Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রযুক্তি ডেকে আনছে ‘টেক্সট নেক’, জেনে নিন মুক্তির উপায়


৭ নভেম্বর ২০২০ ২০:২৭

আমার বন্ধু জ্যাম আরিতে, ভুটানের মেয়ে। BNYS (Bachelor of Naturopathy & Yogic Sciences) কোর্সে পড়ার সময় আমাদের বন্ধুত্ব হয়। থার্ড ইয়ারে একদিন আকুপাংচার ক্লাস চলাকালীন জ্যাম অসুস্থ হয়ে পড়ে, প্রচণ্ড ঘাড় ব্যথায় ও ক্লাস করতে পারছিলো না। ক্লাস টিচার ওর অবস্থা দেখে তাৎক্ষনিক ওর ব্যথা কমানোর জন্য আকুপাংচার থেরাপি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমরা তখন সেকেন্ড ইয়ার পাশ করে সবেমাত্র থার্ড ইয়ারের ক্লাস শুরু করেছি। আকুপাংচার সাবজেক্টটাও থার্ড ইয়ারেই প্রথম পড়া শুরু করেছি। সুচ ফুটানোতে তখন সবারই একটা ভীতি কাজ করতো। জ্যাম এই ভয়ে আকুপাংচার নেবে না বলে ম্যামকে রিকোয়েস্ট করছিলো। কিন্তু ও ব্যথায়ও ভীষন কষ্ট পাচ্ছিলো। সেদিন জ্যাম আর আমি পাশাপাশি সিটে বসেছিলাম। অবস্থা দেখে আমি ক্লাস ম্যামকে বললাম, ‘আমি রিফলেক্সোলজি জানি, আপনি অনুমতি ‍দিলে আমি ওর ব্যথা কমানোর চেষ্টা করতে পারি’।

রিফ্লেক্সোলজির উপর আমার বেসিক আর অ্যাডভান্স দুই ধরণের কোর্সই করা ছিলো। BNYS কোর্স করতে ভারতে যাবার আগে আমি বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ বছর এই বিষয়ে কাজ করেছি। রিফলেক্সোলজিতে তাৎক্ষনিক ঘাড় ব্যথা কমানোর খুবই কার্যকরী কিছু পয়েন্ট রয়েছে। সেসব পয়েন্টে বিশ মিনিট থেরাপি করতেই জ্যাম আরাম বোধ করা শুরু করে, ওর ব্যথা কমে যায় প্রায় আশি ভাগ। সুস্থ বোধ করলে ম্যাম ওকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেন এবং বিকেলে OPD (Out Patient Department)-তে দেখা করতে বলেন। বন্ধুকে সঙ্গ দেয়ার পাশাপাশি OPD-র ডাক্তার ওর সমস্যার ডায়াগনোসিস কিভাবে করেন আর কি চিকিৎসা দেন তা শেখার জন্য সেদিন বিকেলে জ্যামের সঙ্গে আমিও OPD-তে যাই।

মেডিকেল অফিসার ওর ফিজিক্যাল এক্সামিনেশন করেন। উনি জ্যামের ঘাড় সামনে থেকে পিছনে, আবার পিছন থেকে সামনে আনছিলেন আর ওকে লক্ষ্য করছিলেন। আবার দু’পাশে ঘাড় কাত করাচ্ছিলেন। কোন মুভমেন্টই জ্যাম ভালো করে করতে পারছিলো না, ওর ঘাড় নাড়াতে কষ্ট হচ্ছিলো। নড়াচড়া করার সময় ব্যথা হচ্ছিলো। এটাকে Spurling Sign পজিটিভ বলে। মেডিকেল অফিসার এবার ওকে কিছু প্রশ্ন করেন। উনি জিজ্ঞেস করেন, কবে থেকে ব্যথা শুরু হয়েছে, কখন কখন ব্যথা হয়, কত ঘন্টা মোবাইল, ল্যাপটপ চালায়, রাত কয়টায় ঘুমায়, কি কি কাজের জন্যে ইলেকট্রিক্যাল ডিভাইসে বেশি সময় দিতে হয় ইত্যাদি।

ফিজিক্যাল এক্সামিনেশন আর কথাবার্তা শেষে উনি জ্যামকে ওর ঘাড়ে ব্যথার কারণ জানান। ঘাড় মূলত আমাদের মাথার ওজন বহন করে। আমাদের মাথার ওজন হলো গড়ে দশ পাউন্ড। এই ওজন আমাদের সার্ভাইক্যাল স্পাইন বা ঘাড় খুব সহজেই বহন করতে পারে। যত বেশি আমাদের মাথা আর ঘাড় সামনে ঝুঁকাতে থাকি তত বেশি সার্ভাইক্যাল স্পাইন বা ঘাড়ের উপর চাপ পড়তে থাকে। যখন আমরা আমাদের সেল ফোনের দিকে ঝুঁকে কাজ করি তখন সার্ভাইক্যাল স্পাইন বা ঘাড়ের উপর প্রায় পঞ্চাশ পাউন্ড বাড়তি চাপ পড়ে। এভাবে দিনের পর দিন অতিরিক্ত চাপ পড়ার ফলে আমাদের ঘাড়ের মাংসপেশি, লিগামেন্ট, স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্থ হতে থাকে। আর একসময় ঘাড়ব্যথা, মাথাব্যথা, কাঁধব্যথা, স্নায়ুর সমস্যা, ডিপ্রেশন এমনকি হার্টের অসুখও লক্ষণ হিসেবে দেখা দিতে পারে। এই সমস্যাটাকে উনি টেক্সট নেক (Text Neck) বললেন। অসুখের এই নামটা সেদিন প্রথম জানলাম। দিন রাত মোবাইল আর ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইসে লেখালেখি আর ‘Text’ চালাচালি করা থেকে এই অসুখের শুরু হয় বলেই টেক্সট নেক (Text Neck) নামকরণ। উনি আরও বললেন, এই সমস্যাটা খুব সূক্ষভাবে শুরু হয়, তাই প্রথম দিকে বোঝা যায় না । ধীরৈ ধীরে তীব্রতা বাড়তে থাকে। এক সময় এটাই সার্ভাইক্যাল স্পন্ডিলোসিস হিসেবে চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। জ্যামের সমস্যাটা প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, সচেতন না হলে অবস্থা খারাপ হবে বলে সাফ জানিয়ে দিলেন।

মেডিকেল অফিসার জ্যামকে একটা প্রেসক্রিপশন করে দিলেন তিন সপ্তাহের জন্য। ও খুব নিয়ম করেই তা মেনে চলে এবং দু’সপ্তাহের মধ্যেই ওর সমস্যাগুলো কেটে যায়, তিন সপ্তাহে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠে জ্যাম। ক্লাসে প্রতিদিন আকুপাংচারের ম্যাম ওকে জিজ্ঞেস করতো যে, ও নিয়ম মেনে চলছে কিনা। মোবাইল চালানো কমিয়েছে কিনা ইত্যাদি।

আমার বন্ধু জ্যাম আরিতে যে নিয়মগুলো মেনে তিন সপ্তাহে সুস্থ হয়ে ওঠে আসুন দেখে নেই সেগুলো-

  • ইয়োগা থেরাপি (সপ্তাহে ৬ ‍দিন)
  • হাইড্রোথেরাপি
  • মাসাজ থেরাপি
  • আকুপ্রেসার
  • সান থেরাপি

সকাল ৫:০০-৬:০০ টা

ইয়োগা আসন (সার্ভাইক্যাল স্পন্ডিলোসিসের জন্য নির্ধারিত আসন গুলো করা)

ইয়োগা নিদ্রা মেডিটেশন

প্রাণায়াম

শনি এবং রবিবার

সার্ভাইক্যাল স্টিম বাথ নেওয়া।

রবিবার ঘুমানোর আগে-এপসম সল্ট বাথ নেওয়া (১০মিনিট)

সোম, মঙ্গল, বুধবার

সার্ভাইক্যাল হট এন্ড কোল্ড কমপ্রেস নেওয়া

বৃহস্পতি এবং শুক্রবার

পার্শিয়াল নেক মাসাজ নেওয়া

সপ্তাহে ৫ দিন বিকেলে ২০ মিনিট করে আ‍কুপাংচার আর রিফ্লেক্সোলজির পয়েন্টগুলোতে থেরাপি নেওয়া

শরীরে বিশেষ করে মেরুদন্ডে প্রতিদিন ২০ মিনিট করে সূর্য তাপ নেওয়া।

জ্যামের পরিপূর্ণ সুস্থতার জন্য তাকে বিশেষ খাদ্যতালিকা দেওয়া হয়েছিলো। আসুন দেখে নেই তা।

দৈনন্দিন খাদ্য তালিকা

ভোরে ঘুম থেকে উঠে

  • ২৫০ মি.লি. হালকা গরম লেবু পানি পান
  • দশ মিনিট পর অঙ্কুরিত ছোলা খাওয়া

সকালের নাস্তা

  • রুটি, সবজি, ডিম, টমেটো স্যুপ এক কাপ, ২০০ মি.লি. সয়া জুস
  • বেলা ১১ টায় একটা ফল

দুপুরের খাবার

  • এক কাপ ভাত, ২ টা গমের আটার রুটি, ৩০০ গ্রাম রান্না করা সব্জি, এক কাপ ডাল, সালাদ এক বাটি, ২০০ মি.লি. ঘোল

রাতের খাবার

  • ২ টা গমের আটার রুটি, পালং বাটার স্যুপ এক কাপ ও ৩০০ গ্রাম সবজি
  • ঘুমানোর আগে এক কাপ গোল্ডেন মিল্ক খেয়ে ঘুমানো

খাবারের তালিকায় মাছ, মাংস ছিলো না। কারণ ভারতের উত্তর প্রদেশে মাছ, মাংস খাওয়ার প্রচলন নেই। ওরা প্রোটিনের চাহিদা মেটায় ডাল এবং ডাল জাতীয় বীজ, সয়াবিন, দুধ ও ডিম থেকে। ডাক্তার জ্যামকে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস এবং ভিটামিন-ডি সমৃদ্ধ খাবার খেতে বলেন। এবং ইলেকট্রনিকস ডিভাইস চালানোর সময় ঘাড় নিচু না করে মাথার সমান্তরালে রেখে কম সময় চালোনোর পরামর্শ দেন। এমনকি এক হাতে মোবাইলে মেসেজ বা লেখালেখি না করে দুই হাতের আঙ্গুলের সাহায্যে করতে বলেন।

ঐ সময় জ্যামের আকুপাংচারে ভীতি ছিলো বলে ওকে আকুপ্রেসার থেরাপি নিতে বলা হয়েছিলো। আর এই থেরাপিটা বন্ধু হিসেবে আমিই ওকে করে দিয়েছিলাম দু’সপ্তাহ। পরে ও নিজে নিজেই করতো। ইয়োগার অনুশীলনগুলো আমরা ভোরে উঠে হোস্টেলের খোলা মাঠে করতাম। অন্যান্য থেরাপিগুলো জ্যাম ক্লাস শেষে বা কখনো ক্লাস বিরতিতে আমাদের ডিপার্টমেন্টের ট্রিটমেন্ট সেকশনে নিতাে এক্সপার্ট-এর কাছ থেকে।

আমার এই বন্ধুটি এখন আকুপাংচার এক্সপার্ট। ইয়োগা, আকুপাংচারসহ ন্যাচারোপ্যাথি মেডিসিনের বিভিন্ন থেরাপি নিয়ে নিজের দেশে খুব ভালো কাজ করছে। আমরা আমাদের ক্যাম্পাসের সময়গুলোর স্মৃতি রোমন্থন করি আর কাজের অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করি নিয়মিত। ন্যাচারোপ্যাথি মেডিসিনের ছাত্র হিসেবে আমাদের নিজেদের এবং OPD, IPD তে চিকিৎসা নেওয়া সকল রোগির ডাটা সংগ্রহে রাখতে হয়েছে। জ্যামের থেরাপি আর ডায়েট প্ল্যানটাও আমার সংগ্রহে ছিল। সেটাই আজ শেয়ার করলাম। যারা সার্ভাইক্যাল স্পন্ডিলোসিসে ভুগছেন আজকের লেখাটা তাদের জন্য।

Text Neck টপ নিউজ টেক্সট নেক সার্ভাইক্যাল স্পন্ডিলোসিস


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর