক্ষিত পাঁচটি ইয়োগা আসন করাই।
– ইয়োগা সেশন শেষে উনি হেঁটে ওয়াশরুমে যান, গোসল করেন, নাস্তা খান।
– বিকেলে আকুপ্রেসার থেরাপি করি।
– রাতে ঘুমানোর আগে ১০ মিনিট Epsom Salt হট ফুট বাথ করাই। তারপর গোল্ডেন মিল্ক (বিশেষভাবে প্রস্তুত হারবাল মিল্ক) খাওয়াই।

৩য় দিন
সকালে বিছানা থেকে কারো সাহায্য ছাড়া একা নামেন।
– Garlic Oil মাসাজ করাই।
– এরপর ইয়োগা করাই।
– বিকেলে আকুপ্রেসার থেরাপি করি।
– ঘুমানোর আগে Epsom Salt হট ফুট বাথ এবং গোল্ডেন মিল্ক খাওয়াই।
এভাবে সাত দিন একই নিয়মে ট্রিটমেন্ট চলে।

পরবর্তী ১০ দিন (৮ম থেকে ১৭ তম দিন)
– পরবর্তী দশ দিন উনি আমার বাসায় এসে দশ সেশন আকুপাংচার থেরাপি নেন।

পরবর্তী পরামর্শ হিসেবে দিই
– পাঁচটি ইয়োগা আসন সপ্তাহে পাঁচদিন করে নিয়মিত করে যেতে বলি।
– অতিরিক্ত ভারি কোন জিনিস উঠানো-নামানো করতে নিষেধ করে দেই।
– দাঁড়ানো, বসা এবং শোওয়ার সঠিক নিয়ম শিখিয়ে দেই এবং সে নিয়মে posture maintain করতে বলি।
– ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে বলি।

ফলাফল
মিসেস সালমা রশিদ এখন চেয়ার ছাড়া উঠাবসা করে নামাজ পড়েন। স্বচ্ছন্দে গাড়িতে চড়তে পারেন। কারও সাহায্য ছাড়া হাঁটাচলা করতে পারেন স্বাভাবিকভাবে। ব্যথা নেই একটুও। সতের দিনের ন্যাচারোপ্যাথি চিকিৎসায় ব্যথায় কাতর একজন শয্যাশায়ী মানুষ আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন। ঘটনাটি গল্প বা কল্পনা নয়, সত্য। ন্যাচারোপ্যাথি চিকিৎসাও ম্যাজিক নয় বরং প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক সত্য। আপনার পরিচিত কেউ এই সমস্যায় আক্রান্ত থাকলে পদ্ধতিগুলো জানুন আর প্রয়োগ করে দেখুন, সত্যটা তখন আপনিও অনুধাবন করবেন।

টপ নিউজ ডা. ঐন্দ্রিলা আক্তার সায়েটিকা সায়েটিকা নার্ভ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

ই-ক্যাবে প্রশাসক নিয়োগ
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৬:১৪

সম্পর্কিত খবর