Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রূপবতীর রূপা


১৫ মার্চ ২০১৮ ১৪:৩৯

ফারহানা ইন্দ্রা।।

রূপা, শব্দটি শুনলেই চোখে ভাসে মেয়েদের হাসিমুখ। বড় নাকফুল, গলায় মালা, কিংবা কানে বড় ঝুমকা। কানে বাজে মলের রুনুঝুনু, কোমড়ের ঘুনসির টনর টনর। এতোটাই গভীর সম্পর্ক মেয়েদের রূপার সাথে। এই সম্পর্ক আবহমান কাল ধরেই চলে আসছে। অতীতেও সোনার চাইতে রূপার প্রতিপত্তিই ছিলো বেশি। কারন রূপা শুধুমাত্র অলংকার তৈরিতে নয়, বরং মুদ্রা, হাতিয়ার, নিত্য ব্যবহার্য বাসনকোসন ইত্যাদি জিনিস তৈরিতেও ব্যবহার হতো।

রূপার ইতিহাস

৪৭ পারমাণবিক ভরের মৌলিক ধাতু রূপার নামকরণ হয়েছে এশিরীয় শব্দ ‘Serpu’ কিংবা গথ জাতির ভাষায় ‘Silbur’ থেকে। এর বৈজ্ঞানিক নাম আর্জেন্টাম (Argentum) যা ল্যাটিন শব্দ হলেও সম্ভবত তা সংস্কৃত শব্দ ‘আর্জেন্টা’ থেকে এসেছে যার অর্থ ‘আলোর মত সাদা’।

রূপার ব্যবহার সর্বপ্রথম কখন হয়েছিলো তা সঠিক ভাবে জানা না গেলেও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় হাজার বছর ধরে রূপার ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। রাসায়নিক গবেষণায় জানা যায় রূপার মাঝে এন্টি ব্যাকটেরিয়াল উপাদান আছে কার্যকর ভাবে জীবানু ধ্বংস করতে পারে। এ থেকে ধারনা পাওয়া যায় কেন তৈজসপত্র তৈরিতে রূপার বহুল ব্যবহার ছিলো। অর্থাৎ রুপা কেবলমাত্র আলংকরিক কিংবা আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে নয় বরং এর ব্যবহারিক কার্যকারিতার কারণে দীর্ঘসময় ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

রূপার গয়নার আদ্যোপান্ত

সে যাই হোক, রূপার গয়নার আকর্ষণ কিন্তু চিরায়ত। অনেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে থাকেন বাহারি ডিজাইনের রূপার গয়না। থেমে নেই গয়নায় রূপার ব্যবহার। এখনো নিত্যনতুন সব ডিজাইনের রূপার গয়না পাওয়া যায় হাল আমলের নানান ব্র্যান্ড শপ কিংবা আদি গয়নার দোকানগুলোতে। সোনার দামের উর্ধ্বগতি ও অস্থিতিশীলতার কারণেও মানুষজন বিকল্প হিসেবে রূপার গয়নার দিকে ঝুঁকছেন। বর্তমান বাজারে নানা ধরনের রূপার গয়না পাওয়া যায়। যেমন প্লেইন রূপার গয়না, নানান ঝকমকে পাথর কিংবা মুক্তা বসানো রূপার গয়না, গোল্ড প্লেটেড রুপার গয়না ইত্যাদি।

আড়ং এর মতো নামকরা কিছু দেশি ব্র্যান্ড নিত্যনতুন ডিজাইনের রূপার গয়না তৈরি করে দেশে বিদেশে নতুন করে ক্রেতাদের আগ্রহী করে তুলছে। দৈনন্দিন ব্যবহার কিংবা বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষ্যের জন্য তাই দিন দিন বাড়ছে রূপার গয়নার ব্যবহার। ব্যক্তিগত পর্যায়েও অনেকে রূপার গয়না তৈরির কাজ করছেন। এমনই একজন হলেন লোরা খান। অনলাইনে তিনি ‘6 Yards Story’ নামে একটি রূপার গয়নার অনলাইন শপ চালাচ্ছেন। লোরা জানাচ্ছিলেন রূপার গয়না নিয়ে তার কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা- ‘আমি আসলে ব্যতিক্রমী গয়না পরতে পছন্দ করতাম। সেখান থেকে গয়না নিয়ে কাজ করার আগ্রহ। রূপা নিয়ে কাজ করি মূলত এর গর্জিয়াস অক্সি লুকের জন্য। শুরুর দিকে শুধুমাত্র ক্যাজুয়াল গয়না তৈরি করলেও এখন অনেকেই বিয়ের গয়নাও রূপার চাচ্ছেন। বিয়ের পোশাক অনুযায়ী তাদের জন্য গয়না তৈরি করে দেই আমি।’ লোরা আরো জানালেন, রূপার অভিজাত লুকের জন্যই রূপার গয়না ক্রেতাদের আকর্ষণ ধরে রাখবে। লোরার অনলাইন শপে পাঁচশত থেকে পঁচিশ হাজার টাকা মূল্যমানের রূপার গয়না পাওয়া যায়।

 

 

রূপার গয়নার জুয়েলার্সগুলোর বর্তমান হালচাল নিয়ে কথা হচ্ছিলো চাঁদনি চক মার্কেটের কুমকুম অলংকারের স্বত্বাধিকারী সুমন পালের সাথে। তিনি জানালেন স্বর্ণের বাড়তি দামের কারণে কিছুদিন আগ পর্যন্তও রূপার ব্যবসা ছিলো জমজমাট। তার কারখানাতেই একসাথে কাজ করতো বিশের বেশি কারিগর। নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ ইত্যাদি নানান জায়গা থেকে খুচরা দোকানী ও ক্রেতারা আসতেন রূপার গয়না কিনতে। কিন্তু বর্তমানে বাজারে বাহারি ডিজাইনের সস্তা, রংচঙে গোল্ড প্লেটেড মেটালের ভারতীয় গয়নার অবাধ প্রবেশের কারণে উনাদের ব্যবসা অনেকাংশেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। অর্ডার দিয়ে গয়না তৈরির চেয়ে ক্রেতারা এখন সহজলভ্য সেসব রেডিমেড ভারতীয় গয়নার দিকে ঝুঁকছেন। সেইসাথে অনলাইন ব্যবসাকেও দায়ী করেন তিনি। মানুষজন ঘরে বসে সহজেই অনলাইন শপগুলো থেকে পছন্দমাফিক গয়না অর্ডার করতে পারছে এবং শ’খানেক টাকা ডেলিভারি চার্জ দিয়েই তা হাতে পাচ্ছে বলে দোকান ঘুরে পরিশ্রম করে গয়না কেনার আগ্রহ কমছে দিনকে দিন। কাজ কমে যাওয়ায় তৈরি হচ্ছে কারিগরস্বল্পতা, নতুন কারিগররা রূপা নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হচ্ছে না।

 

 

চাঁদনিচকেই পুষ্প আলয় জুয়েলার্সে কথা হল রুবিনা ইসলামের সাথে। জানালেন হুট করেই ছোট বোনের বিয়ের তারিখ চূড়ান্ত হওয়ায় ড্রেসের সাথে মিলিয়ে রূপার গয়না কিনতে এসেছেন।

কেন রূপার গয়না? উত্তরে জানালেন সব কাপড়ের সাথে ম্যাচ করে তো স্বর্ণের গয়না কেনা সম্ভব নয়। কিন্তু  ম্যাচিং গয়নাই চাই। তাই গোল্ড প্লেটেড রূপার গয়নাই ভরসা। আরো জানালেন, রূপার গয়না অনুষ্ঠান ছাড়াও যেকোন সময়ে পড়া যায়, ক্যাজুয়াল ব্যবহারের জন্যও মানানসই। রূপার দামও সাধ্যের মাঝে, তাই যখন তখন কেনা যায়। অলকা শিল্পালয় জুয়েলার্সে রূপার গয়না কিনতেেএসেছেন সোহান। হাসিমুখে জানালেন, ছুটিতে বাড়ি যাবেন। গত সপ্তাহেই জন্ম নিয়েছে তার প্রথম কন্যা সন্তান। সন্তানের জন্য রূপার মল আর স্ত্রীর জন্য নিচ্ছেন পাথর বসানো বড় লকেটের রুপার চেইন। সাধ্যের মাঝে চেষ্টা করছেন প্রিয়জনদের মুখে হাসি ফোটাতে।

রূপার বর্তমান বাজারদর ও মজুরির অবস্থা

রূপার ভরিপ্রতি দাম এখন ১০৫০ টাকা। বছরখানেক ধরে দাম স্থিতিশীল আছে। প্রতিভরি গয়না তৈরির সর্বনিম্ন মজুরি ১৫০ টাকা যা ডিজাইন ও দোকানভেদে ওঠানামা করে। ব্র্যান্ডের দোকানগুলোতে রূপার গয়না দাম নির্ধারণ হয় ডিজাইনের উপর ভিত্তি করে। দাম শুরু হয় পাঁচশ টাকা থেকে। এসব দোকানের রূপার গয়নার বিশেষত্ব হচ্ছে প্লেইন রুপার পাশাপাশি রুবি, পান্না, নীলা কিংবা মুক্তা বসানো রূপার গয়নার বিশাল সংগ্রহ থাকে। জনপ্রিয় ব্র্যান্ড আড়ং এর রূপার গয়না সাধারণত একটু কালচে ধাঁচের হয়, যা দেয় এন্টিক লুক।

 

 

রূপার রকমফের

বর্তমানে বাজারে দেশি ও ভারতীয় দুই ধরনের রূপা পাওয়া যায়। রুপা কেনার সময় দেশি সাধারণ রূপা কেনাই ভাল কেননা এর বিনিময় মূল্য রয়েছে। পুরাতন রূপার গয়না ফেরত দিলে শতকার ৬০ টাকা হারে ফেরত পাওয়া যায়। ভারতীয় রূপায় খাদ বা মেটাল বেশি থাকায় সাধারণত এর বিনিময় মূল্য থাকে না।

রূপার গয়না পরিস্কারের নিয়ম

রূপার গয়না পরিষ্কার করাও খুব সহজ। নিত্য ব্যবহার্য রূপার গয়না ঘরেই পরিষ্কার করা যায়। গরম পানিতে একটু ডিটারজেন্ট ও লেবুর রস দিয়ে তাতে রুপার গয়না অল্প সময় ভিজিয়ে রেখে ব্রাশ দিয়ে ঘষলেই তা আবার নতুনের মতো চকচকে হয়ে উঠে।

 

কালের পরিক্রমায় রূপার ‘আলোর মতো সাদা’ প্রভাব ভারতীয় গোল্ড প্লেটেড মেটালের গয়নার সাথে প্রতিযোগীতায় কিছুটা উজ্জ্বলতা হারালেও স্থায়ীত্ব ও আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে রূপা এখনো প্রথম পছন্দ অনেকের। নানা উত্থান-পতনের মধ্যদিয়ে হাজার বছর ধরে সগৌরবে টিকে আছে রূপা, ইতিহাস স্বাক্ষী দেয় টিকে থাকবে আগামীতেও।

 

ফিচার ফটো মডেল-  তারিন ।।  আলোকচিত্র- আশীষ সেনগুপ্ত

অন্যান্য ছবি কার্টেসী- সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরি

 

সারাবাংলা/এসএস

গয়না রূপা


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর